“আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন!”

 

ছবিঃ প্রতীকী


প্রায়শঃ একটা শ্লোগান শোনা যায়, “ আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই”। শ্লোগানটা প্রথম আসে জামাতে ইসলামি দলের পক্ষ থেকে। এক শ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, বিশেষ করে যুবক শ্রেণীর মধ্যে বুঝে হোক না বুঝে হোক
শ্লোগানটা এখনও উচ্চারিত হয়। ফেসবুকে, ইউটিউবে জামাতের কিংবা জামাত ঘেষা কোনো লোকের পোষ্ট পেলেই এই শ্রেণীর বেশিরভাগ মানুষ এই বাক্য দিয়ে মন্তব্য করে থাকে। চলুন দেখা যাক রাষ্ট্র পরিচালনায় আল্লাহর আইন কখন, কোথা্‌য়, কিভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়িত হয়েছে।


“ইসলাম প্রতিষ্টার নামে যারা আব্বাসীয়, ওসমানীয় বা উমাইয়া প্রশাসনের আইন হুবহু বাস্তবায়ন করতে চান, কিছু পোশাকী রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথকে দূর্গম করে তুলছেন।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হিজাব-নিকাব বাধ্যতামূলক করা, ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করা, ভিন্ন মতাবলম্বীদের মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে শিরোচ্ছেদ করাকে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা মনে করেন তারা ইসলামকে নতুন প্রজন্মের কাছে কঠিন ও দুর্বোধ্য করে তুলছেন। এ কথাগুলো যারা বলছেন তাদের কোরআনের মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে কোনো ধারণা তো নেইই, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই।

রাষ্ট্রের গতিশীলতা, দ্রুত পরিবর্তণশীল বিশ্বব্যবস্থায় নাগরিকদের নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে রাষ্ট্রকে কতো হাজার বিষয় বিবেচনায় নিতে হয় তা আমাদের ইসলাম্পন্থী দলগুলোর কল্পনারও বাইরে। কারণ রাষ্ট্র কিভাবে চলে তা তাদের ‘সিলেবাসেই’ নাই। তাদের সিলেবাসে আছে হাদিসের প্রসিদ্ধ ৬ টি কিতাব এবং ইমাম আবু হানীফার “ফতহুল আকবর” থেকে শুরু করে “ফতোয়া-ই-আলমগীরী” পর্যন্ত ডজনখানেক ফতোয়ার কিতাব। যেগুলোর সাথে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কোনো সম্পর্কই নাই। এসব ফতোয়া প্রণয়ন ও হাদিস সংগ্রহ করা হয় উমাইয়া, আব্বাসীয় সরকারের প্রণীত আইন ও তার রেফারেন্স হিসাবে। অথচ…

ইমাম আবু হানীফার অনেক বিধান খলিফা আল মনসুরের পছন্দ না হওয়ায় খলিফার রোষালনে পড়ে জীবন দিতে হয়েছে ইমাম আবু হানীফাকে। তবে পরবর্তীতে অনেক খলিফা ইমাম আবু হানীফার অনেক আইন কার্যকর করেন। কিন্তু স্বয়ং আবু হানীফা বেঁচে থাকলে “ফিকহুল আকবর” হয়তো নতুন করে লিখতেন। অথচ আমাদের মুফতি সাহেবরা ১২০০ বছর আগের ইমামদের প্রণীত শারীয়া আইন পড়েন এবং তা হুবহু বাস্তবায়ন করার দাবী তোলেন। এই হাজার বছরের ব্যবধানে পৃথিবী কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে হুঁশ আমাদের নাই। তখনকার শারীয়া আইনের সাথে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো যোগসূত্রই নাই।

রাষ্ট্র চলছে রাষ্ট্রের মতো। উমাইয়া আমলের শারীয়া আইন পড়ে কি হবে? এসব আইন প্রয়োগ করবে কে? কেনো করবে? রাষ্ট্রতো শারীয়া ভিত্তিক নয়। এমনকি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেও কোরআনের মূলনীতির মধ্যে থেকেই এখনকার প্রয়োজন ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু সময়োপযোগী ইসলামী আইন বানানোর সামর্থ আমাদের আলেমদের আছে? সে মানসিকতাই তো নাই। আমরা আছি “ব্যাক গিয়ারে”। মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের খাজনা ও মৌলিক অধিকার কাঠামোর বাইরে আমরা যেতে পারছি না।

বাংলাদেশের ইসলাম্পন্থী দলগুলোর হাতে ক্ষমতা দিলে তারা দুইদিনও দেশ চালাতে পারবে না। কারণ দেশ কিভাবে চলে তার ধারণা, অভিজ্ঞতা, ট্রেনিং সর্বোপরি মনোভাবই তাদের নাই। ইসলাম কায়েম করতে চাইলেও আইন বানানোর জন্য ‘আইন বিশারদদের লাগবে! দাড়ি, পাগড়ি, পাঞ্জাবী পরিয়ে তাকেই গ্র্যান্ড মুফতি বানাতে হবে। সে আইন প্রণয়ণের জন্য এখনকার সচিব, আইজিপি বা জেনারেলদেরই লাগবে।

আপনি বড়জোর একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে তাদের ইউনিফরম বদলে দিতে পারবেন যে; ‘এখন থেকে মহিলারা নিকাব আর পুরুষরা পাঞ্জাবী, পাগড়ি পরে সচিবালয়ে আসবেন’! অবশ্য প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে না। তখন কে কার চেয়ে বড় ‘দরবেশ’ তা প্রমাণের জন্য প্রতিযোগিতায় নামবেন আমলারা! সবাই রাতারাতি হুজুরের বেশ ধরবেন! দেখতে মনে হবে হুজুররা দেশ চালাচ্ছে, কিন্তু আসলে তা না।

 

ইরান আফগানিস্তানে দাড়ি, পাগড়ি পরা পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা কওমী মাদ্রাসার হুজুর না। এরা হাই প্রোফাইল ডিপ্লম্যাট, ইকোনোমিষ্ট ও মিলিটারি জেনারেল। শুধু হুজুরের বেশ ধরা।

সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি, মসজিদে নববীর ইমাম- আমাদের হুজুরদের মতো ‘টেলিগ্রাম অফিসের’ কর্মকর্তা না। তারা কার্যত জাতীয় সংসদের স্পীকার বা প্রধান বিচারপতি। শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অনুযায়ীই তাদের এ পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

শুধু নামাজের ইমামতি করতে পারলেই প্রধান বিচারপতি হওয়া যায় না। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও বা এসি ল্যান্ডকে ইমামতি শেখাতে সময় লাগবে না। কিন্তু ইমাম সাহেবকে দিয়ে জেলা চালাতে পারবেন না। উনি নিজেই রিজাইন দিয়ে চলে যাবেন। কারণ ওনার গিয়ার চেঞ্জ করতেই আরো ২০০ বছর লাগবে। এমনটা বলেছেনও বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে, “আমরা প্রথম গিয়ার দিয়ে চেষ্টা করছি, যে এটা(দেশ) চলে কিনা! তারপর আস্তে আস্তে দ্বিতীয়, তৃতীয় গিয়ারে যাবো”! অথচ প্রযুক্তি যে আরো এগিয়ে, গিয়ার যে এখন পঞ্চম পেরিয়ে স্বয়ংক্রিয় হয়ে গেছে তা তার ধারণায়ই নাই।
 

ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেকের মতো স্কলাররা আমাদের মুফতি, মুহাদ্দিসদের মতো ‘নিধিরাম সরদার’ ছিলেন না। তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ছিলেন। তারা তাদের সময়ের সেরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীও ছিলেন। তারা তখনকার রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থার প্রয়োজনানুযায়ী কোরআনভিত্তিক আইন প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু সেসব আইন যারা এখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রে অবিকল প্রয়োগ করতে চান; ‘তাদের ধারণাই নাই, তারা কি বলছেন’।

ভাইসাহেব, এখন দ্বিতীয়ার্ধের খেলা চলছে, আগের গোলপোষ্টে বল দিলে তা আত্মঘাতী গোল হবে। এবং এই আত্মঘাতী গোলই দিচ্ছেন আমাদের বর্তমান ‘সুপারস্টাররা’, ‘মাস্টারমাইন্ডরা’।

এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় শারীয়া আইনকে ইসলাম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার কারণেই ইসলাম ধর্ম নতুন প্রজন্মের কাছে ‘গেলার অযোগ্য ঢেঁকি’তে পরিণত হয়েছে। প্রচন্ড ধর্মপ্রাণ মানুষও ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বিজ্ঞানসম্মত মনে করে। তারাও ইসলামী দলের ম্যানুফেস্টোতে ভরসা রাখতে পারে না। আর পারেনা বলেই বৃটিশদের কাছ থাকে স্বাধীনতালাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের কোনো দেশে ইসলাম্পন্থী দলগুলো ১০ শতাংশের বেশি জনসমর্থন আদায় করতে পারেনি। অর্থাৎ তাদের শঠতা, হটকারীতা ও মিথ্যাশ্রয়ী কথাবার্তায় এটা প্রমানিত যে, তারা আসলে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করে। মানুষকে ধোকা দিয়ে যেনতেনভাব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে এটা আরো পরিস্কার হয়ে ফুটে উঠেছে।

 

অবশ্য এসব কথার সাথে আপনাকে একমত হতে হবে বলছি না। কিন্তু সত্যতা যাচাই করতে পারবেন খুব সহজেই। আজকাল ইন্টারনেটের যুগে শুধু গুগলকে জিজ্ঞেস করলেই পাবেন, ‘আমি অমুক বিষয়টা জানতে চাই’- গুগল সাথে সামনে হাজির করবে। পড়ে দেখুন। বাস্তবতা উপলব্ধি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিন।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url