ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে এতো দ্বন্দ্ব কেনো

 
ইহুদিরাও মুসলমানদের মতো নামাজ পড়ে

ইহুদি জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ইহুদি জাতি বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতিগোষ্ঠী, যার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবদান গভীরভাবে মানব সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২০০০–১৭০০ অব্দ সময়কালে বিশ্বের প্রধান তিন ধর্ম- ইহুদি, খৃষ্টান ও ইসলাম ধর্মের পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম (Hebrew: Avraham)(আঃ) এর মাধ্যমে ইহুদি জাতির ইতিহাস শুরু হয়।

ইব্রাহীম(আঃ) মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের উর নগর থেকে ঈশ্বরের আদেশে কনানের (বর্তমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন অঞ্চল) দিকে যাত্রা করেন। ইহুদিদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ঈশ্বর তাঁকে ও তাঁর বংশধরদের কনান ভূমির প্রতিশ্রুতি দেন। আব্রাহামের পুত্র ইসহাক এবং পৌত্র ইয়াকুব, যাঁর নাম পরে হয় ইসরায়েল- এই জাতির ভিত্তি স্থাপন করেন এবং ইসরায়েলের নামানুসারেই বর্তমান ইজরাইল। ইয়াকুবের ১২ পুত্র থেকেই ইসরায়েলের বারো গোত্রের জন্ম হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০–১৩০০ অব্দে দুর্ভিক্ষের কারণে ইয়াকুব ও তাঁর পরিবার মিসরে যান এবং সময়ের পরিক্রমায় সেখানকার শাসকদের অধীনে দাসে পরিণত হন। দীর্ঘ দাসত্বের পর মুসা (হিব্রু: মোশে) নবীর নেতৃত্বে তারা মিসর থেকে মুক্তি পান। এই ঘটনাকে ইহুদি ইতিহাসে "এক্সোডাস" বলা হয়। সিনাই পর্বতে মোসা ঈশ্বরের কাছ থেকে দশটি আজ্ঞা (Ten Commandments) প্রাপ্ত হন, যা ইহুদি ধর্মের মূল নৈতিক ভিত্তি।

খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০–৯২২ এ চল্লিশ বছরের মরুভূমির যাত্রা শেষে ইহুদিরা অবশেষে প্রতিশ্রুত ভূমি কনানে প্রবেশ করে। প্রথমে তারা বিভিন্ন গোত্র হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেও পরে তারা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম রাজা ছিলেন শাউল, এরপর দাউদ (ডেভিড), যিনি জেরুজালেমকে রাজধানী করেন এবং তারপর সোলোমন (সুলায়মান), যিনি প্রথম মন্দির (First Temple) নির্মাণ করেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৯২২–৫৮৬ এ সোলায়মান(আঃ)-এর মৃত্যুর পর রাজ্য বিভক্ত হয়ে উত্তর ইসরায়েল ও দক্ষিণ যিহূদা নামে দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ সালে আশিরীয়রা উত্তর ইসরায়েল দখল করে নেয় এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে বাবিলোনীয়রা যিহূদা দখল করে ও প্রথম মন্দির ধ্বংস করে। ইহুদিদের একটি বড় অংশ তখন বাবিলনে নির্বাসিত হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮–৭০ অব্দে পারস্য সম্রাট কোরেশ বাবিলন দখল করে ইহুদিদের নিজভূমিতে ফিরতে অনুমতি দেন। তারা জেরুজালেমে ফিরে গিয়ে দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ করেন। এই সময় ইহুদি ধর্ম ও কাব্যগ্রন্থ  ‘তোরাহ’ চূড়ান্তরূপ লাভ করে। এরপর গ্রিক ও রোমান শাসনের অধীনে ইহুদিরা দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে।

খ্রিস্টাব্দ ৬৬–৭০ সালের দিকে ইহুদি বিদ্রোহের ফলে রোমানরা জেরুজালেম দখল করে দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস করে। এরপর ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে আরও একটি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা হয় এবং তারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে—এই ঘটনাকে ডায়াসপোরা বলা হয়।

মধ্যযুগে ইহদিরা উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস শুরু করে। কোথাও কোথাও তারা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করলেও মধ্যযুগে বহুবার গণহত্যা, বহিষ্কার ও নিপীড়নের শিকার হয়। স্পেনে ইনকুইজিশনের সময় বহু ইহুদি ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হন বা দেশত্যাগ করেন।

১৮ শতকের শেষ থেকে ইউরোপে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ছড়িয়ে পড়লেও ইহুদি-বিরোধীতা (অ্যান্টিসেমিটিজম) নতুনভাবে দেখা দেয়। ১৮৯৭ সালে থিওডর হার্জেল নেতৃত্বে জায়নবাদ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে যার লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানিতে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, যাকে হলোকাস্ট বলা হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বিশ্বব্যাপী সমর্থনে ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইসরায়েল আজ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তি, কৃষি ও প্রতিরক্ষা খাতে বিশ্বে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ১৫ মিলিয়ন ইহুদির মধ্যে অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলে বসবাস করেন। ইহুদি ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে তাদের অবদান বিস্ময় জাগায়।

ইহুদি জাতির ইতিহাস শুধু একটি ধর্ম বা জাতির কাহিনি নয়—এটি নিপীড়ন, প্রতিরোধ, সংস্কার ও আশা-ভরসার এক দীর্ঘ সংগ্রামময় যাত্রা। হাজার বছরের বিক্ষিপ্ততার পরেও তাদের ঐক্য ও সংস্কৃতি টিকে আছে, যা মানব ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

প্রশ্ন হলোঃ মুসলমানদের জাতির পিতা যেমন ইব্রাহীম(আঃ), ইহুদিদের জাতির পিতাও ইব্রাহীম(আঃ)। আমরা মুসলমানরা মনে করি ইব্রাহীম(আঃ), ইসহাক(আঃ), ইয়াকুব(আঃ) দাউদ(আঃ), মুসা(আঃ), সোলায়মান(আঃ) সবাই মুসলমান ছিলেন। তাঁদেরকে আমরা নবী হিসেবে মান্য করি। পবিত্র কোরআনে তাঁদের বর্ণনা এসেছে এবং তাদের সহ পূর্বের সকল ধর্মগ্রন্থকেও মান্য করতে বলা হয়েছে।

পবিত্র কোরানের সুরা বাকারা, আয়াত ৪ ও ৫ এ আল্লাহ বলেছেনঃ

“এবং তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল, যারা তদ্বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আখিরাতের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে(৪)। এরাই তাদের রবের পক্ষ হতে প্রাপ্ত হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং এরাই পূর্ণ সফলকাম(৫)।”

একই সুরার আয়াত নং ১২১ এ আল্লাহ বলেছেনঃ

“আমি যাদেরকে যে ধর্মগ্রন্থ দান করেছি তা যারা সঠিকভাবে সত্য বুঝে পাঠ করে তারাই এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী, এবং যে কেহ এটা অবিশ্বাস করে ফলতঃ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

তাহলে কেনো এতো কেনো এতো হিংসা বিদ্বেষ? ভিন্ন ধর্মচর্চা, ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ার কারণে? সে তো আমাদের মধ্যেও আছে। আমরা কেউ শিয়া, সুন্নী - কেউ ওহাবী, কেউ আহলে হাদীস ইত্যাদি শতশত মতবাদ রয়েছে। আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত কোরআন ছাড়াও এবং আমাদের প্রধান ৬টি হাদিসগ্রন্থ ছাড়াও আরও শতশত হাদিস, ফিকাহ’র বই আমরা অনুসরণ করি। এক ইসলাম ধর্মেই অসংখ্য মতবাদ, ব্যাখ্যা আছে। আমদের দেশেই একেক আলেমের ফতোয়া একেক রকম। এক আলেম আরেক আলেমকে “কাফের” ঘোষণা দেয়, আবার স্বার্থের প্রয়োজনে একই মঞ্চে উপবেশন করি।

এসব দ্বন্দ্বের অবসান হওয়া জরুরী। তবে বাস্তবতা হলো, তা কোনোদিন হবার নয়! কারণ কোরআনে ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্ব না করার আয়াতও আছে, যদিও সে আয়াতে একথা বলা নাই যে বন্ধুত্ব করলে দোজখে যেতে হবে। শুধু বলা আছে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করলে তাদের গোত্রীভূত হবে এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। কিন্তু আমরা আমাদের নিজ গোত্রের উপরে কি জুলুম কম করি? অথচ উপরে যে তিনটি আয়াত উদ্ধৃত করেছি তা অনুসরণ না করলে সোজা জাহান্নাম। তবুও আমরা ভালোটার চেয়ে মন্দটার চর্চাই বেশি করি। তবে স্বার্থের প্রয়োজনে বিধর্মীদের সাথেও দোস্তী করি, যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেনা, যেমন চীন কোরিয়া, জাপান। সেসব দেশের অর্ধেক লোক বৌদ্ধ ও খৃষ্টধর্মের অনুসারী। বাকি অর্ধেক বিধর্মী।

ইহুদিদের জামাতে নামাজ পড়ার দৃশ্য। দিনে ৩ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তারা




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url