ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের পবিত্র ও শিক্ষনীয় দিক



দোরাবজি টাটা ও মেহেরবাঈ 


ভালোবাসা দিবস নিয়ে আমরা শুধু দোষ ও পশ্চিমা সাংস্কৃতির গন্ধ খুঁজি। ভালোবাসা দিবসের সাথে যে পবিত্রতা ও ধর্মীয় অনুভূতি লুকায়িত তা আমরা অনেকে জানিও না। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই আসল ভালবাসার নিদর্শনের কথা।

 

ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পটি শুরু হয় অত্যাচারী রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এবং খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কেন্দ্র করে, যা আমরা অনেকেই জানি। তবুও মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে কিঞ্চিৎ আলোচনা।

 

গতকাল (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) এক ভিডিওতে এক মৌলবী সাহেবের ওয়াজ শুনলাম। ওয়াজে তিনি ভ্যালেন্টাইন ডে এবং এর চিহ্ন নিয়ে বিকৃত ও অরুচিকর ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, ভ্যালেন্টাইন চিহ্নটা নাকি মেয়েদের যৌনাঙ্গ এবং এর মধ্যকার চিহ্নটা নাকি পুরুষদের যৌনাঙ্গ। কি ভয়াবহ অশিক্ষা-কুশিক্ষায় ভরে গেছে সমাজ, তা একটি ওয়াজ থেকেই প্রমাণিত। অথচ ভ্যালেন্টাইন ডে এসেছিলো এক ধর্মগুরু ও শিক্ষক এবং তার ছাত্রীর পবিত্র ভালোবাসা এবং ধর্ম ও শ্রষ্টার প্রতি অগাদ বিশ্বাসের নিদর্শণ থেকে। একটু জেনে নেয়া যাক।

 

তৃতীয় শতকে সম্রাট ক্লাডিয়াস সমগ্র রোমানবাসীকে ১২জন দেব-দেবীর আরাধনা করার নির্দেশ দেন। সেসময় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা ছিলো কাঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি খ্রিস্টানদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।

অপরদিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নাম্মী এক ব্যক্তি ছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। মৃত্য ভয় উপেক্ষা করেও তিনি খ্রিস্টধর্ম পালনে পিছপা হননি। ফলে সম্রাট ক্লাডিয়াস তাকে কারাগারে বন্দি করেন।

তিনি যে কারাগারে বন্দি ছিলেন সেখানকার কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনের প্রজ্ঞা দেখে মুগ্ধ হন। কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনকে জানান, ‘তার মেয়ে জুলিয়া জন্মগতভাবেই অন্ধ, তিনি তার মেয়েকে একটু পড়ালেখা করাতে পারবেন কিনা।

 

জুলিয়া চোখে দেখতে না পেলেও ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী। ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে রোমের ইতিহাস পড়ে শোনাতেন, পাটিগণিত শেখাতেন। মুখে মুখে প্রকৃতির বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতেন ও ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত বলতেন। জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনের চোখে দেখতে পেতেন অদেখা পৃথিবী। তিনি ভ্যালেন্টাইনের জ্ঞানকে বিশ্বাস করতেন এবং তার কথায় অনুপ্রাণিত হতেন।


একদিন জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করেনঃ
-    ভ্যালেন্টাইন, সতিই কি ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন?
-    হ্যাঁ, তিনি সবই শোনেন।
-    জানো, রোজ সকাল আর রাতে আমি প্রার্থনা করি, যদি আমি দেখতে পেতাম। তোমার মুখ থেকে আমি যা যা দেখেছি তার সবই আামি দেখতে চাই।
-    আমরা যদি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, তাহলে তিনি আমাদের জন্য যা ভালো তার সবই করেন। উত্তর দেন ভ্যালেন্টাইন।

এভাবে প্রার্থনা করতে করতে একদিন জুলিয়া ঠিকই তার দৃষ্টি ফিরে পেলেন। কিন্তু সময় ঘনিয়ে এলো ভ্যালেন্টাইনের। ক্লাডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য করলেন। দিনটি ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ অব্দ।


মৃত্যুর আগের দিন ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির শেষে লেখা ছিলো, ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু কার্যকর হয় ও তাকে বর্তমান রোমের প্রক্সিদেস গির্জার স্থলে সমাহিত করা হয়।

কথিত আছে, ভ্যালেন্টাইনের কবরের কাছে জুলিয়া একটি গোলাপি ফুলে ভরা আমন্ড গাছ লাগান। সেখান থেকে আমন্ড গাছ স্থায়ী প্রেম ও বন্ধুত্বের প্রতীক।
 
পরবর্তীতে ৪৯৬ অব্দে খৃষ্টধর্মের তৎকালিন প্রধান গুরু পোপ প্রথম জেলাসিউস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভ্যালেন্টাইন ডে-তে প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়াও বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে বিনিময় হয় প্রেম, স্নেহ ও ভক্তি।

যে ঘটনা বলতে উপরে ভালবাসা দিবস সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনাঃ

১৮৯৮ সালে ভালোবাসা দিবসে বিয়ে হয় ভারতের টাটা কোম্পানির তৎকালিন কর্ণধার দোরাবজি টাটা এবং মেহেরবাঈ এর। বিয়ের দু’বছর পর বিয়েবার্ষিকীতে দোরাবজি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে একটি হিরে উপহার দেন। সেই হিরেটি আকারে বিশ্ব বিখ্যাত কোহিনুর হীরের চেয়েও দ্বিগুণ বড় ছিল। ২৪৫ ক্যারটের সেই হীরের বর্তমান বাংলাদেশি টাকায় দাম ২০০ কোটি টাকারও বেশি। স্বামীর কাছ থেকে এই উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন মেহেরবাঈ টাটা।

 

তবে আশ্চর্যজনক ঘটনা হল এই হিরেটি না থাকলে আজ হয়তো ভারতবর্ষের বুকে টাটা কোম্পানির কোন অস্তিত্বই থাকতো না। আমরা হয়তো রতন টাটার মত শিল্পপতিকেও দেখতে পেতাম না।

 

মেহেরবাঈ ছিলেন খুবই সুন্দরী একজন নারী। তার মানসিকতা, চাল-চলনে ছিলো রাজকীয় ভাব। ভারতীয় শাড়ি পরেই তিনি পৃথিবীর সব অনুষ্ঠানে পৌঁছে যেতেন। তিনি খুব ভালো টেনিস  খেলতেন। ঘোড় সওয়ার থেকে গাড়ি চালানো সব কিছুতেই তিনি ছিলেন দক্ষ। ভারতীয় মহিলাদের অধিকার নিয়ে তিনি অনেক ভাবতেন।

 

টাটা গ্রুপের ব্যবসা সেই সময় রমরমা। ইস্পাত শিল্পের এক নম্বর শিরোপা তখন একমাত্র টাটা কোম্পানির দখলে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর টাটা গ্রুপের অবস্থা খারাপের দিকে যায়। দোরাবজি টাটার কাছে তখন শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দেয়ার টাকাও ছিল না। টাটা গ্রুপ প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল।

 

এই দুঃসময়ে স্বামীর পাশে দাঁড়ান মেহেরবাঈ টাটা। উপহার হিসেবে পাওয়া তার সেই দামি হীরেসহ প্রচুর গহনা বন্ধক দেবার অনুরোধ জানান তার স্বামীকে। প্রথমে রাজি না হলেও গরিব শ্রমিকদের কথা ভেবে তিনি তার স্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং সেই সময় দামি হিরে এবং সমস্ত গহনা বন্ধক দিয়ে এক কোটি টাকা লোন পেয়েছিলেন দোরাবজি টাটা। সেই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের সমস্ত পারিশ্রমিক মিটিয়ে আবার নতুন করে শুরু করলেন টাটার ইস্পাত কারখানা। কয়েক দিনের মধ্যেই আবার রমরমা হয়ে উঠলো টাটা গ্রুপের ব্যবসা। দোরাবজি টাটা কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাংকের লোন মিটিয়ে তার স্ত্রীর হিরেসহ সমস্ত গহনা এনে তার হাতে তুলে দিলেন।

 

কিন্তু ১৯৩১ সালে মেহেরবাঈ টাটার হঠাৎ শরীরে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়লো। দেশ বিদেশের অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েও এই রোগ থেকে তার স্ত্রীকে সুস্থ করতে পারেননি দোরাবজি। অবশেষে এক নার্সিংহোমে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মেহেরবাঈ। দোরাবজি টাটা তার স্ত্রীর মৃত্যুশোক সইতে না পেরে ১৯৩২ সালে ৩রা জুন তিনিও মারা যান। মারা যাওয়ার আগে ভারতবর্ষের বুকে তিনি স্ত্রীর স্মরণে তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন ভালোবাসার এক নিদর্শণ।

 

তার স্ত্রীকে ক্যান্সার যন্ত্রণায় তিলে তিলে শেষ হতে দেখেছিলেন দোরাবজি। তখন ভারতবর্ষের বুকে ক্যান্সারের কোন চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল না। যার জন্য মারা যেতো কান্সার আক্রান্ত বহু গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ। তাই সাধারণ ভারতবাসীর কথা ভেবে স্ত্রী মেহেরবাঈএর সেই বহু মূল্য হিরেটা বিক্রি করে বানিয়েছিলেন ‘টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল’ এবং ‘লেডি টাটা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’।

 

প্রতিবছর এই হাসপাতালে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে আসেন। তার মধ্যে প্রায় ৭০% ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয়। বছরের প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর ফলোআপ চিকিৎসা চলে এখানে। প্রতিমাসে কয়েক হাজার শিশু ক্যান্সার রোগী সুস্থ হয় এই হাসপাতাল থেকে।

 

শুধু ভারতবর্ষ নয়, বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ চিকিৎসা করাতে আসেন টাটা মেডিকেল সেন্টারের বিভিন্ন শাখায়। বাংলাদেশের মানুষও জানেন, ভারতে এই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ক্যান্সারের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয়।

 

তাজমহলকে আমরা ভালোবাসার নিদর্শণ হিসেবে জানি। সেই তাজমহল তৈরির পর শাহজাহান শ্রমিকদের আঙুল কেটে দিয়েছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে তাজমহলের মত আর কোন স্থাপত্য তৈরি না হয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে দোরাবজি টাটা বলে গিয়েছিলেন, সারা দেশ জুড়ে যেন অজস্র হাসপাতাল তৈরি হয়, যাতে ভারতবর্ষের সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষরা ভালো ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে পারেন।

 

ভারতের মুম্বাই, কলকাতা সহ ভুবনেশ্বর, বারানসি, তিরুপতি, রাঁচি, উত্তর প্রদেশ ইত্যাদি জায়গাতেও গড়ে উঠেছে টাটা মেডিকেল সেন্টার। ভারত সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে তেলেঙ্গানা, আসাম, ওড়িশা, নাগাল্যান্ড প্রভৃতি জায়গাগুলিতে ক্যান্সারের রিসার্চ ও নেটওয়ার্ক তৈরীর কাজ চলছে।

 

যে ক্যান্সারের জন্য স্ত্রী মেহেরবাঈকে হারাতে হয়েছিল সেই ক্যান্সারের জন্যই ৯২ বছরেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করে চলেছে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমরা টাটা গ্রুপ থেকে বাজারে পেয়েও যাব ক্যান্সার সারানোর ওষুধ। একেই বলে ভালোবাসার আসল নিদর্শন।

কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ইতিহাসের পাতায় দোরাবজি এবং মেহেরবাঈ-এর এই ভালোবাসার কথা হয়ত একদিন হারিয়ে যাবে।

 

-সূত্রঃ ইন্টারনেট 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url