শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের ইতিহাস!
ছবি: প্রতীকী |
মক্কায় কুরাইশদের প্রতিষ্ঠাতা কুসাই ইবন কিলাবের তিনজন ছেলে ছিলো; আবদ আদ ধার, আবদ উজ্জাহ ও আবদ মানাফ। আবদ মানাফ ইবন কুসাইয়ের ছিলো চারটা ছেলে সন্তান; আবদ হাশিম ইবন মানাফ, আবদ মুত্তামিব ইবন মানাফ, আবদ শামস ইবন মানাফ ও আবদ নওফেল ইবন মানাফ। মানাফ আরব অঞ্চলের দেবতার নাম। তার মূর্তি নিয়ে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে সিরিয়ায় পুজা করা হইত।
আবদ উজ্জাহ ছিলেন আবদ মানাফ ইবন কুসাইয়ের আপন চাচাতো ভাই। তার ছেলের নাম ছিলো আসাদ। এই আসাদের নামানুসারেই মূলত আসাদ গোত্রের জন্ম। আসাদের আবার ছিলো তিন ছেলে; নওফেল, হুয়াইরাথ ও খুয়াইলিদ। নওফেলের ছেলে ওয়ারাকা ইবন নওফেল, হুয়াইরাথের ছেলে উসমান ইবন হুয়াইরাথ এবং খুয়াইলিদের মেয়ে খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ। আসাদ গোত্রের পরিচয় জানাটা এই জন্য জরুরি যে পরবর্তীতে এই আসাদ গোত্রের খাদিজার সাথেই ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মাদের বিবাহ হয়।
আবদ মানাফের চার সন্তানের মধ্যে আবদ হাসিম ইবন আব্দ মুনাফ ও আব্দ মুত্তালিব ইবন আব্দ মুনাফ এক পক্ষে ছিলেন, তাদের সাথে সয়ায়ক পক্ষ হিসেবে ছিলেন চাচাতো ভাই আসাদ ইবন উজ্জাহ। আব্দ হাশিম ইবন আব্দ মানাফ থেকেই মূলত বনু হাশেমি গোত্রের উদ্ভব। অন্য দিকে আব্দ নওফেল ইবন মানাফ ও শামস ইবন মানাফ ছিলেন একপক্ষে। আপন ভাইদের এই দুই গ্রুপের মধ্যে ছিলো তুমুল মারামারি। পরবর্তীতে সেই মারামারি উমাইয়াদ ইবন আব্দ শামসের সাথে হাশেমি'তে গড়ায়। যাকে চাচা ভাতিজার মধ্যে দ্বন্দ্ব বলে পরিচিত।
উমাইয়ার ছেলে হার্ব, তার ছেলে আবু সুফিয়ান। অর্থাৎ তার পুরো নাম ছিলো আবু সুফিয়ান ইবন হার্ব ইবন উমাইয়া ইবন শামস ইবন আব্দ মানাফ। অন্য দিকে আব্দ মানাফের আরেক ছেলে হাশেমি বিয়ে করেছিল বর্তমান মদিনায় ও সেই সময়ের ইরিত্রিয়ার একজন ইহুদী গোত্রের মেয়েকে। তার ছেলের বয়স যখন আট বছর তখন তিনি সিরিয়া থেকে বানিজ্য কাফেলা নিয়ে ফেরার পথে মারা যায়। হাশেমির মৃত্যুর পর তার সদ্য বিধবা বউ বাবা হারা সন্তান নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় চলে যায়।
চার বছর পর আব্দ মুত্তালিব ইবন আব্দ মানাফ মদিনায় তার ভাইয়ের বউকে দেখতে যায়। আব্দ হাশেমির ইবন মানাফের ছেলের বয়স তখন বারো। ভাবী'কে বলে বারো বছরের ভাতিজা'কে সাথে নিয়ে তিনি মক্কায় আসেন। আব্দ মুত্তালিবের কাছে থেকে ভাই হাশিমির ছেলে বড় হচ্ছিল, অথচ সবাই তাকে চিনতো এইটা আব্দ মুত্তালিব ইবন মানাফের দাস। তাই তাকে ডাকত আব্দুল মুত্তালিব অর্থাৎ মুত্তালিবের দাস বলে। হাশিম ইবন আব্দ মানাফের ছেলে মক্কায় সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠল আব্দুল মুত্তালিব নামে।।
হাশিমি ইবন আব্দ মানাফ মারা যাওয়ায় উমাইয়াদ ও হাশিমি গোত্রের মধ্যে ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বে কিছুটা ভাটা পড়ে, তবে চিরতরে বীলিন হয়ে যায় নাই। মাঝেমধ্যেই তাদের মধ্যে সে দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। ফলে আসাদ গোত্রের সাথে তাদের সম্পর্ক কখনই ছিন্ন হয় নাই। যার প্রমাণ মেলে ৫৮৭ খৃষ্টাব্দে আসাদ গোত্রের সাথে অন্য আরেক গোত্রের লাগা যুদ্ধে, যা ফিজোরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। আব্দুল মুত্তালিব চারখানা সাদী করেন, পাশাপাশি একখানা দাসীও রাখেন। এই চার বিবি ও দাসীর গড়ে জন্ম নেওয়া সবাই বনু হাশিম গোত্র।
আব্দুল মুত্তালিবের চার বিবির মোট দশটা ছেলে সন্তান ছিলো, আর দাসীর ঘরে একজনই ছেলে সন্তান ছিলো যার নাম ছিলো আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব। মুত্তালিবের এগারো খানা ছেলে সন্তান হওয়ার সুবাদে মক্কায় তিনি সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। উমাইয়াদের সাথে তার মৃত বাবার ক্ষমতার যে দ্বন্দ্ব ছিলো তার সকল দায়ভার যেনো তারই অগোচরে বা গোচরে তার কাঁধে এসে পড়ছিল। ফলে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে সেই সময়ের লেটেস্ট এক ইশ্বরবাদী ধর্ম খৃষ্টান জেনারেল আবরারের মক্কা আক্রমণ ও কাবার মধ্যে ৩৬০টা মূর্তি বাঁচাইতে আল্লা নির্দেশনা অনুযায়ী আবাবিল পাখীর পাথর ছুড়ে মারা নিয়ে একপ্রকার ধোয়াশা থেকেই যায়।
আব্দ মুত্তালিব তার ছেলে আব্দুল্লাহ কে বিয়ে দিতে তায়েফে নিয়ে যান। সেখানে মা আমিনার সাথে আব্দুল্লাহ এর বিয়ে দিতে গিয়ে তার আরেক বোন'কে নিজেও বিয়ে করে নেন। সেই পক্ষের ছেলে হামজা। হামজা ইবন আব্দুল মুত্তালিব একাধারে তাই ইসলামের নবী মুহাম্মাদের আপন খালাতো ভাই ও চাচা। ইসলামের নবী মুহাম্মাদের পুরো নাম তাহলে দাঁড়ায় মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুত্তালিব ইবন হাশিম ইবন মুনাফ। মুহাম্মাদ ও তার আঠারো বছরের শত্রু আবু সুফিয়ান তাহলে তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। যাদের সাথে আসলে অতীত থেকেই একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিলো।।
আব্দুল মুত্তালিব ইবন হাশিমের আরেক ছেলে আবু তালিব। আবু তালিবের ছেলে আলী ইবন আবু তালিব একাধারে মুহাম্মাদের চাচাতো ভাই ও মেয়ের জামাই। আলী ও মুহাম্মদ উভয়ই কিন্তু বনু হাশিম। মুহাম্মাদের মৃত্যুর পর আলীর বিরুদ্ধে বাকিদের ষড়যন্ত্র চোখে পড়ার মতো। ফাতিমা নিজেও জীবন দেয় সেই কোন্দলের বলি হয়ে। মুহাম্মাদের চাচাতো ভাই ও মেয়ে জামাই আলীর বিপক্ষে আবু বকর, উমর, উসমান, মুয়বিয়া সবাই। মুয়াবিয়া মূলত আবু সুফিয়ানের ছেলে। বদরের যুদ্ধ হইছিলই তো আবু সুফিয়ান ও মুহাম্মাদের বাহিনীর মধ্যে। ওহুদের যুদ্ধে হামজার কলিজা কেটে নিয়েছিল আবু সুফিয়ানের বউ হিন্দ।
চার খলিফার মধ্যে শুধুমাত্র আলী ছিলেন হাশেমি গোত্রের, বাকি তিনজনের মধ্যে উসমান ছিলেন উমাইয়া গোত্রের। উমর ও আবু বকর কুরাইশ হলেও ছোট ছোট অন্য গোত্রের তারা, আব্দ মুনাফের কেউ না। ফলে উসমান খুন হইলে আলীর বিরুদ্ধে আবু সুফিয়ানের ছেলে মুয়াবিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে। সে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণের অপচয় হয়। ফলার মাথায় কুরান ঢুকিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। পরিশেষে তাদের মধ্যে একটা চুক্তির মধ্যে দিয়ে আপোষরফা হয়। সে আপোষরফায় নতুন করে জটিলতা শুরু হয় যখন হাসানকে বিষপানে মারা হয় ও আলী খুন হয়।
শেষ পর্যন্ত আলীর বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে হুসেন আবু সুফিয়ানের নাতী ও মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াজিদের বাহিনীর কাছে কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিহত হন। এককভাবে ক্ষমতা দখল করে ইয়াজিদ অনুসারীরা তথা উমাইয়া বংশ। হুসেনের পরাজয়ের মধ্য দিয়েই আরব ভূমি'তে উমাইয়াদ শাসন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব। শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব তাই নবীর জন্মেরও বহু আগে এবং এই দ্বন্দ্ব কেয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে। তবে আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, এক দিকে মুসলমানরা হুসেনের হত্যা নিয়ে লোক দেখানো আফসোস করে, অন্য দিকে তারা আবার উমাইয়াদের শাসন ব্যবস্থা ফিরাইয়া আনতে চায়।
বাঙালি মুসলমানরা তলারটাও কুড়াবে, আবার গাছেরটাও খাবে। একদিকে সুন্নি হয়ে হুসেনের মৃত্যুতে আফসোস করবে, অন্য দিকে নিজেদের'কে শ্রেষ্ঠ মুসলমান হিসেবে দাবী করবে।
লিখেছেন: আশানুর রহমান খান (Ashanour Rahman Khan)