ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা ৭ বোন উপাখ্যান
নাগাল্যান্ডের লোকসংস্কৃতির প্রতীক হনবিল উৎসবের একটি দৃশ্য ছবিঃ বিবিস নিউজ বাংলার সৌজন্যে |
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্য বা প্রদেশকে একত্রে
সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। প্রদেশগুলো হলোঃ
- আসাম (Assam)
- মেঘালয় (Meghalaya)
- ত্রিপুরা (Tripura)
- মণিপুর (Manipur)
- মিজোরাম (Mizoram)
- নাগাল্যান্ড (Nagaland)
- অরুণাচল প্রদেশ (Arunachal Pradesh)
এই সাতটি রাজ্য ভারতীয় উপমহাদেশের
প্রাচীন ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। রাজ্যগুলি
ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে একটি সরু অঞ্চল, যেটা ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত- সেটা
পেরিয়ে প্রসারিত অঞ্চলে একই সাথে অবস্থিত বিধায় এটিকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়। এই
সাত রাজ্যের মধ্যে জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও অনেক আগে থেকেই এরা
রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একই রকম।
লক্ষণীয় বিষয়
হল, ভারতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যগুলোকে বোঝাতে ‘নর্থ-ইস্ট’ বা
‘নর্থ-ইস্টার্ন স্টেটস’ কথাটাই বেশি ব্যবহৃত হয়। সেভেন সিস্টার্স কথাটা এককালে
জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে ভারতীয়দের কথাবার্তায় প্রচলিত নাই। অথচ বাংলাদেশে ওই
অঞ্চলটিকে বোঝাতে ‘সেভেন সিস্টার্স শব্দটিই ব্যবহৃত হয়। ইদানিং বহুল ব্যবহৃত।
মূল আলোচ্য বিষয়
‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলির আয়তন ভারতের মোট আয়তনের ৪ শতাংশ (৪%) মাত্র।
সাতটি রাজ্য মিলে মোট আয়তন ২,৬২,১৪৮ বর্গ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশের প্রায়
দ্বিগুণ। ভারতের সাথে বাংলাদেশের মোট সীমান্ত ৪,১৫৬ কিলোমিটার, যার ১৫৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত এই ‘সেভেন সিস্টার্সের ৪টি রাজ্যের সাথে। মজার ব্যাপার
হলো, আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় ছাড়া অন্য তিনটি রাজ্যর সাথে বাংলাদেশের
কোন স্থল সীমানাই নেই। ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২২ কিলোমিটার প্রস্থের ‘চিকেন নেক’
এইখানেই অবস্থিত।
সেভেন সিস্টার্স পরিচিতি |
সেভেন সিস্টার্সকে বহুদিন ধরে "𝐋𝐚𝐧𝐝𝐥𝐨𝐤𝐞𝐝" বলে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চট্রগ্রামের একদম পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। চট্রগ্রামকে অপর পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ভারতের মিজোরাম রাজ্য। ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম ত্রিপুরা রাজ্যর জনসংখ্যা হচ্ছে ৪১ লাখ ৪৭ হাজার। অপরদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের জনসংখ্যা হচ্ছে ৪ কোটি। ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য মিজোরামের জনসংখ্যা হচ্ছে মাত্র ১২ লক্ষ ৫০ হাজার। বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের জনসংখ্যাও তার চাইতে ৮ গুণ বেশি, অর্থাৎ প্রায় ৯৪ লাখ। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের জনসংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৫ কোটি। সেই হিসেবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩৫ ভাগের মাত্র এক ভাগ মানুষ বসবাস করে এই সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে।
ইদানিং এই সেভেন সিসস্টার্স নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। কথায় কথায় সেভেন সিস্টার্স খেয়ে দেওয়ার হুংকার দেয় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ইউনুস সরকার ও তার অনুসারীরা। ক্ষমতা গ্রহণের দুইদিন আগে সুদূর প্যারিসে বসেই ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস ভারতের এনডিটভি-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ – সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।” সেই থেকেই ‘সেভেন সিস্টার্স’ বিতর্কের সূত্রপাত। এরপর বাংলাদেশে অকস্মাৎ বন্যার সময়ে একদল তথাকথিত ছাত্র-জনতাকে বলতে শোনা যায়, “বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!” এভাবে আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ধরতে গেলে একমাত্র প্রতিবেশি ভারতের সাথে শত্রুতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে সেভেন সিস্টার্সের প্রতিবেশী রাজ্য। বঙ্গোপসাগরে আছে ভারতের প্রায় ১৩ টি সামুদ্রিক বন্দর। সেখানে বাংলাদেশের রয়েছে মাত্র ৩ টি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ভারতের ৫ টি সামুদ্রিক বন্দর। ভারতের সেভেন সিস্টার্স থেকে কলকাতা বন্দরের দূরত্ব প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার। মিজোরাম থেকে চট্রগ্রাম বন্দরের দূরত্ব হচ্ছে ৬৫০কি.মি., মনিপুর থেকে ৬৫০কি.মি., নাগাল্যান্ড থেকে ৬৫০কি.মি., অরুণাচল থেকে ১৩০০কি.মি., ত্রিপুরা ২৪৮ কি.মি., মেঘালয় থেকে চট্রগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫০ কি.মি.। তার মানে শুধুমাত্র দূরত্ব ও সময় বাঁচানোর জন্য ভারত বাংলাদেশের সাথে চট্রগ্রাম রামগড় সীমান্তে ট্রানজিট চুক্তি করেছে। বিনিময়ে নিজ দেশের উপর দিয়ে বাংলাদেশকে নেপাল ও ভুটানের সাথে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে।
ভারতের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ হয়ে গেলেও ভারত আসামের স্থলবন্দর ব্যবহার করে এই সেভেন সিস্টার্সে তাদের পণ্য ও অন্যান্য সরঞ্জাম পাঠাতে পারে। প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের সামুদ্রিক বিমান তো আছেই। তাছাড়া সেভেন সিস্টার্সের প্রতিটি রাজ্যে একাধিক বিমান বন্দর রয়েছে ভারতের। ‘নর্থ-ইস্ট’ এর সাথে যোগাযোগ সহজ করতে বর্তমানে পাহাড় কেটে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থারও যথেষ্ট উন্নতি করেছে ভারত। এক্ষেত্রে ভারত কোনভাবেই বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল কোন রাষ্ট্র নয়। বরং ভারত চট্রগ্রাম বন্দর ব্যবহার না করলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিগ্রস্ত করবে এতে কোন সন্দেহই নেই।
মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দরগুলো ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় এই সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলির জন্য আরেকটি বিকল্প পথ। কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট পরিবহন প্রকল্পে এজন্য চুক্তি করেছে ভারত ও মায়ানমার সরকার। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়া ভারতের সেভেন সিস্টার্স ‘ল্যান্ডলকড’ এটা পুরোটাই একটা বোগ্যাস গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়। 𝐈𝐧𝐝𝐢𝐚 𝐏𝐨𝐫𝐭𝐬 𝐆𝐥𝐨𝐛𝐚𝐥 𝐋𝐭𝐝 ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের সিত্তে সামুদ্রিক বন্দরের সাথে স্থল ট্রানজিটের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে, যা ভারত তার সেভেন সিস্টার্সের পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করে।
মায়ানমারের সিত্তে সামুদ্রিক বন্দর থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের দূরত্ব মাত্র ৬০০ কিলোমিটার, যা বাংলাদেশ থেকেও কম। তাছাড়া মনিপুর দিয়ে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের মাই সটের সাথে মহাসড়ক প্রকল্পে ভারত যুক্ত। এই দেশে আসলেই যারা গাঁজাখুরি গল্প প্রচার করে তারা যে কতবড় আহম্মক হয়ে নিজ দেশের পায়ে কুড়াল মেরেছে তা নিজ চোখেই দেখুন।
ভারত
বাংলাদেশ প্রায় ১১.৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।এর মধ্যে বিদ্যুৎ ১.৪২
বিলিয়ন ডলারের এবং পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম ৭২৩ মিলিয়ন ডলারের।
ভারত নেপালের সাথেও ৮.৬৬ ডলারের ব্যবসা করে। তার মানে বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ছাড়া আর কোনভাবেই ভারতের জন্য তেমন ভুমিকা রাখে না।
ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হচ্ছে চীন। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয় প্রায় ১১৮. ৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থাৎ বাংলাদেশের দশগুণ। বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে ভারত ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চীন, তাইওয়ান ও তুরস্কের মতো দেশে তাদের রপ্তানি আরও বাড়িয়ে দেবে।
এই মুহূর্তে ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে সকল প্রকার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করে তবে বাংলাদেশ সারাজীবনের জন্য এক বিশাল অর্থনৈতিক খাদের কিনারায় পড়ে যাবে। প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় বন্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশের। ভারতের ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা নিয়ে প্রায় ৩৬ টি দেশে পণ্য পরিবহনে দীর্ঘমেয়াদি চরম হতাশায় পড়বে। ২০২৪ সালেও ভারতের সড়ক পথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৩৬ টি দেশে ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার পণ্য পরিবহন করেছে। ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের এই সুবিধাগুলো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করে এখন নিজেরাই বিপদে পড়েছে। নিজের শিস্ম নিজ হাতে ধরেই কাঁদছে গজওয়া খাওয়া কোম্পানি ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজন।
চীন থেকে ব্যয়বহুল বিধায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করে। গার্মেন্টস শিল্পের অধিকাংশ সুতা পর্যন্ত ভারত থেকে আসে। ভারত থেকে জল আসা বন্ধ হলে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তার উপর আমেরিকার ৩৭ শতাংশ ভ্যাট যুক্ত হলে (যদিও আপাততঃ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র) খেতে না পেয়েই এই দেশে লক্ষ মানুষ মারা যাবে।
এজন্য কথায় আছে, "অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে দিনশেষে নিজেকেই পড়তে হয়।"
মূল লেখাঃ লুসিড ড্রিম (শুভ)
(সংযোজিত ও সম্পাদিত)