মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় স্বাধীনতার টানেঃ মোস্তফা কামাল আখতার

 
লেখকঃ মোস্তফা কামাল আখতার

ঠ্যেরো।

না থেমে সাইকেলটাতে একটু জোরে প্যাডেল চেপে এগিয়ে গেলাম। ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে আরোও জোরে বলল;

ঠ্যারো!

নির্জন মধ্য দুপুরের রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। দু'একটা সিটি বাস মৃদু গতিতে চলে যাচ্ছে। দুর থেকেই দেখেছি নেভাল বেইসের মূল গেইটের সামনে একটা জিপের পাশে জনাকয়েক পাক আর্মি দাড়িয়েছিল। নেভাল বেইজের মূল গেটে সাদা নেভি ইউনিফর্মে ৩ জন সেন্ট্রি চায়না রাইফেল হাতে দাঁড়ানো। সামনে আর আগাবো না চিন্তা করেও শেষতক তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলাম। আর হুংকারটা শুনলাম; ঠ্যারো!

থামলাম।

ঘাড় বেঁকিয়ে পিছনে দেখলাম, হাতের ইশারায় ওরা আমাকে কাছে ডাকছে। সাইকেলটা ঘুরিয়ে -পিছিয়ে আর্মির সামনে দাড়ালাম।

--তুম ঠ্যারা ক্যয়ুঁ ন্যাহি? প্রশ্ন করলো।

মাত্র হাই ইস্কুলের ছাত্র--- চলিত ভাষা বা চাটগাঁইয়া বলতে পারি, কিন্ত উর্দু বলতে তো পারিনা। তবে একটু আধটু বুঝতে পারি, এটা বুঝলাম।

-আমি শুনা নেই, অস্ফুট স্বরে বললাম।

ধাই করে থাপ্পড়। কিছু বুঝে উঠার আগে প্রচন্ড জোরে লাথি। সাইকেলটাসহ আমি উল্টে পড়ে গেলাম। কোনো মতে উঠে দাঁড়ালাম; সাইকেলটা পড়ে রইলো রাস্তায়।

--ডান্ডিকার্ড নিকালো (আইডি কার্ড দেখাও)

-নাই

পাশের অন্যজন বামদিকে থেকে লাথিটা দিল। ব্যাথায় কুঁচকে আর দাঁড়াতে না পেরে বসে গেলাম রাস্তায়।

--ফেলাগ কেউ নেহি লাগায়া?

২৫ মার্চের পর চিটাগাং এ পাকিস্তানি পতাকা পকেটে, শার্টের হাতায় লাগিয়ে চলাফেরা করতে হতো- আর্মি অর্ডার। আমার কাছে তা ছিল না। সে জন্য এই প্রশ্ন; আমি নিশ্চুপ।

--শালাকো গোলি মারকে দরিয়ামে ফেক দো; একজন মন্তব্য করল।

নেভাল বেইজের সামনেই কর্ণফুলি নদী। ভীষণ ভয়ে আমার ভেতরটা কাঁপছে। আমার মুখে কোনো কথা আসছে না। মনেহলো নির্বাক থাকলে তারা কম আঘাত করবে। ওরা নিজেরা নিজেরা কী যেন বলাবলি করল। তবে উর্দুতে নয়। 

একজন আমাকে শার্টের কলার ধরে টেনে-হিঁচড়ে নেভাল সেন্ট্রি-কোয়ার্টারে নিয়ে গেল। সাইকেলটা পড়ে রইল রাস্তায়। আমাকে শেষের রুমটিতে ঢুকিয়ে বাহির দিকে সিটকিনি দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। কক্ষটিতে দু'টো বিছানা পাতা রয়েছে। কেমন বিদঘুটে গন্ধ আসছে বিছানাগুলো থেকে। কুঁচকে, কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে পড়লাম কোণের দিকে।

তারপর অনেক্ষণ... অনেক সময়... পার হলো, আমার সারা শরীরে ব্যাথা; সাথে যোগ হলো খিদে। বেলা গড়িয়ে আস্তে আস্তে চারিদিকে ছায়া নেমে আসছে। এক সময় খিদেটা চলে গেলো।

কেউ কিছু বলছে না, দু'একজন দরজা ঠেলে আমাকে দেখে যাচ্ছে খানিক পর পর।

হঠাৎ করে কয়েক জোড়া বুট জুতার শব্দ শুনলাম। জোরে দরজাটা খুলে সাদা-ড্রেস পরা এক নেভাল আমার দিকে এগিয়ে আসছে। পেছনে পূর্বের দেখা নেভিগুলো। নতুন আগত বয়স্ক লোকটি লম্বা-চওড়া কালো রঙের। মুখে সুন্দর চাপ দাড়ি।

আশা জাগলো; এবার বোধহয় রেহাই মিলবে। সামনে এসে দাঁড়ালো সবাই। আমিও বসা হ'তে উঠে দাঁড়াতে গেলাম। কোন কথা না বলে 'চাপ-দাড়ি' সজোরে মারলো; বুটদিয়ে লাথি।

এই প্রথম স্বশব্দে কান্না করলাম -খটখটে শুকনা গলাদিয়ে আওয়াজ বের হলো না।

-হামকো একটু পানি। কিন্তু কেউ শুনলো বা বুঝলো বলে মনে হলো না। উচ্চস্বরে বিজাতীয় হাসিতে ফেটে পড়ল। কী-কী নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে যেমন এসেছিলো, তেমনি আবার দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলো। দম বন্ধ করা সময়, ভোতা অনুভূতি!

অন্ধকার হয়ে আসছে... চারিদিকে কেমন আলো-ছায়া। হঠাৎ কেমন যেন শিরশিরে ভয়ানুভূতি পেয়ে বসলো আমাকে! অভুক্ত শরীরে সহ্যক্ষমতা হরিয়ে ফেলেছি। কী হবে আমার? সময় স্থির! ফুসফুস যেন বাতাস পাচ্ছে না। এক সময় বাহিরে জটলার শব্দ, হাল্কা কথা-বার্তা কানে এলো। সজাগ হলাম--- কচমচ জুতার আওয়াজ আমার কক্ষের দরজায়।

লম্বা সাদা ইউনিফর্মের নেভাল। শার্টের গুটানো আস্তিনে বড় করে এমপি লেখা। আমাকে টেনে তুলল।

--চ্চলো।

বাইরে বের করে রাস্তায় আনলো সে। এলোমেলো পায়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি। রাস্তায় অন্ধকার জমে উঠছে। পিঠের পিছনে জোরে ধাক্কা দিয়ে নেভির এমপি লেখা লোকটি বললো, --যা, ভাগ যাহ্, সালে।

সামনে এগুচ্ছি, সামনে...। আমি এখন এক মুক্তি পাগল প্রাণ। মনে পড়লো, আরে, আমার সাইকেলটা?

-ধুত্তর সাইকেল।

সামনে চল...

মন শক্ত করে মুক্তি আকাঙ্খায় এগিয়ে চললাম সামনে---

স্বাধীনতার-টানে।

@মোস্তফা কামাল আখতার 

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url