ভাগ্য-তাড়িত জীবন-কথা (পর্ব-দুই) - প্রভাস ভদ্র
প্রভাস ভদ্র কিশোর-বর্তমান |
পর্ব-দুই।
*******
আমাদের নয়া বসত অপর
কাকার উত্তরবঙ্গের ইনডং চা বাগান কিন্তু আমার বেশ পছন্দের হলো। পছন্দের নানা
কারণের মধ্যে প্রধানটিই হলো, প্রকৃতি পরিবেশ। দ্বিতীয়ত বাড়িগুলির অধিকাংশেই ছেড়ে
আসা জন্মভূমির টিনের ছাউনিঅলা চার ভিতের ঘর ঘেরা উঠান। তুলসীমঞ্চ। আম জাম কাঠাল
ইত্যাদি গাছ ঘেরা। প্রায় সকলেরই সব্জির বাগান। চা বাগানের মালিক কিন্তু তখনও
বিদেশি সাহেবরাই। সাহেবের বাংলোও দেখার মতো সুন্দর।
কাকার বাগান অফিসের
সকলেই বাঙালি কর্মী। অধিকাংশেরই জন্মও ওপার বাংলায়। অনেকে আবার লতায় পাতায় আত্মীয়ও
বটে। যেমন বাগানবাবু ছিলেন, দূর সম্পর্কের আমার এক মামা। গুদামবাবু, রেশনবাবু
দু'জনেই আমার ওরকমই পিসেমশাই। বাগানের স্কুলের একমাত্র শিক্ষকও ছিলেন আমার
সম্পর্কের জামাইবাবু।
দেশ ভাগের পূর্ব
থেকেই মেটেলি, মালবাজার, শিলিগুড়ি, নাগরাকাটা, লাটাগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি
ইত্যাদিতে বাঙালি এবং তথাকথিত বাঙালদের বিরাট সংখ্যক বসত, ব্যবসা, চাকরি। চেনা
জানা আত্মীয় স্বজনও কম নয়। এদের আচরণ কথাবার্তা পূজা পার্বন অনেকটাই ছেড়ে আসা
আমাদের দেশেরই মতো। এরা অধিকাংশই দ্বিখণ্ডিত হওয়া বাঙালি নয়। তবুও মহানন্দা দিয়ে
দু'দেশীয় বাঙালি করা হয়েছিল। আত্রেয়ী তখন দু'দেশের প্রবাহিত। তিস্তার জল ফারাক্কার
জল নিয়ে দ্বিখণ্ডিত বাঙালির ঝগড়া অন্য ভারতবাসীরা নির্বাক নিশ্চুপ দেখার সুযোগ
পায়নি।
যাক সে কথা। আমিতো
তখনও ছোট। ছোট মুখে বড়দের কথা মানায় না। এখনও যেমন বলতে পারি না, ওপারে জন্মে
এপারে আসা সাহিত্য-ক্ষেত্রের বিখ্যাতরা একে একে গত হওয়ায় বর্তমানে উত্তরবঙ্গে
সীমাবদ্ধ বাংলা সাহিত্য- চর্চা এখনও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায়।
আমি কিন্তু মহা
আনন্দে বেশ চড়েবড়ে খাচ্ছিলাম। কাকা আমার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে স্কুলে ভর্তি করে
দিলেন। তাতেও কোনও অসুবিধা ছিল না চড়েবড়ে আনন্দে থাকায়। সাহেবদের বাগানে নিয়ম
শৃঙ্খলায় পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার নিয়মকানুন কঠোর বলেই সবই ঝা চকচকে।
তখনও বন্য প্রাণী
রক্ষন নিয়ে এতসব নিয়ম কানুন চালু হয়নি। বাগানবাবু মামা বন্দুক আর জনা কয়েক সাঁওতাল
সাহায্যকারী নিয়ে প্রায়ই শিকারে যেতেন। গাছে বসবাস বিশাল বিশাল বনমুরগী অথবা হরিণ
শিকার করে আনতেন। হরিণ হলে পিছনের একটি ঠ্যাং সাহেবদের বাংলোয় যেতো। সুসম মাংস
বন্টিত শিকারের দিনে সাঁওতাল পট্টি থেকে মাদল আর গানের আবছা শব্দ ভেসে আসতো। সেই
বয়সেই আমার বেশ ভালো লাগত। ভালো লাগত, মাঝে মাঝে বড়দের সঙ্গী হয়ে মূর্তি নদীতে
বেড়াতে যাওয়া।
সমস্যা বলতে আমার
একটাই ছিল। সেটা হলো, চা বাগানে তখনও ম্যালেরিয়া লেগেই থাকতো। সেকারণে, ম্যালেরিয়া
হোক না হোক প্রতি সপ্তাহে সবাইকে নিয়মমতে কুইনাইন খেতেই হতো। তিক্ত কুইনাইন খাওয়া
দারুণ কষ্টকর ছিল, আমার কাছে। তবুও খেতাম। খেয়েও নিস্তার নেই। প্রায়ই জ্বর হতো
আমার। সবগুলোই ম্যালেরিয়া নয়। তবুও। প্রায়ই মাকে বলতাম, চলো দাদা দিদিদের কাছে
আবার আমরা ফিরে যাই। এখানে থাকলে আমি আর বাঁচবো না। মরেই যাব।
ভাগ্য-তাড়িত নয়তো
কি!! বেশতো ছিলাম। তবুও বাবা আসার খবরে ওখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে আবারও আমাদেরকে সেই
বাটানগরেই চলে আসতে হলো। মা ও আমরা সকলেই ভেবেছিলাম, আমাদেরকে ফরিদপুরে ফিরিয়ে
নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমন বিশ্বস্ত কোনও লোক না পাওয়ায় স্বয়ং বাবা আমাদেরকে ফিরিয়ে
নিয়ে যেতে এসেছে।
ভুল ভেঙেছিল বাটানগরে
ফিরে এসে। তখন আর বাটানগরে কাকার আদি কোয়ার্টারে নয়। কাকার পদোন্নতি হওয়ায়
নিউল্যান্ড নামে মনোরম বিশাল ভূখন্ডে আরও বড় সুন্দর দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশে
আরও বড় কোয়াটার্সে। নামটাও সুন্দর, নিউল্যান্ড।
চেক সাহেবদের রুচি
ছিল বটে। ছবির মতো সুন্দর সাজানো শহর। ফাঁকা জমি ফেলে রাখা অপছন্দ হেতু তখনও আখ
পাট ধানের চাষ হতো। ছিল, গরু মহিষের ডেয়ারি। বড় বড় দিঘিতে মাছ চাষ করে ছিপে মাছ
ধরার পারমিট দিত। রাস্তাঘাটে বেওয়ারিশ কুকুর বা অন্য পশু দেখলে খোয়াড়ে ভরা হতো। কোনও
কোয়ারটার্সে নির্দিষ্ট বাগান ভূখন্ড ছাড়া অন্যত্র কোনও গাছ লাগালে ফাইন হতো। কিন্তু
আমাদের জন্য আম জাম নারকেল কাঠাল ইত্যাদি ফল খাওয়া ছাড় ছিল। ছাড় ছিল দিঘিতে সাঁতার
স্নান। ছিল, ওপার বাংলার ঘরানায় যাত্রা নাটক কবিগান। ছিল, সাহেবদের সমর্থন আর্থিক
সহযোগিতায় লাইব্রেরি, ক্লাব বাঙালিদের বিভিন্ন পূজা, মেলা। ছিল, সাহিত্য সঙ্গীত ও
বিভিন্ন রকমের খেলার প্রতিযোগিতা, লাইব্রেরি।
দাদারা যে স্কুলের
ছাত্র সেখানে নতুন করে ছাত্রও হলাম। কেননা, বাবাতো আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে
আসেনি।
বাবাকে ফলস্
টেলিগ্রাম করে আনা হয়েছিল, যা আমার মা পর্যন্ত জানত না। আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে
টেলিগ্রাম নয়। ছিল, বরাবরের জন্য এই বঙ্গেই রেখে দেয়ার ফাঁদ পাতা। ফিরে যেতে দিতে
না দেয়ার। যেমনটি আমাদের ক্ষেত্রে করা হয়েছিল, তেমনটি।
সেসময় আসা যাওয়া এবং
বরাবরের জন্য এমন থেকে যাওয়ার এসব সুবিধাগুলি অতি সহজ ছিল বলেই ভিটে মাটি ছেড়ে
এপারে কাতারে কাতারে লোকজন আসতে পেরেছিল অবাধে।
-প্রভাস ভদ্র
পরযায়ক্রমিক ছবি |
(পরের কিস্তি…… পর্ব-তিন)