নড়াচড়া করিস নে পয়সা কিন্তু চারটেই নেবো

 

"লড়াচড়া করিসনে, পয়সা কইল চারটেই নেবোনে"


হারিয়ে গেছে গ্রামের হাট-বাজারে টুল-পিঁড়িতে বসে চুল কাটার দৃশ্য!

বাংলাদেশে পুরনো দিনের চুল কাটার প্রথা ছিল অনেকটাই ভিন্ন, যা বর্তমানে আধুনিক সেলুন এবং হেয়ার কাটিং সেন্টারের উন্নতির সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। তবে সে সময়ে গ্রামের হাট-বাজারের উন্মুক্ত স্থানে টুল পিঁড়িতে চুল কাটা একটি সাধারণ দৃশ্য ছিল। গ্রামের মানুষদের জন্য এটি ছিল এক ধরনের সামাজিক মিলনমেলা, যেখানে একসঙ্গে বসে চুল কাটানোর পাশাপাশি গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা করে সময় পার করা যেতো।

দুয়েক জায়গায় চেয়ার পেতেও চুল কাটা হতো। আবার দুয়েকটা দোকানেও চুল কাটা হতো। সেটা ছিল তার চেয়ে একটু উন্নত। সেসব দোকানের কারিগররা চটুল গল্প গুজব করে অপেক্ষমান খদ্দেরদের মাতিয়ে রাখতো, যাতে অন্যত্র চলে না যায়। কোনো কোনো দোকানে আবার সংবাদপত্র রাখতো। অপেক্ষমান খদ্দেররা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা ভাগাভাগি করে নিয়ে পড়ে অপেক্ষা করার বিরক্তিকর সময় পার করত।

গ্রামের বাজারে চুল কাটার দৃশ্য

আমাদের নিকটস্থ বাজারে গেলে এসব দৃশ্য চোখে পড়তো। অনেকে শিশু সন্তানদের নরসুন্দরের কাছে বসিয়ে দিয়ে বাজার করতে যেতো। টুল-পিঁড়িতে বসে যারা চুল কাটতো তাদের অস্ত্রপাতিতে আবার ধার কম থাকতো। ব্যথায় কেউ নড়াচড়া করলে অনেক নরসুন্দর বিরক্ত হয়ে চর-থাপ্পরও মারতো।

একদিন এক হাস্যকর দৃশ্য নজরে পড়লো। একজন তার শিশুপুত্রকে এক নরসুন্দরের কাছে বসিয়ে দিয়ে বাজার করতে গেছে। সেই শিশুকে নরসুন্দরের দুই হাঁটুর মাঝখানে চেপে ধরে দ্রুতগতিতে চুল কাটছে। ছেলেটা ব্যথায় নড়াচড়া করায় কোনোমতে তার চুল কাটতে পারছে না। মারলো এক থাপ্পর! কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার নড়াচড়া করলে নরসুন্দর বলে উঠলো, “এই মনি, লড়াচড়া করিসনে, পয়াসা কইল চারটেই নেবোনে”। অর্থ= নড়ো-চড়ো যাই করো, চুল কাটা যেমনই হোক, পয়সা কিন্তু কম নেবো না।

আমাদের এলাকায় শিশুদের অনেকে ‘মনি’ ডাকে। লড়াচড়া=নড়াচড়া, কইল=কিন্তু। আর ‘পয়সা কিন্তু চারটেই নেবো’ মানে তখন টুল-পিঁড়িতে চুল কাটতে বড়দের দুইআনা, ছোটদের একআনা। সেলুনে বা দোকানে নিতো চারআনা বা ছয়আনা। একআনা মানে ৪ পয়সা। ষোলো আনা বা ৬৪ পয়সায় একটাকা হতো। তখন দশমিক মূদ্রা চালু হয় নাই।

গ্রামে নরসুন্দররা বাড়ি বাড়ি গিয়েও চুল কাটাতো। সেক্ষেত্রে কাজের সময় কোনো পারিশ্রমিক নিতো না। মৌসুমের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান সংগ্রহ করে নিতো।

এখনকার দিনে যেমন সেলুনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, তখনকার দিনে এসব যন্ত্রপাতি ছিল না। তখনকার সেলুনের অস্ত্রপাতি একটু ধারালো থাকলেও এক ক্ষুরই সবার জন্য ব্যবহার করতো। সেলুনে চুলকাটা অনেকটা আভিজাত্য বলে বিবেচিত হতো।

বর্তমান যুগে অনেক কিছুই বদলেছে। এখন টুল পিঁড়িতে চুল কাটার সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন নতুন সেলুনের যুগে মানুষ আরও বেশি স্নিগ্ধ পরিবেশে চুল কাটতে পারে।

পুরনো দিনের সেই সাদামাটা এবং সরল জীবনধারা আজও অনেক মানুষের স্মৃতির  কোনায় গেঁথে আছে। 

ধন্যবাদ সবাইকে।




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url