মুক্তিযুদ্ধে বেগম সুফিয়া কামালের ভূমিকা

 

বেগম সুফিয়া কামাল


ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বার রোডের প্রায় শেষ মাথায় গাছপালায় ঘেরা ‘সাঁঝের মায়া’ নামের একটা বাড়িতে বসবাস করতেন কবি সুফিয়া কামাল। রোজ ভোরে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কোরান পাঠ করতেন কবি। তারপর বাগানে হাঁটাহাঁটি আরও কিছুক্ষণ। এই সময় পোষা বিড়ালগুলো কবির পায়ে পায়ে ঘুরতো। তুলার বলের মতো ধবধবে সাদা বিড়ালগুলোকে সাথে নিয়েই কবি এসে তারপর বারান্দায় বসে একের পর এক রবীন্দ্র সংগীত শুনতেন। কখনও কখনও অতুল প্রসাদ কিংবা রজনীকান্তের গান।

 

অনেক অনেক দিন আগে কবির এই রুটিন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। বলা ভালো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিলো। নিত্যদিনের রুটিন ভুলে একটু বেলা হলে পরে একগাদা রেশনকার্ড হাতে নিয়ে কবি বাগানে অস্থির হয়ে পায়চারি করতেন। একগাদা রেশন কার্ডের মধ্যে কবির কার্ড একটাই। বাকিগুলো প্রতিবেশীদের, আত্মীয়দের আর স্বজনের। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঢাকা ছেড়ে তারা চলে যাবার আগে কবির কাছে এইসব কার্ড তারা রেখে গেছেন। কবি একেক দিন একেকজনকে দিয়ে সেইসব রেশন কার্ড দিয়ে চাল, চিনি, ডালডা তুলে এনে বাড়ির এক নিরিবিলি রুমে এইসব জমা করতেন। আর অপেক্ষা করতেন একজন রিকশা ড্রাইভারের জন্য। কবির বাড়ির পাশের বাড়িতে ছিলো পাকিস্তানি মিলিটারির ঘাঁটি। সব চোখ ফাঁকি দিয়ে কবির বাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে জীবন বাজি রেখে রিকশা ড্রাইভার এসে চালের বস্তা, চিনির পোটলা, ডালডার টিন নিয়ে যেতো।

 

আগস্ট মাসের পর থেকে শহর আরও থমথমে হয়ে গেলে রিকশা ড্রাইভারের চলাচল খুব কঠিন হয়ে গেল। এই নিয়ে কবির দুশ্চিন্তার শেষ নাই। কবির বাড়ির পেছনেই ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের কালচারাল সেন্টার। একদিন সোভিয়েত কনসাল মি. নভিকভ নিজে কবির বাড়ি এসে কবিকে আশ্বস্ত করে গেলেন। এরপর সোভিয়েত কালচারাল সেন্টারের গেট ব্যবহার করে রিকশা ড্রাইভার মালামাল নিয়ে যেতো।

 

তারপর হিমালয়ের জমাট বাঁধা বরফ গলে গলে আমাদের পদ্মা মেঘনা যমুনা নরসুন্দা ঘোড়াউত্রা বলেশ্বর আর ধানসিঁড়ি নদীগুলো জলে জলে পূর্ণ হয়ে উঠলো। আর জলের সাথে একজন না দুইজন না, এক লাখ না দুই লাখ না, তিরিশ লাখ মানুষের রক্ত এসে আমাদের জলের রঙ বদলে দিতে দিতে ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ এসে উপস্থিত হলো। লিস্ট ধরে ধরে রাজাকারেরা শহীদুল্লাহ্ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক শিক্ষক সহ দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীদের কাদা মাখানো বিশেষ এক গাড়িতে করে প্রথমে নিয়ে গেল ফিজিক্যাল কলেজের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। তারপর তারপর তারপর তাঁদেরকে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম রায়ের বাজারে!!!

 

চৌদ্দ তারিখে কবির সেই রিকশা ড্রাইভারকেও তুলে নেয়া হয়েছিলো কাদা ল্যাপ্টানো গাড়িতে!!! রিকশা ড্রাইভারের নাম গিয়াসউদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং মুহসিন হলের আবাসিক শিক্ষক। পুরো নয় মাস ধরে তিনি মাথায় গামছা বাঁধা লুঙ্গি পরা রিকশা ড্রাইভারের ছদ্মবেশে রিকশা চালিয়ে কবির বাড়ির রেশনের মালামাল পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের নানান গোপন ইউনিটে।

 

কী বলবো?

কীভাবে বলবো? কীভাবে এক জীবনে আমরা তাঁদের ঋণ শোধ করবো?

মাথা নত করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই ‘জননী সাহসিকা’ কবি সুফিয়া কামালের প্রতি।

 

(সংগৃহীত)


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url