ভাগ্য-তাড়িত জীবন-কথা (পর্ব-চার) - প্রভাস ভদ্র
শীতের পুকুরের জলে
নামা আমাদের জীবন শুরু হয় সে সময়কার কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেনের রেল ষ্টেশনের ধারের এক
পল্লীতে। পরের দু'কামরা ঘরের ভাড়ার বাসা ছিল বার্মা সেলের তেলের ডিপো আর একাধিক
চটকলের জন্য বিখ্যাত বজবজ রোডের ধারে।
নতুন বাসা বাড়ির
সঙ্গে আমাদের স্কুলও পরিবর্তন হয়েছিল বজবজের আরও সন্নিকটের সারাঙ্গাবাদে। পায়ে
হেঁটে যাতায়াতে তিন মাইল দূরত্বে। সেসময় পায়ে হেঁটে স্কুল যাতায়াত ধনী গরীব সকলেরই
অভ্যাস ছিল। এটা কোনও বিশেষ উল্লেখযোগ্য তখনই হয়, যখন কোনও ব্যক্তি সেলিব্রিটি হন
তখন তাঁর জীবন কথা লিখতে।
এই সময়টাতে আমরা এসে
পড়লাম ৯০% পূর্ববঙ্গীয়র সান্নিধ্য থেকে একই সংখ্যক পশ্চিমবঙ্গীয় মানুষদের মধ্যে। মানতে
হবে, ওরা কিন্তু আমাদের অতি সহজেই আপন করে নিয়েছিল। সারা পশ্চিমবঙ্গেই তাই। বাঙাল
ঘটি ব্যাপারটা ছিল, একমাত্র ইষ্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের ফুটবল খেলার সময়ে।
অনায়াসে ওপারের টানা টানা বাঙাল ভাষায় কথা বলা যেতো। পারতপক্ষে বন্ধু জনেরা
উচ্চারণ নিয়ে হাসিঠাট্টা করত না।
আমাদের নতুন স্কুলের
ছাত্র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও সেই এই বঙ্গীয়দেরই আধিক্য হেতু আমরা অতি অল্প সময়েই
এখানকার শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। সেটা আখেরে ভালোই
হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এরা অপেক্ষাকৃত শান্ত মেজাজের এবং সাতে পাঁচে না থাকা ঝুট
ঝামেলা বিহীন সাংসারিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
আমরা যাদের সঙ্গে
থেকে বড় হয়েছি, তারা অধিকাংশরাই ছিল বিলাসবিহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত, তা তারা
প্রভূত বিত্তশালী হলেও। এটাও আমাদের জীবন-প্রভাবে প্লাস পয়েন্ট। কেননা, আমরা তখন
খুবই দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা জীবন যাপনে ছিলাম।
কি রকম দারিদ্র্য? দু'টির
বেশি পোশাক ছিল না প্রথম পর্বে। শীতের চাদর বলতে ছোটদের গায়ে শোভা পেতো মায়ের
ভাঁজ করা শাড়ি। কাঠ কুড়িয়ে শীত সকালে জ্বালিয়ে তাকে ঘিরে বসে উত্তাপ নেয়া সেসময়
সকলেরই প্রচলন থাকায় গরীব আমাদেরও কোনও সঙ্কোচ বোধের ব্যাপার ছিল না।
আর খাওয়া ভোজন
আহারাদি? এই বঙ্গের মানুষদের দৈনন্দিন খাদ্যে ওটা ছিল অতি সাধারণ। তাই ওপারের
পেটুক ভোজন প্রিয় আমরা যে আগের মতো খেতে পারছি না তা ওরা টেরই পেতো না। আমরা
ভাগ্য-তাড়িত হয়ে দিন যাপনে কতটা যে বদলে গেছি, তাও ওরা বুঝত পারতো না।
শীতের পুকুরে নামার
সময় বড়দি আর স্কুলে ভর্তি হয়নি সংসারের দিকে তাকিয়ে। ওপারের মানুষেরা সেলাই শিল্পে
সুনিপুনা ছোট্ট বয়স থেকেই। শৈল্পিক দৃষ্টিনন্দন কাঁথা সেলাই ছিল, সারা ভারতে
অন্যতম। বড়দি সেলাইকেই বৃত্তি হিসেবে গ্রহন করেছিল। পরবর্তীতে বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত
বড়দি সেলাই শিক্ষিকা ছিল একটি বালিকা বিদ্যালয়ে।
আমি আর মেজদা
বাচ্চাদের পড়াতাম স্কুল জীবন থেকেই। মেধায় শ্রেষ্ঠ বড়দা উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের
পড়াত।
আমাদের সময় দশ
ক্লাসের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। তারপর কলেজ পড়া ২ বছরের ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে শুরু।
নতুন স্কুলে সপ্তম
শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে আমার ছাত্র জীবনে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসেছিল। সেটা হলো, পূর্বকার
স্কুলে শ্রেণীর প্রথম বেঞ্চিতে বসতাম। হেডস্যার সহ অধিকাংশ শিক্ষকরাই ছিলেন ওপার
বাংলার। অনেকেরই পড়ানোর ধরনটা ছিল এমনই যে, শুনেই আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। অনেক
শিক্ষকের পড়া বাড়িতে বই খুলে আর পড়তেই হতো না আমার।
কিন্তু নতুন স্কুলে
প্রথম বেঞ্চে বসায় সমস্যা হলো। একেতো নতুন ছাত্র আমি। তারপর আবার বাঙাল। পিছন থেকে
চুল, জামা ধরে টান। জামায় কালি ছিঁটুনি। ল্যাঙ মারা ইত্যাদি ইত্যাদি করা ছাত্রদের
সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই হলো। ফলশ্রুতিতে সেই যে ওদের সঙ্গে ক্লাসের পিছনের দিকের
বেঞ্চিতে বসা শুরু হলো, কলেজ ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত সেটাই বজায় ছিল।
আমার স্পষ্ট মনে আছে,
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পূর্বেকার শেষ ক্লাসের শিক্ষক ক'জন ছাত্রের দিকে আঙুল তুলে
জিগ্যেস করেছিলেন, ভবিষ্যতে কে কি হতে চায়। নানা জনে নানা উচ্চ শ্রেণীর রঙীন
স্বপ্নের বৃত্তির কথা বললেও একমাত্র আমি বলেছিলাম, জানিনা স্যার।
কেননা, সত্যি সত্যি
জানতাম না, সংগ্রামী জীবনে আমরা কে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো। আমাদের কারও কোনও স্বপ্ন
দেখাও ছিল না সেসময়।
বড়দা দিনে পার্টটাইম
একটা কাজ করে কলকাতায় নাইট কলেজে পড়ত। মেজদা কলেজ ফিরে ট্যুইশানি করে ফিরত। মেজদা
আর আমি অল্প বয়স থেকেই তালিম না নিয়েও ভালো ছবি আঁকতাম। পরবর্তীতে প্রতিমা তৈরি
করতে শিখেছিলাম। কিন্তু প্রতিমা শিল্পকে বৃত্তি করিনি। কিন্তু
সেসময় ছবি আঁকা বিয়ের
পিড়ি কুলো আর আলপনা রেডিমেড পাওয়া শুরু হয়নি। মেজদা আমার চাহিদা ছিল। চাহিদা ছিল, পোস্টার
ব্যানার দোকানের সাইনবোর্ড লেখার। এমন কি নতুন ছায়াছবি উদ্বোধন পূর্বে হলের সামনে
বোর্ডে প্রচলিত ছবির নাম লেখার বরাতও পেতাম। কলেজ জীবন লটারির টিকিট আর প্রথম
বাজারে আসা বিভিন্ন রকমের চাইনিজ পেনও বিক্রি করতাম। ট্যুইশানিতো ছিলই।
আমার কলেজ পড়াটা
নিতান্তই ভাগ্য-তাড়িত।