পাকিস্তানে গ্রাম্য সালিশের রায়ে গণধর্ষণ

ফজলান বিবি

বেশিদিন আগের কথা না। বছর দশেক আগে (২০১৪ সালে) পাকিস্তানের মধ্যাঞ্চলের রাদিওয়ালি গ্রামের সালিশি বিচারে এক নারীকে গণধর্ষণের রায় দেয়া হয়। বিষয়টি অনেকেরই মনে থাকার কথা।তবুও বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় "জেনজি" প্রজন্মের জানার জন্য বিষয়টির পুনরাবৃত্তি।

সালিশি বিচারের রায়ে ৩০-৪০ জন লোকের দ্বারা ধর্ষনের শিকার হন রাদিওয়ালি গ্রামের ৩৫ বছরের ফজলান বিবি৷ তাও সেটা ফজলান বিবির নিজের অপরাধের জন্য না। 

জানা যায়, ফজলান বিবির ভাই একজন বিবাহিত নারীর সাথে প্রেম করেছিলো। সেই অপরাধের বিচারে শাস্তি হিসেবে ফজলান বিবিকে গণধর্ষণের নির্দেশ দেয় উপজাতীয় সমাজপতিরা। রায়ে বলা হয়, ভাইয়ের প্রেমিকের আত্মীয়রা তাকে গনধর্ষন করবে। (কি বর্বরতা!)

এই ঘটনায় পাকিস্তানের নারী আন্দোলনের অন্যতম পুরধা "মুখতারান বিবি (মুখতারান মাই)"- যিনি অনুরূপ ধর্ষনের শিকার হয়েছিলেন, তিনি ফজলান বিবির সাথে দেখা করতে গেলে বাড়ির কাছে পৌঁছানোর পর তাঁকে আটকে দেয়া হয় এবং জোর করে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়৷


মুখতারান মাঈ প্রসঙ্গ

মুখতার রান মাঈ

পাকিস্তানের নির্যাতিত নারীর প্রতীক মুখতারান মাই ২০০২ সালে গণধর্ষণের শিকার হন৷ তিনিও একই কারণে ধর্ষিতা হয়েছিলেন৷ তবে তাঁর গণধর্ষণ মামলার রায়ে ছয় আসামীর সাজা হয়, যদিও পরে পাঁচজনকে খালাস দেয় পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট৷ 


মুখতারান মাঈ ধর্ষণের ঘটনা 

মাঈ এর জন্ম পাকিস্তানের মুজাফফরগড় জেলার মীরওয়ালা গ্রামে। স্থানীয় উপজাতীয় বিবাদ ও উপজাতীয়দের পঞ্চায়েতের আদেশে মুখতারান গণধর্ষণের শিকার হন। 

মাঈয়ের ১২ বছরের ভাই আবদুল শাকুরকে মাস্তোই উপজাতির ৩ ব্যক্তি অপহরণ করে একটি আখ ক্ষেতে নিয়ে গণধর্ষণ (বলাৎকার) করে। শাকুরকে ঘটনাটি কাউকে না বলার জন্য বলা হলে সে অস্বীকৃতি জানায়। ফল স্বরূপ তাকে মাস্তোই আবদুল খালিকের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। পুলিশ তদন্তে এলে খালিকের বোন সালমা নাসিনের সাথে ১২ বছরের শাকুরের সম্পর্কের অভিযোগ করা হয়। শাকুরকে ব্যভিচারের অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, যদিও পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

ঘটনাটি পুনঃতদন্তে পরবর্তী বিচারে শাকুরের বলাৎকারকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

অপরদিকে নাসিনের সাথে শাকুরের কথিত সম্পর্কের  কারণে মাস্তোই উপজাতি কাউন্সিল  আলাদাভাবে মিটিং করে। তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, শাকুরের সাথে নাসীনকে বিয়ে দেয়া উচিত এবং মাঈয়ের (মাঈরা গুজার উপজাতির) একজন মস্তোইয়ের সাথে বিয়ে করা উচিত। কিন্তু "ব্যভিচারীকে অবশ্যই ব্যভিচারের শাস্তি পেতে হবে" এই অজুহাতে গ্রামবাসীরা এই রায় প্রত্যাখ্যান করে এবং মাঈকে তার ভাইয়ের কর্মের জন্য কাউন্সিলের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। 

মাঈ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাকে একটি  কুঁড়ে ঘরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৪ জন মাস্তোই পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে তাকে গণধর্ষণ করে, যা আরও ১০ জন লোক দেখেছিল। ধর্ষণের পর তাঁকে উলঙ্গ করে পুরো গ্রাম ঘুরানো হয়। ঘটনাটি পরে আদালতে গড়ায়।

"মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। অবশেষে পাকিস্তানের আদালতের রায়ে মুখতারান বিবিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। সেই অর্থে তিনি "মুখতার মাই নারী কল্যাণ সংস্থা" নামে একটি শিক্ষা ও আশ্রায়ন  সংস্থা গড়ে তোলেন।"

"২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে মুখতারান বিবি ইউরোপীয় ইউনিয়নের "কাউন্সিল অফ ইউরোপ" হতে "নর্থ সাউথ পুরস্কার" লাভ করেন। ২০০৫ সালে গ্ল্যামার ম্যাগাজিন তাকে "গ্লামার উইমেন অফ দি ইয়ার" বা বর্ষসেরা নারী হিসাবে নির্বাচিত করে।"

"নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুসারে তার জীবনী ফ্রান্সে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় ৩য় স্থানে রয়েছে।"

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে সেই দুশ্চিন্তা থেকেই এই ঘটনা দুটির অবতারণা। আশাকরি এ থেকে দেশবাসী তথা "জেনজি" প্রজন্ম কিছুটা হলেও শিক্ষা নেবে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও ডিডব্লিউ অনলাইন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url