॥ সততার সুর-শিল্পী ॥
হেমন্ত মুখোপ্যাধ্যায় |
“একবার
এক নতুন শিল্পী এসে উপস্থিত হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। সদ্য গানের জগতে পা
রাখা সেই শিল্পীর চোখে ছিল স্বপ্ন আর মনে ছিল একটু সংশয়। নিজের তৈরি গানটি গেয়ে
শোনানোর পর সেই তরুণ প্রশ্ন করলেন—
“হেমন্তদা,
আমার গলা কেমন?”
এই
প্রশ্ন শুনে চারপাশে সবাই একটু থমকে গেলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যিনি নিজের
অসামান্য সুর ও কণ্ঠের জন্য গোটা উপমহাদেশে পরিচিত, তার কাছে এমন প্রশ্নের জবাব
কেমন হতে পারে?
কিন্তু
হেমন্তদার প্রতিক্রিয়া একেবারে সরল এবং রসিকতায় ভরা। তিনি হেসে বললেন—
“তোমার
গলা তো সেকেন্ড ক্লাস। তবে যদি তুমি হৃদয় দিয়ে গান গাও, শ্রোতাদের কাছে তা
ফার্স্ট ক্লাস হয়ে যাবে!”
উপস্থিত
সবার মধ্যে হালকা গুঞ্জন শোনা গেল। তবে তাঁর এই কথার মধ্যে ছিল গভীর জীবনদর্শন।
হেমন্ত বুঝিয়ে দিলেন, গান কেবল গলার মাধুর্যে সীমাবদ্ধ নয়; হৃদয়ের আবেগই একটি
গানের প্রাণ।
একবার
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটি হিন্দি ছবির জন্য গান রেকর্ড করছিলেন। বাংলা তার
মাতৃভাষা হওয়ায়, হিন্দি উচ্চারণ নিয়ে তিনি একটু সচেতন ছিলেন। গানের লাইনগুলো
সঠিক উচ্চারণে গাওয়ার জন্য বারবার অনুশীলন করছিলেন। কিন্তু তখনো এমন একটি শব্দ
এল, যেটি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে গিয়ে তার অর্থ বদলে গেল।
গানটি
রেকর্ডিং শেষ হওয়ার পর প্রযোজক মজা করে বললেন—
“হেমন্তদা,
এই লাইন শুনলে শ্রোতারাও ভাববে, আপনি অন্য কোনো ভাষায় গান করছেন!”
এই
কথায় ঘরে উপস্থিত সবাই হাসতে শুরু করলেন। কিন্তু হেমন্ত একটুও বিচলিত না হয়ে,
চিরচেনা ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিলেন—
“শ্রোতারা
সুর শুনতে চায়, ভাষা নয়। তাও আমি ঠিক করে নিচ্ছি।"
তার এই
উত্তর সবার মনে গভীর ছাপ ফেলে গেল। কারণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জানতেন, ভাষার চেয়ে
সুরই হলো শ্রোতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আসল মাধ্যম। তিনি আরও একবার প্রমাণ করলেন,
কণ্ঠের মাধুর্য আর সুরের শুদ্ধতাই একজন শিল্পীর প্রকৃত পরিচয়।
হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল সুরের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা। তিনি
ছিলেন সুরের সাধক এবং জীবনকে গ্রহণ করতেন এক সহজ, সরল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। তার
রসবোধ, বিনম্রতা আর কাজের প্রতি ভালোবাসা তাকে সবাই থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
নতুন
শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা হোক বা নিজের গান নিয়ে সততা—সব ক্ষেত্রেই তিনি
ছিলেন অনন্য। তার এই সহজাত রসবোধ আর সুরের প্রতি অঙ্গীকার তাকে আজও বাঙালির হৃদয়ে
অমলিন করে রেখেছে।
একবার
এক বড় স্টেজ প্রোগ্রামে তিনি গান পরিবেশন করতে গিয়েছেন। সবে সূর্য পশ্চিমে ঢলে
পড়েছে। এদিকে সবকিছু প্রস্তুত, দর্শক আসনেও উপচে পড়া ভিড়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিতেই একটা ভক্ত চিৎকার করে বললেন—
"হেমন্তবাবু,
আপনাকে শোনার জন্য আমি এত দূর থেকে এসেছি! প্লিজ, ‘সূর্য ডোবার পালা..’ গানটি
একবার গাইবেন।”
হেমন্ত
মুখোপাধ্যায় এতটুকু বিরক্ত না হয়ে মৃদু হেসে শান্তভাবে উত্তর দিলেন—
“অবশ্যই,
আমি সেই গান গাইব। তবে আগে আপনি বসুন। এত দূর থেকে আসতে আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে,
আমি চাই আপনার ক্লান্তি সুরে সুরে মিশে যাক।”
এরপর
তিনি ধীর লয়ে গানটি শুরু করলেন। তাঁর সেই ব্যারিটোন কণ্ঠ আর সুরের মাধুর্যে গোটা
হল যেন নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল। গোধূলির আলো-আঁধারে জড়ানো অস্তগামী সূর্যও যেন
সেই সুধাকন্ঠের রেশ বয়ে নিয়ে নতুন এক দিনের আলো ছড়ানোর প্রেরণা পাথেয় করে ধন্য
হল। সুরের মূর্ছনায় তখন ধরণী যেন এক “স্বপ্নের দেশ”।
গান
শেষে সেই ভক্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—
“সত্যিই,
আপনার গান শুধু ক্লান্তিই মেটায় না, জীবনকেও সুন্দর ও মধুময় করে তোলে। আজ আমার
আসা সার্থক!”
হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের এইসব টুকরো টুকরো স্মৃতিজড়ানো ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে, তিনি শুধু
সুরের মানুষই ছিলেন না; ছিলেন জীবন, রসবোধ এবং শিল্পের এক নিবেদিতপ্রাণ দিশারি।
গানের
ভক্তদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কতখানি আন্তরিক, মানবিক এবং সুরের প্রতি তাঁর বিশ্বাস
কতখানি গভীর, তার ছাপ রেখে গিয়েছেন সাঙ্গীতিক ইতিহাসের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে। তাঁর
থেকে শেখা যায়, গান কেবল গলার নয়, হৃদয়ের; আর জীবন সহজ ও মানবিক হলে সুরও সহজ ও
মর্মস্পর্শী হয়...."
_____________________________
সৌজন্যেঃ কিছু কথা ॥ কিছু সুর