বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর

 


উপক্রমণিকা

বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে প্রত্যাগত কলকাতার স্বনামধন্য লেখক প্রভাস ভদ্র দাদার স্মৃতিচারণ পড়ে আমার একটি স্মৃতি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই প্রভাস’দার লেখার পরে আমার স্মৃতিচারণটি যোগ করে দিলাম। ১ম ও ২য় ছবি দুটি প্রভাস ভদ্রের স্মৃতি সম্বলিত। ৩য় ছবিটি আমার নিজের।

 

বিষয়ঃ বিশ্বাস,অবিশ্বাস

প্রভাস ভদ্র।

প্রথমটি একটি মাদুলি চিত্র। আমার হেফাজতে সযত্নে থাকার বয়স ৫১বছর।

আমি তখন ৯০% মুসলমান বসবাস স্থান গার্ডেনরীচ তথা মেটিয়াবুরুজ অফিস-প্রধান। মধ্যাহ্ন সময়কালে আমার সংরক্ষিত চেম্বারে কি করে যেন হঠাৎই কালো আলখাল্লা পরিহিত এক বিশালদেহী পুরুষের প্রবেশ। মাথায় একরাশ লম্বা চুল কালো কাপড়ের বাঁধনে সংযত শাসনে রাখা। ঠোঁট চিবুক নাসায় গো্ঁফ দাঁড়ি যথাযথ। ডাগর ডাগর দুটি চোখ। দর্শনে সমীহ আদায় যোগ্য।

সুমুখ চেয়ারে বসতে বললাম। কাঁধের ঝোলা কোলে রেখে বসলেন। কি কারণে আসা জানতে চাইলাম। উত্তর, এমনিই দেখা করতে এলাম। সারা দেশময় ঘুরে বেড়াই। এখানে এসে মহল্লায় মহল্লায় তুমহারা খুউব সুনাম শুনলাম। তাই দর্শন করতে এলাম।

ধর্মীয় নাতি দীর্ঘ কথাবার্তার পর তিনি তাঁর ঝোলা থেকে একটি চিরকুট বের করে বলেছিলেন, হররোজ সূর্য উদয়কালে এই লেখাটা পাঠ করে সূর্য প্রণাম করবি। কোনও দুশমন তোর ক্ষতি করতে পারবে না। খোদা তোর সহায় থাকবে।

এতো আরবি হরফে লেখা! বল্লাম, আমিতো পড়তে পারি না। তিনি বল্লেন তাহলে, মাদুলিতে ঢুকিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখিস।

কথাগুলি বলেছিলেন আরবি হিন্দী সংমিশ্রণে। আমি আমার মতো করে লিখলাম। তবে আপ নয় তুম তু ইত্যাদি ব্যবহার করেছিলেন। সাধু সন্তরা তেমনটিই সম্বোধন করেন। বেশ আপন জনের মতো। তাছাড়া, আমার বয়স তখনতো স্নেহ ভাজনের মতোই।

যাই হোক মা-র কথায় আমি কিন্তু মাদুলিতে ভরে গলায় ঝুলিয়েছিলাম, ততদিনই যতদিন ওই অফিসে ছিলাম। কেননা, ওই অফিস অঞ্চলটা খতরনাক হিসেবে সেসময় খুবই আতঙ্কের অফিস হিসেবে পরিচিতিতে ছিল।

 

দ্বিতীয় চিত্রটি একটি পঞ্চমুখি রুদ্রাক্ষ র। এটিরও ইতিহাস হয়ে আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে তা প্রায় ৫৩বছর হতে চললো। ভাইয়ের ভ্রমণ সংস্থার ম্যানেজার হয়ে দল নিয়ে কেদারবদ্রীনাথ যেতে হয়েছিল। বদ্রীনাথ মন্দির থেকে দলবলকে গাইড করে নিয়ে বের হবার মুখে দু'ধারে বসে থাকা যথারীতি সারিবদ্ধ ভিখিরি ও সাধুদের সমাবেশ দেখলাম। সুন্দরের পূজারী আমি কোনও দিনই অর্ধ উলঙ্গ ছাই ভস্ম মাখা অপরিচ্ছন্ন সাধুদের মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে না পাওয়ায় বরাবরই বিরূপ হলেও জীবনে সেই প্রথম একজন সৌম্যদর্শন পরিচ্ছন্ন দিব্যজ্যোতিযুক্ত সাধুকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে কাছে গেলাম। সামনে রাখা পাত্রে প্রণামী রেখে করজোড়ে প্রণাম করলাম। তিনি তার ঝোলা থেকে রুদ্রাক্ষটি হাতে দিয়ে বললেন,যত্নে রাখিস।

সেই থেকে সযত্নে রূপোর চেন এ গলাতেই ঝোলানো থাকতো।

এখনও বিশেষ বিশেষ সময়কালে গলায় ঝোলে। অন্যথায় যত্নে রক্ষিত থাকে।যেমনটি আছে মাদুলিটিও।


এবার নিজের কথা

১৯৭৫ সালের কথা। এক বন্ধুর সাথে বেড়াতে গেছি। বেড়ানোর এক ফাঁকে বন্ধুটি বললো, এখানে এক বড়ভাই থাকে, চলো দেখা করে আসি। গেলাম।

বন্ধুটির বড়ভাই বেশ কৃচ্ছ প্রকৃতির। সাজানো ছক বাঁধা নিয়মে চলেন। বেশ ভদ্র, তবে চতুরভাষী। সহজেই মানুষকে নিজের আয়ত্বে নিতে সক্ষম।

আমাকেও পটিয়ে ফেললেন। কথায় ফেলে আমার হাতের রেখা দেখলেন। দেখে একজন পাক্কা জ্যোতিষীর মতো বেশ ছবক দিলেন। কি পাথর ব্যবহার করলে ভাগ্যরেখার অশুভ দিকগুলি ধীরে ধীরে কেটে যাবে তার পরামর্শ দিলেন। ‘পাথর সংগ্রহের উপায়?’ জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘বললে আমি সংগ্রহ করে দেবো।‘ পটে গেলাম।

সে সময়ে ২৫ টাকায় তার কাছ থেকে পাথরটি নিতে এক প্রকার বাধ্যই হয়েছিলাম। বড়ভাই বাতলে দিলেন, রুপার আংটি বানিয়ে কোন আঙ্গুলে ব্যবহার করতে হবে। আংটি হাতে দিয়ে কি কি করা যাবে না ইত্যাদি।

সেই থেকে আজ অবধি পাথরটি আমার রিং ফিঙ্গারে। ৫০ বছর হয়ে গেলো। মাঝে দুইবার হারিয়েছিলো, একবার জলাশয়ে ও একবার পুকুরে। দু-দু’বার হারিয়ে গিয়েও আবার পেয়ে পাথরটির উপর ভক্তি জমে গিয়েছিলো। ওই যে প্রভাস’দা বলেছেন “বিশ্বাস-অবিশ্বাস”! সেই বিশ্বাসের সূত্রমতে এখনো আঙ্গুলে রেখেছি। তবে এখন কেনো যেন মনে হয়, বড়ভাই একজন পাক্কা শিকারী ছিলেন! 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url