ভাগ্য-তাড়িত জীবন-কথা (পর্ব- পাঁচ) - প্রভাস ভদ্র

 

প্রভাস ভদ্রঃ কিশোর ও বর্তমান(৮১)



ভাইবোনদের মধ্যে সবচাইতে অধিক মেধাবি বড়দা বাধ্য হয়ে দিনে ছোট খাটো চাকরি আর নৈশ কলেজে পড়ছে। মেজদা সকালে সন্ধ্যায় টিউশানি করে কলেজ পড়ছে। মেজদিও তাই। আমি বাচ্চা পড়িয়ে স্কুল ফাইনাল পাশ করলাম। উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংরেজি অংকতে বেশি পোক্ত হতে হয়। অথচ, দুটোতেই আমি দারুণ কাঁচা। একমাত্র বাংলায় দারুণ ভালো ছাত্র। তাই, স্কুলের পরীক্ষায় বাংলা নম্বর প্রাপ্তিতে অনেক সময়ই ক্লাসের প্রথম-তৃতীয় স্থান অধিকারীদের নম্বরে ছাড়িয়ে গেলেতো আর উচ্চ শিক্ষা সম্ভব নয়। অতএব, কার পরামর্শে জানিনা, বাবা আমাকে বউবাজারের (বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি ষ্ট্রীট) বিখ্যাত জর্জ টেলিগ্রাফ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে এ এস এম শিপ অর্থাৎ এ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টার কোর্সে ভর্তি করে দিয়েছিল। পাশ করলেই কেন্দ্রীয় সরকারের রেলের চাকরি।

ঘুড়ি ওড়ানো প্রীতি ভালোবাসার বয়স থেকেই দেশময় ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে হতো। তাই খুশিতে ভাবলাম, বেশ মজাই হবে। বদলির চাকরিতে সারা দেশময় ঘুরে বেড়ানো যাবে।

 

তখনতো ফোন তেমনভাবে চালু ছিলনা। রেলে চাকরির দরকারে টক্কা টরে টক্কা টরে- টেলিগ্রাফ শিখতে বেশ রোমাঞ্চকর ভালোই লেগেছিল। পাশও করলাম, রীতিমতো সন্মানের ফার্স্ট ডিভিশনে। অতএব, অনতি বিলম্বে চাকরি প্রাপ্তি আমার অবধারিত ভেবে সে যে কি আনন্দ!

কিন্তু ওই যে, ভাগ্য-তাড়িত।

তখনতো বার্থ সার্টিফিকেটের প্রচলন ছিল না। স্কুল ফাইনালের সার্টিফিকেটে উল্লেখিত বয়সকেই জন্ম তারিখ হিসেবে স্বীকৃত হতো। তাতে দেখা গেল, চাকরির বয়সই হয়নি আমার।

 

অতএব, চুপচাপতো আর বসে থাকা যায় না। শিক্ষা-জীবনের মোড় গেল ঘুরে। ভর্তি হলাম, হ্যারিসেন তথা মহাত্মা গান্ধী রোডের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস বিভাগে। দু'বছরের কোর্স।

মফস্বলি ছাত্ররা সেসময় শিয়ালদহ স্টেশন নিকটবর্তী বঙ্গবাসী আর সুরেন্দ্রনাথ কলেজেই ভর্তি হতো বেশি।

জর্জটেলিগ্রাফে যা পাইনি, এখানে তা পেলাম। কূয়োর ব্যাঙ আমি যেন পুকুর থেকে দিঘিতে এসে পড়লাম।

 

আমার জীবনে প্রথম পরিবর্তন এসেছিল ওপার ছেড়ে এপারে এসে। এপারের মফস্বলি পরিবেশের মানুষজনদের সঙ্গে মিলে মিশে। এবারকার পরিবর্তন সর্বদিক থেকেই উন্নত, কলকাতা এবং কলকাতায় স্থায়ী বসবাসকারী পরিবারের ছাত্রবন্ধুদের সান্নিধ্যে এসে। আদিতে উত্তর বঙ্গের হাকিম পাড়ার হলেও সেসময়ে দমদমের নৃপেন মজুমদার, কসবার কালিদাস মিত্র, ঢাকুরিয়া সেলিমপুরের মানস দাসগুপ্ত, যাদবপুরের মানব দত্ত, আদিতে শিয়াখালার হলেও সেসময় হ্যারিসেন রোডের আবদুর রহিম, কলেজ স্ট্রীট, রাজা লেনের দিলীপ সেনগুপ্ত, রঘুনাথ কুন্ডু, এন্টালির অমিত গুহ, প্রতাপ শর্মা, নিউআলিপুর, টালিগঞ্জের বিকাশ ভট্টাচার্য, মেদিনীপুরের বীরেণ মহান্তি.... দের পরিবারের আরও একজন সন্তান হয়ে উঠলাম আমি। প্রভাবিত হলাম এই বাংলার আচার আচরণ মন মানসিকতায়।

 

ভাগ্য - তাড়িত বলেই ইন্টারমিডিয়েট তথা আই পরীক্ষায় বাংলায় আশাতীত অভাবনীয় নম্বর পেলাম। সেসময় এখনকার মতো সকলেই কোনও না কোনও বিষয়ে অনার্স নিয়ে পড়তো না। অনার্স নিয়ে পড়তে উচ্চ নম্বর পাওয়া জরুরি ছিল। বাংলায় অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হতে ভর্তি হলাম।

এই দু'বছর আমার জীবন নানা ঘটনায় সবিশেষ বর্ণময় বৈচিত্র্যময়।


- প্রভাস ভদ্র

পর্যায়ক্রমিক ছবি


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url