ব্রিলিয়ান্ট নামা
প্রতীকী ছবি |
ব্রিলিয়ান্ট
ছেলেদের কাঠগড়ায় তুলে একটা লেখা ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে খুব ঘুরছে দেখলাম। মূল লেখাটি
কার জানিনা, জানার ইচ্ছেও নেই।
লেখাটির
সারবত্তা হল, 'ব্রিলিয়ান্ট ছেলে'রা সামাজিকভাবে খুব খারাপ হয়। তারা বাপ-মা-ভাই-বোনদের
ভুলে যায়, দেশকে ভুলে যায়... এক কথায়, ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা খুব সহজেই নিজের শিকড়কে ভুলে
যায়।
লেখক বা
লেখিকার ব্রিলিয়ান্টদের প্রতি এতই রাগ যে তিনি দেখতে পাননি আমাদের আশেপাশে নিজের ল্যাপটপে
শস্য-শ্যামল বাংলার নদী-পাহাড় ওয়ালপেপারে লাগিয়েও কত ছেলে সম্পত্তির জন্যে বাপ-মাকে
অত্যাচার করছে... গল্প-কবিতা পড়ে, সঙ্গীত শুনে বৃষ্টিতে মন খারাপ করায় কত ছেলে তার
বৌকে ধরে নিয়মিত পেটাচ্ছে... সেসব তাঁর নজরে আসেনি।
তিনি শুধু
সেন্টিমেন্টের রসে জবজব করে ভিজিয়ে মধ্যবিত্ত-বাঙালির লাইক-কমেন্ট-শেয়ার হাতিয়ে নেওয়ার
মশলা মিশিয়ে একটা লেখা নামিয়েছেন, যেখানে ব্রিলিয়ান্টদের এমন ভাবে ভিলেন বানানো হয়েছে
যাতে সন্তানের মধ্যে সামান্যতম ব্রিলিয়ান্স ধরা পড়লে বাপ-মা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, 'এই
রে! আমার খোকনও আমার মরার সময় পাশে না থেকে প্লেনে করে আমেরিকা থেকে কানাডার উদ্দেশ্যে
উড়ে যাবে না তো?' বাপ-মায়ের দায় ঝেড়ে ফেলে তাদের স্বার্থপরতাকে ঢেকেঢুকে রাখা পর্দাটুকু
এই লেখা একটানে খুলে নামিয়ে বেআব্রু করে দিয়েছে।
আমার জানা
মতে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা তাদের লেখাপড়ার জন্যে বাপমায়ের টাকা পয়সা খুব একটা খরচ করায়
না। তারা ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যায়। কিন্তু এই লেখাতে একবারও সেইসব
মিডিওকার ছেলের কথা আসেনা যাদেরকে জোর করে ব্রিলিয়ান্ট বানানোর চক্করে বাপ-মা সেভিংস
ভেঙে, গয়না বেচে প্রাইভেট কলেজে বিশ-পঞ্চাশ লাখ খরচ করে পড়ায়। তারপর সেই ছেলে যখন পাশ
করে উঠে সরকারের অপদার্থতায় বাধ্য হয় পনের-বিশ হাজারের মাইনেতে কাজ করতে আর সেই মাইনেতেই
লোক দেখানো ঠাটবাট বজায় রাখতে আইফোন কিনে, দামী বাইক কিনে তার ঋণের দায় বাপ-মায়ের ওপর
ঠেলে দেয়... তখনও এই লেখক/ লেখিকার কুনজর সেই ব্রিলিয়ান্টদের ওপরেই থাকে।
যত দোষ
ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের। ব্রিলিয়ান্ট মেয়েদের তো লেখক/লেখিকা দেখতেই পাননি। হয়ত তাঁর মতে
মেয়েরা ব্রিলিয়ান্ট হয়ই না বা হলেও বিয়েথা করে স্বামীর সংসার সামলানোই তার কাজ। তাই
তারা এই লেখায় একটা বারের জন্যেও আসেনা। তাই পাঠক ধরে নিতে পারে, বাবা-মায়ের যদি একটিই
মাত্র কন্যাসন্তান হয় আর সে যদি ব্রিলিয়ান্ট হয়, তবে তার পূর্ণ অধিকার আছে মায়ের মৃত্যুর
সময় ল্যাপটপে ভিসুভিয়াস টাঙিয়ে প্লেনে চেপে এদেশ সেদেশ ঘুরে বেড়ানোর... যতই তার মা
খু-কু-উ বলে ডাকতে ডাকতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন না কেন।
যাক গে,
আমি কী করলাম জানেন? লেখাটাতে প্রত্যেকটা 'ব্রিলিয়ান্ট' শব্দকে 'অমানুষ' শব্দ দিয়ে
প্রতিস্থাপিত করলাম, দেখলাম দিব্যি লেখাটা দাঁড়িয়ে গেল। তাই দোষটা ব্রিলিয়ান্ট সন্তানকে
না দিয়ে অমানুষ সন্তানকে দিন। বলুন আমরা ঘরে ঘরে অমানুষ বানানোর মহোৎসবে মেতেছি।
একটা ছেলে
বা মেয়েকে ব্রিলিয়ান্ট বানানোতে বাপ-মায়ের যত না অবদান, তার চেয়ে বাপ-মায়ের ঢের বেশি
অবদান সন্তানকে অমানুষ বানানোতে। নিজের সন্তান যাতে অমানুষ না হয়ে মানুষ হয়, সেদিকে
লক্ষ্য দিক সবাই, তাহলেই আর ভালো বাপ-মা হয়ে ওঠার ব্যর্থতা ঢাকতে সন্তানের ব্রিলিয়ান্সকে
দোষ দিয়ে এইসব লেখা শেয়ার করতে হয়না।
তাই সন্তান
অমানুষ হলে নিজেদের ব্যর্থতাকে স্বীকার করুন, যাতে ভবিষ্যতের বাবা-মায়েরা সন্তানের
ব্রিলিয়ান্সকে ভয় পেয়ে চেপে না দিয়ে বরং নিজেরা ভালো অভিভাবক হয়ে ওঠার জন্যে গ্রুমিং
করাতে পারেন।
- বিপ্লব
কুমার দে