১১০ বছর ধরে ফ্রি খাওয়াচ্ছে যে হোটেল
আকবরিয়া গ্রায়ান্ড হোটেল, বগুড়া |
“রাত
১১টা। রাস্তার পাশে বসে গেছেন সারিবদ্ধ মানুষ। তাদের সবাইকে দেওয়া হচ্ছে গরম গরম
টাটকা খাবার। সবাই খেয়ে হাত চেটেপুটে তৃপ্তি সহকারে উঠে যাচ্ছেন, কিন্তু এসব
খাবারের বিনিময়ে কাউকে দিতে হচ্ছে না কোনো বিল বা একটি কানাকড়িও!
রোজ
রাতে এমনই একটি দৃশ্য দেখা যায় বগুড়ার ‘আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল’- এর সামনে এবং
প্রায় ১০৬ বছর ধরে চলে আসছে এই রীতি! বগুড়ার একসময়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম আকবর
আলী ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল’। তার কিছুদিন পর থেকেই
তিনি নিয়ম করে প্রতি রাতে ১১টা থেকে ১২টায় গরিব-মিসকিনদের বিনামূল্যে খাবার দিতেন।
তার মৃত্যুর পর তার ছেলেরাও এ নিয়ম মেনে চলছেন। শহরের গরিব-দুঃখীরা এখানে আসেন
একবেলা পেটপুরে ভালো খাবারের আশায়।
আকবরিয়া
গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ্ব আকবর আলী তৎকালীন ভারতের মুর্শিদাবাদ
জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্য অন্বেষণে একসময় স্ব-পরিবারে বগুড়া আসেন তিনি। এরপর
তার ভাইয়ের সাথে শুরু করেন মেকানিক্যাল কাজ। তখন বগুড়া শহরে মুসলমানদের খাবারের
কোনো হোটেল ছিল না। আর এই পরিস্থিতি দেখেই তিনি হোটেল ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু হোটেল দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ তার ছিল না। তাই তিনি নিজে মিষ্টি তৈরি
করে সেগুলো ফেরি করে করে বিক্রি শুরু করেন।
এরপর
মিষ্টি বিক্রির কিছু পুঁজি নিয়ে ১৯১১ সালে বগুড়া শহরের মাসিক আট টাকা ভাড়ায় হোটেল
ব্যবসা শুরু করেন আকবর আলী। বগুড়া শহরে তৎকালীন আকবর আলীর ছোট্ট হোটেলই ছিল
মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল। তাই খুব দ্রুতই চারিদিকে তার হোটেলের সুনাম ছড়িয়ে
পড়ে। একসময় মাসিক ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে তিন বেলার খাবার পাওয়া যেতো এখানে। সে
সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল মাত্র এক টাকা প্লেট!
ব্রিটিশ
আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটরে হোটেলে বিদ্যুতের ব্যবস্থা
করেছিলেন। বগুড়ার সাদা সেমাইয়ের আজ দেশব্যাপী যে খ্যাতি তার মূলেও আছে আকবর আলীর
নাম। তখন কলকাতা থেকে সেমাই আসতো বাংলাদেশে। কিন্তু সেই সেমাই তৈরির প্রক্রিয়া
জানা ছিল না এখানকার কারো। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে অল্প দামে সেমাই খাওয়ানোর
তাগিদ থেকেই আকবর আলী একসময় সেমাই তৈরি শুরু করেন এবং সফলও হন।
দিন
দিন আকবর আলীর হোটেল ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। ধর্মভীরু আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি
এবং প্রসারে খুশি হয়ে আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে গরিব-মিসকিনদের খাওয়াতে
শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগে তিনি তার ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে মুসাফির,
ভিক্ষুক, মিসকিন-গরিবদের খাওয়ানোর কথা বলে যান। আর তার সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি
আজও। বাবার শুরু করা নিয়ম মেনে তার ছেলেরা আজও তা করে যাচ্ছেন।
আকবরিয়া
গ্র্যান্ড হোটেলের রয়েছে চারটি শাখা। এগুলোতে কর্মচারী রয়েছে দুই সহস্রাধিক। আর
আকবর আলীর সেই লাচ্ছা সেমাই এখন বিদেশের বাজারেও বিক্রি হয়। রাত ১১টায় হোটেলের
সামনের রাস্তায় যতো লোকই বসেন প্রত্যেককে খাবার দেওয়া হয়। কখনো সে খাবারে কমতি পড়ে
না। এমনকি এখানে যে খাবার দেওয়া হয় তার মানও অত্যন্ত ভালো। এই খাবার বিতরণের জন্য
প্রতিদিন এক মণেরও বেশি চাল রান্না করা হয় এবং এখানে প্রতিদিন রাতে প্রায় সাড়ে
তিনশো অভাবী মানুষ একবেলা পেটভরে খাবার খেয়ে থাকেন।
ব্যবসা
তো অনেকেই করেন, অনেকে বড় ব্যবসায়ীও হন। কিন্তু আকবর আলীর মতো এমন বড় মনের মানুষ
ক'জন হতে পারে? শত শত অসহায় মানুষের পেটের জ্বালা ক'জন নিভাতে পারে!!”
(copied)
সৌজন্যেঃ পারভিন খায়ের