ভাগ্য-তাড়িত জীবন-কথা (পর্ব-ছয় [শেষ পর্ব]) - প্রভাস ভদ্র
প্রভাস ভদ্রঃ কিশোর ও বর্তমান(৮১) |
আমি তখন সেকালের
প্রচলন মতে কলেজ-দেয়ালে 'কাকলি' নামে একটি দেয়াল পত্রিকা শুরু করি। অন্যতম
বৈশিষ্ট্য ছিল, আমার হাতের লেখা, আঁকা ছবি এবং উন্নতমানের সম্পাদনা। তদুপরি
প্রদর্শিত স্থানটি ছিল, কলেজে প্রবেশ-পরেই কলেজের প্রিন্সিপাল মহোদয়ের ঘরের দরজার
দেয়ালটি। স্বভাবতই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি অল্পতেই আশাতীত পরিচিতি পেয়ে যাই।
চতুর্থ বর্ষ তথা
ফাইনালেই ইয়ারে অভাবনীয় আর এক ভাগ্য-তাড়িত ঘটনা ঘটল আমার জীবনে।
যে ছেলেটি সকালে
ছাত্র পড়িয়ে কলেজ আসতো। সবদিন সকালে খেয়ে আসার সময় হতো না। কলেজ ক্যান্টিনে খেতো। সে
কি করে যে কলেজের সুমুখের 'দত্ত ব্রাদার্স' নামে বইয়ের দোকানের নজর কাড়া সুশ্রী
মানব দত্ত ওরফে কলেজের সবার প্রিয় মানুদার নিজের স্নেহের ভাইটি হয়ে উঠল!!
মানুদা ছিলেন আর্ট
কলেজ থেকে পাশ করা জাত শিল্পী। ওর ধারণা হয়েছিলো, নিষ্ঠায় লেগে থাকলে আমিও একদিন
উচ্চমানের শিল্পী হবো।
মানুদা সকালে মেয়েদের
কলেজের জন্য বাবার হয়ে প্রথম পর্বের দোকান খুলতে আসতো সেই যাদবপুর থেকে। ওর চোখে
আমিও সম্ভাবনাময় আগামী দিনের শিল্পী।অতএব
খেয়ে আসি না আসি, অফ
পিরিয়ডে গেলে নিজের সঙ্গে জোর করে হোটেলে খাইয়েই ছাড়ত আমাকে।
হঠাৎই আমার ঘনিষ্ঠ
বন্ধুরা যারা সকলেই প্রায় মেধায় আমার চাইতে বিস্তর উন্নতমানের তারা ছাত্র ইউনিয়নের
নানা ভূমিকায় স্থির করলো, ওদের বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী দিতে হবে।
সেই সময় আমি অতি
সাধারণ পরিবারের সংগ্রামী জীবনের বড় কিছু স্বপ্ন না-দেখা একজন ছাত্র মাত্র। তবুও
বন্ধুদের সিদ্ধান্তের সহযোদ্ধা হতেই হয়েছিল।
সমগ্র ব্যাপারটাই ছিল
আবেগতাড়িত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন নির্ভীক লড়াইয়ের।
অন্যায়টা কি? সেই
সময়ের পূর্ব পর্যন্ত কলকাতার অধিকাংশ ছাত্র ইউনিয়নগুলিই ছিল বামপন্থী ভাবধারার এস
এফ আই ছাত্র সংগঠনের দখলে। দখলে না থাকলেও ডিএসও নামে আরও একটি ছাত্র সংগঠনও ছিল। কিন্তু
কংগ্রেসী মনোভাবের ছাত্রদের সংগঠন ছাত্রপরিষদ ছিলই না বলা চলে।
সেসময় পূর্ব পর্যন্ত
কোনও ছাত্রইউনিয়নই আজকের মতো সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা পরিচালিত হতো না। কিন্তু
সেইসময় বামপন্থার সাম্যবাদে বিশ্বাসী এমন একটি দুর্বার ছাত্রধারার আগমন ঘটেছিল যে
কলকাতার অধিকাংশই কলেজেই ছাত্র ইউনিয়নগুলিতেই জয়ী ছিল তাদের ছাত্র সংগঠন এসএফ আই। কিন্তু
এরাই ক্রমশঃ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির বেআব্রু শাখা সংগঠনে পরিণত হয়ে পড়ছিল। ছাত্রদের
স্বার্থের চাইতে রাজনৈতিক দলের স্বার্থ দেখাটাই প্রাথমিক উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
স্বপ্নও ছিল, আগামী দিনে বাম রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার। ফলশ্রুতি, এরা অনেকেই
কিন্তু পশ্চিবঙ্গের বাম শাসনকালে বিখ্যাত মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
সেইসময় রাজনৈতিক
দলগুলির হয়ে ছাত্র সংগঠনের এই পরিবর্তিত ভূমিকাতে আমাদের আপত্তি ছিল বলেই
ওদের বিরুদ্ধে
নির্বাচনে লড়াই করতে আমরা আমাদের নতুন ছাত্র সংগঠনের নাম দিয়েছিলাম আই,ইউ অর্থাৎ
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিট।
অনেকটা ঢাল নেই
তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো। আমার ওপর পোস্টার লেখার দায়িত্ব। তা কেন, আজকের
দিনের পাব্লিসিটি বিভাগের হেডবাবুর মতো। রাজনৈতিক দলের নেপথ্য আর্থিক সহায়তা ছাড়া
নির্বাচনে লড়াই করা যায়!! তবুও খবরের কাগজ জোড়া দিয় আমার লেখা বড় বড় হরফের বিশাল
বিশাল পোস্টার আর আঁকা নিত্য নতুন আকর্ষণীয় ব্যঙ্গ চিত্র প্রদর্শনী নির্ভর নতুন
ধরণের প্রচার এবং ছাত্রদের কাছে যুক্তিযুক্ত বক্তব্য পেশ নির্ভর করেই আমরা কিন্তু
বিস্ময়কর জিতে সাড়া জাগাতে পেরেছিলাম। ফলশ্রুতিতে সেবছর আমি হয়েছিলাম, কলেজ
ম্যাগাজিন -সম্পাদকও।
ব্যাস্ ওই পর্যন্তই।
কেননা, শিরে সংক্রান্তি ফাইনাল পরীক্ষা।
সেই আবার ভাগ্য তাড়িত
হলাম। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই বাবা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বড়দা মেজদা
বহির্বঙ্গের চাকরিতে। আমিই প্রধান।
বাবা সুস্থ হয়ে ওঠার
পূর্বেই রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল, অনার্সে আশাতীত নম্বর পেয়ে পাশ করেছি। আমি
স্কুল মাস্টার হওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। বড়দা বললো, “আমরাতো আছি। পাকামো ছাড়। তুই এম এ
তে ভর্তি হ। অত ভালো নম্বর পেয়েছিস। মাস্টার হবি কেন? কলেজে পড়াবি তুই।“
-
< সমাপ্ত > -
- প্রভাস ভদ্র
পর্যায়ক্রমিক ছবি |