ধোকাবাজের আস্তানা বেশিদিন টেকে না

 
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি

তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম খলজি উপজাতি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি তুর্কিস্তান থেকে এসে আফগানিস্তানে বসতি স্থাপন করেন। প্রথম জীবনে তিন একজন ভাগ্যান্বেষণী। ঐতিহাসিকদের ধারণামতে তিনি দারিদ্রের পীড়নে স্বদেশ ত্যাগ করেন এবং নিজের কর্মশক্তির উপর নির্ভর করে অন্যান্য অধিবাসীদের ন্যায় ভাগ্যান্বেষণে বের হন।

 

প্রথমে তিনি গজনীর সুলতান ‘মোহাম্মদ ঘুরি’র সেনাবাহিনীতে চাকরির আবেদন করে বিফল হন। গজনীতে চাকরিলাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি দিল্লিতে ‘কুতুবুদ্দিন আইবেকে’র দরবারে হাজির হন। এখানেও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। অতঃপর বুদাউন গমন করেন। সেখানকার শাসনকর্তা ‘মালিক হিজবর উদ্দিন’ বখতিয়ার খলজিকে নগদ বেতনে সেনাবাহিনীতে চাকরি প্রদান করেন।

 

উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার খলজি সামান্য বেতনভুক্ত সিপাহি হয়ে পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুদাউন ত্যাগ করে অযোদ্ধায় গমন করেন। অযোদ্ধার শাসনকর্তা ‘হুসামউদ্দিন’ তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত ভগবৎ ও ভিউলি নামক দুইটি পরগনার জায়গির প্রদান করেন। এখানেই বখতিয়ার খলজি তার ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা খুঁজে পান এবং এ দুটি পরগনাই পরবর্তীকালে তার উথানের সোপান হয়ে ওঠে।

 

 

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৬ সালে মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে হঠাৎ রাজা লক্ষণ সেনের রাজ্য বাংলা আক্রমণ করেন। বখতিয়ার সরাসরি লক্ষ্মণসেনের রাজপ্রাসাদ নদীয়ায় উপস্থিত হন প্রাসাদদ্বারের রক্ষীদের কাছে ঘোড়া বিক্রয়ের জন্যে এসেছেন বলে পরিচয় দিয়ে প্রাসাদের বিতরে প্রবেশ করেন। অতঃপর অতর্কিতভাবে দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করতে থাকেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষ্মণসেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে পালিয়ে যান এবং বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেন

 

অনেকে মনে করেন 'ডাকাত' বখতিয়ার খলজির সাথে মাত্র ১৭জন যোদ্ধা ছিলো, এ তথ্যটি সঠিক নয়! বখতিয়ার খলজি প্রায় ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়ায় লক্ষণসেনের রাজধানী নদিয়ায় পৌঁছার পর তার সাথে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। আর সবাই পেছনে পরে যায়।

 

এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, বখতিয়ার খলজি যখন লক্ষণ সেনের প্রাসাদের মূল গেটের কাছে পৌঁছেন, রাজা লক্ষণসেনের প্রাসাদের দ্বাররক্ষীদেরকে তিনি  ‘ধোকা’ দেন। তিনি নিজেদেরকে ঘোড়া ব্যবসায়ী দল হিসেবে পরিচয় দেন এবং রাজার সাথে দেখা করতে এসেছেন বলে জানান। প্রহরীরা অনায়াসেই তাকে প্রাসাদ এলাকায় ঢুকতে দেয়। ঢুকেই খলজি অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে প্রহরীদের হত্যা করেন।

 

রাজা লক্ষণ সেন তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন! রাজপ্রাসাদের এরূপ অতর্কিত আক্রমণে তিনি পালাতে বাধ্য হন। আর এভাবেই তুর্কি তথা আফগান ‘ডাকাত’ বখতিয়ার খলজি বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন।

 

ঐতিহাসিকের মতে বখতিয়ার খলজি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সমূলে বিনাশ করার অপচেষ্টার অভিযোগ আছে। তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস ও ওই সময়ে সেখানে থাকা সকল ছাত্রকে হত্যা করেন বলেও অ্ভিযোগ আছে।

নালন্দা, বিহার, ইন্ডিয়া


ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এবং তার সহযোদ্ধা সুবাহদার আউলিয়া খান নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যায় সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন (২০ শতকের প্রথম দিকের চিত্র)।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা

বাংলা দখলের পর বখতিয়ার খলজি একই ব তিব্বত আক্রমণ করেন। সেখান থেকে পরাজিত হয়ে বাংলায় ফিরে আসার পথে তিনি খুন হন (ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না)।

 

তিব্বত অভিযান বিফল হলে বখতিয়ার বাংলায় ফিরে আসেন। তিব্বত অভিযান বিফল এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে প্রজাদের মধ্যে বিদ্রোহ ও বিরোধ দেখা দিতে শুরু করে। নানাবিধ চিন্তা এবং পরাজয়ের গ্লানির মানসিক চাপে বখতিয়ার অসুস্থ হয়ে হয়ে পরেন। মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনানুসারে আলী মর্দান খলজি কর্তৃক ছুরিকাঘাতে ১২০৬ সালেই বখতিয়ার ‘নিহত’ হন (লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু)।

 

অতএব, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজিকে 'মহান বিজয়ী বীর' বলে প্রচারিত হলেও প্রকৃত ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী এই লোক ছিলেন একজন ভয়ংকর ‘ধোকাবাজ জঙ্গি’ এবং রাজ্যলোভী খুনি।

 






Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url