সাত মার্চ ১৯৭১ - স্মৃতিচারণ: মোস্তফা কামাল আখতার

 

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

"সেদিনের অতি নগণ্য, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশিদার ছিলাম...


লেখালেখিতে পারদর্শী নই, কৈশোরের মনের জমানো কথাগুলো হয়ত গুছিয়ে লিখতে পারবো না, তারওপর স্মরণ শক্তির উপর নির্ভর করে লেখা বড় কঠিন!


আমার গর্ব, একবুক অহঙ্কারের স্মৃতি—

সাতই মার্চের আমি এক প্রত্যক্ষদর্শী কিশোর!


হয়তো এটা কারো কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করবে না, কিন্তু আমার জীবনের এ এক পরম অর্জন, হৃদয় গভীরে তা লালন করে চলেছি। অসম্ভব সৌভাগ্যবান মনে করি নিজেকে,  আমার বেড়ে ওঠার সময়টাকে।


দুর্লভপ্রাপ্ত জীবন, যা অনেকে অনেক তিতিক্ষায়ও পাওয়া যায় না! সেইদিনটিকে স্মরণে-মননে লালন করি নিরন্তর।


চাকরি থেকে ইস্তেফা দিয়ে বাবা 'কন্ট্রাক্টরি' ব্যবসার শুরুতেই হোঁচট খেলেন। ভালো মত জমাতে না পেরে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের 'এমইএস' এ কিছু 'কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক' পেয়ে সত্তুরের প্রথম দিকে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।


জীবনে প্রথম ঢাকা দর্শন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করা ছাত্র— ক্লাস করা শুরু করেছিলাম 'কচুক্ষেত হাই ইস্কুলে'।


চট্টগ্রামের আবাস ছেড়ে  বাবার কর্মস্থলে আমরা।স্কুলবন্ধদের ছেড়ে আসতে কান্না করেছি; পাড়ার খেলার সাথী, সহপাঠীদের জন্যে হয়েছিল মন খারাপ।রেলগাড়ি করে সাপাকৃতির মাথার স্টেশান 'কমলাপুর' এ নেমে কালো রঙের মিটার টেক্সিকরে ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষত বাজারে নেমেছিলাম।


বাবার মুখে কচু ক্ষেত শুনে আজব বনেছিলাম- কচুক্ষেতে আবার মানুষ থাকে কী ভাবে? পৌছানোর পর দেখলাম কোথাও কচুক্ষেতের বালাই নেই, যা রয়েছে তা হল রাস্তার ডান দিকে বিশাল দালানের আদমজী কলেজ, বামদিকে বাজার এবং বাজারের দোকানপাট সব পানিতে তলানো (জায়গাটা বর্ষার পানিতে ডুবে থাকে), কোনও রাস্তা বলতে কিছুই নেই! বাবা মালপত্র দুইটি কোষা ঢিঙগিতে তুলে আমাদেরকে নিয়ে উঠলেন এক ভাড়া বাড়ির তিন তলায়, বাড়িটারও নিচের তলা পানিতে তলানো।


বাবা তার কন্সট্রাকশন কাজে সর্বক্ষণ বাসার বাইরে থাকেন, আমি বড়ছেলে— বাজার-সদাই, ঘর-বাইর সামলানোর দ্বায়িত্ব পেয়ে এক সর্বেসর্বা স্বাধীন কিশোর! কচুক্ষেত এলাকার সর্বত্র বিচরণক্ষেত্র। তখন পুরোদেশ উত্তাল, উত্তপ্ত রাজনৈতিক ডামাডোল...


ভোটের হাওয়া দিগ্বিদিক। চারিদিকে নৌকা, নৌকা মার্কার পোস্টার ছেয়ে অাছে! তুলনামূলক দ্রব্যমূল্য পাকিস্তানের দুই প্রদেশের তারতম্যের একটি বড় পোস্টার সবার দৃষ্টি কাড়ত! দিবারাত্র গগন বিদারী শ্লোগান, মিছিল। মিছিল এত্তো লম্বা হতো, ঠাহর করা যেত না এর শুরু কোথায় শেষ কোথায়!


মনে আছে ওই সময়ের ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা।


নির্বাচনে নৌকা মার্কা জিতে এল।


"পদ্মা মেঘনা য়মুনা

তোমার আমার ঠিকানা''


"তোমার নেতা আমার নেতা

শেখ মুজিব, শেখ মুজিব"


শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত, ইস্কুলে লেখাপড়ার চেয়ে সারা দিন টই টই করে বেড়ানোই আমার প্রিয় হয়। সবার চোখেমুখে আশ্চর্য নৌকা-আবেগ লক্ষ্য করতাম। ইস্কুল এ্যাসেমব্লিতে পাক সার জমিন বদলে বন্দে আলি মিয়ার পূর্ব বাংলা শ্যামলীমায়'। এ পরিস্থিতিতেই বাৎসরিক পরীক্ষা দিয়ে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম।


বাঁধাধরা ছক জীবন এলোমেলো। ইস্কুল হয় কি হয় না! দিনকেদিন মানুষজন রাস্তায়, সর্বত্র কিরকম এক অস্থিরতা।সবার মধ্যে বজ্র-কঠিন চেহারা। শুধুমাত্র রেডিও খবরের কাগজেই মানুষের প্রবল আগ্রহ।বুঝতেছিলাম পুরোদেশ কী এক আক্রোশে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে; একমাত্র বঙ্গবন্ধুই দেশের প্রাণ শক্তি। তাঁর কথায় দেশ চলছে।চলছে অসহযোগ।প্রতিদিন সকালে নুতন খবর। কোথায় কোথায় গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে, তা বাবার মুখে শোনা, বাজারের দোকানপাটে মানুষজনের মুখে-মুখে! বাবা খুবই অস্থির, গম্ভীর  চিন্তাক্লিষ্ট  হয়ে থাকতেন। কন্সট্রাকশন সাইট বন্ধ, বিল বন্ধ,

তাঁর টাকা-পয়সার টানাটানি।ধারদেনা, কর্জের ওপর পরিবার চালাতে তার বেহালদশা!


মানুষের টানটান উত্তেজনা, শ্বাসরুদ্ধ সময়!  নিত্য নুতন মোড় নিচ্ছে— কী সব 

আলোচনা চলছে, ভূট্টো-ইয়াহিয়া, হোটেল ইন্টারকন্টিন্যান্টালে... মিটিং-মিটিং! জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ... রাতেও মশাল মিছিল! নির্ঘুম, ক্লান্তিহীন মানুষ...!


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স মাঠে দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেবেন...


আমি কিশোরের কাছে সেটার কোনো তাৎপর্য ছিল না; কিন্তু সেইদিবসপ্রাতে আমি বুঝতে পারলাম না, কী এক মহা বিস্ময় আমার সামনে অপেক্ষা করছিল! সকালে মুদি দোকানে সদাই কিনতে গিয়েই তাজ্জব বনে গেলাম! পাড়া, মহল্লা,  বাজারের প্রত্যেক অলিগলি, সড়ক,

আদমজী কলেজের সামনের প্রধান রাস্তা জনস্রোতে পরিণত হয়েছে। বাসায় বাজারটা দিয়েই প্রবল ঔৎসুক্যে বের হয়ে পড়ি, ঘরের কাউকে কিছু না বলেই। তখনও জানতাম না— আমার কৈশোরজীবনে এক মহাকালের স্বাক্ষি হতে চলেছিলাম।


বাজারের মধ্যেই কূলকিনারা হারালাম!বিশাল স্রোতস্বিনী মানব নদীতে কচুরিপানার মত ভেসে গিয়েছিলাম! কোথায় যাচ্ছি, কোনদিকে যাচ্ছি, কিছুই  বোঝার ক্ষমতা রইল না!


রাস্তায় শ্লোগানের কর্ণবিদারী আওয়াজ। আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ, শুধু এগিয়ে চলা। চলতে চলতেই দেখলাম ঢাকা শহরের সকল রাস্তা যেন এক গন্তব্য— রেসকোর্স ময়দান! মাইলের পর মাইল শুধু মাইক লাগানো, উদ্দীপনামূলক গান, বক্তৃতা কানে আসছে, কাছাকাছি পৌছে গেছি, তবে এতোটা কাছে নয়! লোকারণ্য বললে ভুল

হবে; যেন মানব সমুদ্র! আমি দিগ্বিদিকহারা! বহুদূরে থেকে শুধু মঞ্চটিই নজরে আসছে।মানুষের ধাক্কা-ঠেলায় এদিক সেদিক হচ্ছি। শ্লোগান-গর্জনে সময় পার হচ্ছিল। বজ্রমুষ্টি উর্ধে ছোঁড়া মানুষ, কারো হাতে লাঠি। খিদে- পিপাসা কাতর, অভুক্ত আমি পকেটের দুুই আনা খরচা করে মালাই আইসক্রিম খেয়েছি।


অবশেষে আসলেন 

বাঙালির অবিসংবাদী নেতা, সাতকোটি বাঙালির প্রাণস্পন্দন।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বাঙালি জাতির  স্বাধীকার সনদ দিতে তর্জনী উচিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করতে তিনি মঞ্চে এলেন।


দিয়ে গেলেন অমর বাণী— 


আমি যদি হুকুম দেবার না ও পারি...


তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবা...


এবারের সংগ্রাম

আমাদের মুক্তির সংগ্রাম


এবারের সংগ্রমাম

আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম


জয় বাংলা।


তখন আমার রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকলেও কীভাবে যেন আমার ভেতর-  আত্মায় প্রথিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের শত্রু! তারা আমাদের ওপর গুলি চালায়।

-----

এরপর আমার পিতা তাঁর কোন বোধশক্তি বলে হঠাৎ মার্চের দশ কি এগার তারিখে ঢাকার তল্পিতল্পা গুটিয়ে সপরিবারে চট্টগ্রামের ট্রেন ধরলেন। আর আমি একবুক দুঃখ, অশ্রুপাতে কচুক্ষেত পাড়ামহল্লা বন্ধুদের, ইস্কুল সহপাঠীদের দ্বিতীয়বার চিরজনমের বিদায় জানালাম।


পিতার মুখে পরে শুনেছিলাম; ২৫ মার্চের কালরাত্রে কচুক্ষেত বাজার ও তার আশপাশের এলাকা, বাসা-বাড়িঘর, দোকানপাট অবাঙালি-বিহারি ও ক্যান্টনমেন্টের  পাক-আর্মিরা ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছিল।"


লিখেছেন: মোস্তফা কামাল আখতার

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url