একটি রোম্যান্টিক রম্য গল্প – বিপ্লব বাঙ্গাল


হরির চায়ের দোকানে প্রতিদিনের আড্ডা। শীতের রাত, নয়টা বাজতেই চারদিক শুনশান, ঘন কুয়াশায় ঢাকা। এরই মধ্যে চলছিল জগা'দার ভূতের গল্প। জগা'দা মানে আমাদের জগন্নাথ মিত্র, তিন নম্বর ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে নিয়ে জানাল- 

"মহিম সরকার আর কুতুব লস্কর ছিল 'হরিহরাত্মা'। সেই প্রাইমারির বন্ধু... আমার সাথেই পড়ত। বড় হয়ে তক এহেন দুষ্কর্ম নেই যা তারা একসাথে করেনি। একই মেয়ের সাথে প্রেম করা থেকে একই শুঁড়িখানায়, একই বোতল থেকে একটাই গ্লাসে মাল ঢেলে খাওয়া... সবেতেই একে অপরের সঙ্গী। দেখতে দুজনই তামীল সিনেমার ভিলেনের মত। মহিমের কপাল থেকে ডানগাল পর্যন্ত লম্বা লাল জড়ুল। ওদিকে কুতুব লস্করের শরীর কুম্ভকর্ণের মত। আর মোটা জোড়া ভ্রূ তার কপালকে মুখমণ্ডল থেকে আলাদা করে রেখেছে।"

"ভূতের গল্পে চেহারার বর্ণনা কি খুবই জরুরি? আসল গল্প কখন আসবে?" -পরিতোষের গলায় উৎসাহ ঝরে পড়ে।

"গল্প শুনতে গেলে ধৈর্য রাখতে হবে।" -বলেন জগা'দা।

"একদিন মহিম এসে কুতুবকে বলল, ভাই, অনেক হল ব্যাচেলর জীবনের ব্যভিচার। এবার চল বিয়েটা সেরে ফেলে সংসারী হয়ে যাই। কুতুব কিন্তু কিন্তু করেও এই শর্তে রাজি হল যে বিয়ের পর বৌদের সংসারে ব্যস্ত করে দিয়ে আবার তারা ফিরে আসবে তাদের রোজকার জীবনযাপনে।"

চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলতে থাকেন জগা'দা-

"দুচারদিনের ব্যবধানে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। মহিমের বৌকে দেখে কুতুব বলল, গুরু, কী ফাটাফাটি মাল জুটিয়েছ! জবাবে মহিম শুধু ফোঁৎ করে শব্দ করল। বোঝা গেল, বৌ তার পছন্দ হয়নি। কুতুবের বিয়ের দিন তার বৌকে দেখে মহিমের গলায় প্রশংসার ঝড়... কিন্তু নিরুত্তাপ কুতুবের চেহারায় অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।"

"তারপর?" -প্রশ্ন করে পিন্টু।

"বিয়ের পর দুজনে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে তাদের দুই বন্ধুর মধ্যে যে সখ্য, তার বিন্দুমাত্র তাদের বৌদের মধ্যে গড়ে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই। উল্টো মহিমের বৌ রাতে অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহূর্তে কুতুবের বৌয়ের নামে যা নয় তাই অপবাদ দিতে থাকে আর মহিম তাতে সহমত জ্ঞাপন না করলেই বৌয়ের প্যারাসিটামলখেকো মাথাব্যথা আরম্ভ হয়। ওদিকে বিশেষ বিশেষ ঋতুতে কুতুব যখন শয্যায় বৌকে কাছে টানে, তখনই তার বৌয়ের মুখে মহিমের বৌয়ের নামে কুৎসিত বিশেষণ বর্ষিত হয়... আর তাতে কুতুব সহমত জ্ঞাপন না করলে সেই রাতে তাকে শয্যা ছেড়ে মেঝেতে নিদ্রা যেতে হয়।"

"ভারী অন্যায়... এসব শুনলে পুরুষ মানুষের বিয়ের প্রতি কোন আকর্ষণই আর থাকবেনা" -অভিমত প্রকাশ করে পরিতোষ।

জগা'দার গল্প চলতেই থাকে। "এইভাবে দুই জিগরি দোস্ত মহিম আর কুতুবের সম্পর্কেও শীতলতা এসে পড়ে। মাসের পর মাস তাদের দেখাদেখিও হয় না। কেটে যায় বছর দুয়েক। তারপরেই হঠাৎ একদিন একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে মহিম হাজির হয় কুতুবের হার্ডওয়ারের দোকানে। চিৎকার করে বলে, "গুরু, দোকানের শাটার নামা। আজ সেলিব্রেশন হবে। বাচ্চা হবে বৌয়ের। শ্লা এতদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। আগামী কয়েকটা বছর বাচ্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে সে।"

এর দিনকয়েক পরে কুতুব এসে হাজির মহিমের গ্যারেজে। মহিমকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসিফিসিয়ে বলে, "গাড়িতে একটা জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল আছে বস। হেঁ হেঁ... আমিও বাপ হতে চলেছি যে। এখন কয়েকটা বছর বৌ জ্বালাতন করার সময়ই পাবেনা। আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়..."

"আরে ধুর, আপনাকে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কে চালাতে বলেছে! গল্পটা শেষ করুন না।" -পিন্টুর তর আর সয় না।

"বেশি বকিসনা। মাত্র তিন কাপ চায়ে পুরোটা বলা যাবে না। হরিকে দোকান বন্ধের আগে আরেক রাউন্ড লাগাতে বল" -জগা'দার সাফ জবাব।

আরেক রাউন্ড চা রেডি হতে থাকে এদিকে গল্পও এগোতে থাকে।

"বাচ্চা হওয়ার মাস দুয়েক আগে দুজনেরই বৌ বাপের বাড়ি রওনা দেয়। দুই বন্ধু আবার সেই ব্যাচেলর জীবনের স্মৃতি ফিরে পায় যেন। আশ মিটিয়ে চলতে থাকে মদ্যপান... যাওয়া আসা চলে বিভিন্ন প্রমোদ ভবনে।"

এরই মাঝে চা চলে আসে। ধোঁয়া ওঠা কাপে ঠোঁট লাগিয়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে জগা'দা বলতে থাকে... "একদিন মহিম খবর পায় যে তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। ওদিকে কুতুবও ফোনে জানায় যে তার বৌ একটি ফুটফুটে পুত্রের জন্ম দিয়েছে। মহিম গাড়িতে স্টার্ট দেয়। শ্বশুরবাড়ি পোঁছতেই কোলে তুলে নেয় তার মেয়েকে। মেয়েটা তার মায়ের মতই ফর্সা... দিব্যি ওঁয়া ওঁয়া করছে... কিন্তু তার পরেও কেন যেন মনে হচ্ছে যে কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গেছে... হিসেব মিলছে না। ওদিকে কুতুবও তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আদর করছিল। তার ছেলেটাও মায়ের দিকেই গেছে... চোখ বুজিয়ে মিষ্টি হেসে আড়মোড়া ভাঙছে... কিন্তু তবুও কুতুবের মনে হল যে হিসেবে নিশ্চয় কিছু গরমিল আছে।

সারাটা দিন শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে মহিম বাড়ির দিকে রওনা দিল। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎই তার মটকাটা কেমন যেন গরম হয়ে উঠল। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির বদলে কুতুবের বাড়ির দিকে চলল। কুতুব সদর দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিল... দরজার পাশে পড়ে থাকা একটা মোটা লোহার রড তুলে নিয়ে মহিম আচমকাই আঘাত করে বসল কুতুবের কপালে... একেবারে জোড়া ভ্রূর ঠিক মাঝখানে। সেই জোড়া ভ্রূ, যা সে একটু আগেই দেখে এসেছে তার নিজের সদ্যোজাত মেয়ের কপালে।

"জোড়া ভ্রূ আছে তো কী হয়েছে?" -আমার নিরীহ প্রশ্ন।

"কিছুই হয়নি... কিন্তু বদলোকের মন মহিমের... কখন কী ভেবে বসে কে জানে! সে যাই হোক। অমন মোটা রডের বাড়ি খেয়ে কুতুবের প্রাণ পাখি সেখানেই পগারপার। বুদ্ধিমান মহিম কোন রিস্ক নেয়নি। লোকজন টের পাওয়ার আগেই কুতুবের লাশ তারই বাড়ির পিছনের বাগানে পুঁতে হাত পা ধুয়ে গাড়ি নিয়ে সটান নিজের বাড়ি।"

"বাপ্রে! এ তো পাক্কা ক্রিমিনালের কাজ।" -পরিতোষ জানায়।

"এদিকে মহিম বাড়ি ফিরে গাড়িটা গ্যারেজে ঢোকাতে গিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে ওঠে। একটু আগে যে কুতুবকে সে নিজের হাতে মাটিতে কবর দিয়ে এসেছে, সেই কুতুব অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে একটা বেলচা দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছে। পাশেই পড়ে রয়েছে একটা মাঝবয়েসী পুরুষের লাশ... আঘাতে জর্জরিত হলেও সেই লাশের কপাল থেকে ডান গাল পর্যন্ত বিস্তৃত লাল জড়ুলখানা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে।"

"আরিব্বাস! কী বলছেন আপনি" -পিন্টুর রুদ্ধশ্বাস প্রশ্ন।

জগা'দা বলে চলেন, "হ্যাঁ, কুতুবের ছেলেরও কপাল থেকে ডান গাল পর্যন্ত বিস্তৃত লাল জড়ুল ছিল যে।"

"তারপর?" -আমার প্রশ্ন।

"তারপর আর কী? দুজনেই শহর ছেড়ে একসাথে নিরুদ্দেশের পথে রওনা দিল।"

"কিন্তু এসব কীভাবে সম্ভব?" -জানতে চাই আমি।

"দুনিয়ার সব কিছু কি আর ব্যাখ্যা করা যায় রে! চল ওঠ, বাড়ি ফেরা যাক। হরির বিলটা কেউ মিটিয়ে দে... আজ ঠান্ডাটাও জমিয়ে নেমেছে।"

লেখাঃ বিপ্লব কুমার দে


বিপ্লব বাঙ্গাল

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url