উদ্বেগ, আতঙ্ক সহ্য করে, নতুন অশান্তি, সীমান্ত সিল করার গুজবের মধ্যে বাংলাদেশী নাগরিকরা বাড়ি ফিরেছেন
সোমবার উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্ত শহর পেট্রাপোলে হিন্দু
সংগঠনের বাংলাদেশ বিরোধী বিক্ষোভ। ছবিঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সৌজন্যে |
বাংলাদেশে অস্থিরতার জেরে চলতি বছরের
জুলাই মাসে পেট্রাপোলের মাধ্যমে রপ্তানি ও আমদানি কয়েক দিনের জন্য বন্ধ ছিল।
তারক মন্ডল তার লাগেজ, একটি ব্যাকপ্যাক এবং দুটি ডাফেল
ব্যাগ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপোল-বেনাপোল চেকপয়েন্টে ইমিগ্রেশন কেন্দ্রের
দিকে নিয়ে গেলেন।
বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাসিন্দা তারক
মন্ডলকে তার দেশের একটি অস্থির পরিস্থিতি এবং শীঘ্রই আন্তর্জাতিক সীমান্ত সিল করার
গুজবের মধ্যে তার চোখের অস্ত্রোপচার না করেই ভারতে তার অবস্থান সংক্ষিপ্ত করতে হয়। তিনি একটি চোখের রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং তাকে অস্ত্রোপচার করতে
বলা হয়েছিল যার জন্য তিনি ভারতে ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বনগাঁওয়ের কাছে ভারতের
বৃহত্তম স্থল বন্দর পেট্রাপোলে অনেক বাংলাদেশী নাগরিক তাদের পরিবার এবং আত্মীয়দের
কাছ থেকে উপর্যুপরি ফোনকল পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য লাইন ধরেছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অব্যাহত হামলার বিরুদ্ধে
প্রতিবাদের প্রধান মুখ হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের পর প্রতিবেশী
দেশে নতুন অশান্তি শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের
অভিযোগে বাংলাদেশ পুলিশ ২৫ নভেম্বর দাসকে গ্রেফতার করে।
একটি দুর্ঘটনায় তারক মন্ডলের চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে
ফেলে। কয়েকদিন আগে ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ) এসে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চোখ
পরীক্ষা করান তিনি। তার চোখের অস্ত্রোপচার
করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলো বলে জানান তারক মন্ডল। সাথে তার শ্যালক প্রবীর মন্ডলও
ছিলেন।
তারক আরো জানান, “বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিঘ্ন। আমি আমার স্ত্রী ও ছেলের ফোন পাচ্ছি, তারা ভয়ে আছে। তাছাড়া
আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সীমান্ত সিল করে দেওয়া হবে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। তাই ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার ভিসা থাকা সত্ত্বেও আমি আমার অস্ত্রোপচার
না করেই তাড়াহুড়ো করে ফিরে যাচ্ছি।” তারক
জানান, তিনি একজন রাজমিস্ত্রি। তার ছেলে ১০ম শ্রেণীতে পড়ে।
কল্পনা ঘোষ (৫৭) এবং তার স্বামী দুলাল চন্দ্র ঘোষ (৬২),
যিনি প্রতিবেশী দেশের ময়মনসিংহ সদর এলাকার বাসিন্দা। তারাও বাড়ি ফিরে যাওয়াদের মধ্যে
ছিলেন। কল্পনা জানান, “গতকাল আমার ছানি অপারেশন হয়েছে। আমি
এখানে ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারতাম। কিন্তু
সেখানে পরিস্থিতি খারাপ এবং আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরতে চাই,”।
শিপ্রা বিশ্বাস, যিনি তার স্বামী বাবুল বিশ্বাসের সাথে
চেকপয়েন্টে সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি বলছিলেন, “আমাদের বাড়ি ভাঙচুর হলে কী হবে? আমাদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন আছে। আমরা এখানে বাংলায় আমাদের আত্মীয়দের সাথে দেখা কমিয়ে দিয়েছি। পরিস্থিতি কিছুটা মিটে যাওয়ার পর আমরা এখানে এসেছি, কিন্তু এখন
আবার ঝামেলা শুরু হয়েছে।” এই দম্পতি বাংলাদেশের যশোর জেলার নড়াইলের বাসিন্দা।
বাংলাদেশের নীলগঞ্জের বাসিন্দা গোপাল দত্ত (৩৬) বলেন,
“আমি তিন মাসের ভিসায় ভারতে বেড়াতে এসেছি। এদিকে
বাংলাদেশের পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আমার পরিবার আমাকে ফিরে যেতে ডাকছে। আমি এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ফিরছি।”
ছেলের চিকিৎসার জন্য বাংলায় থাকা আরেক বাংলাদেশি শাহিনুর
বেগম (৩০) বলেন, “আমি রাজনীতি খুব একটা বুঝি না। কিন্তু যা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। আমার ছেলের চিকিৎসা হয়েছে এবং এখন আমরা বাড়ি ফিরছি। আমার স্বামী এবং আত্মীয়রা চান আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে যাই।“
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, “বাংলাদেশের
প্রতিটি এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আছে এমন নয়। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর কিছু জায়গায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। আমার বেশ কিছু হিন্দু বন্ধু আছে যাদের সাথে আমি কথা বলেছি এবং তারা
ভালো করছে। কিছু এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের হিন্দু বন্ধুদের রক্ষা
করার দায়িত্ব নিয়েছে।”
লিভারের রোগের চিকিৎসার জন্য সোমবার ভারতে আসা সিলেটের
বাসিন্দা রাজদীপ রায় (৩১) বলেন, “আমি সাধারণত বছরে দুইবার ভারতে আসি। কিন্তু এখন বাংলাদেশের মানুষ আগের মতো সহজে ভিসা পাচ্ছে না।”
এদিকে, বাংলাদেশে
“সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের” অভিযোগ নিয়ে সোমবার বিজেপির কর্মী ও সমর্থকরা পেট্রাপোল
চেকপয়েন্টের পাশে একটি এলাকায় একটি সভা করেছে।
তবে দিনের বেলায় রপ্তানি ও আমদানি স্বাভাবিক ছিল।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের
সেক্রেটারি কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “গত সোমবার আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক ছিলো। প্রায় ১৫০টি ট্রাক বাংলাদেশ অভিমূখে ছেড়েছে এবং ১৩৯টি ট্রাক ভারতে
প্রবেশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাক চালক ও রপ্তানিকারকদের
মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে আমরা অনেক খবর পাচ্ছি।”
বাংলাদেশে অস্থিরতার জেরে চলতি বছরের জুলাই মাসে পেট্রাপোলের
মাধ্যমে রপ্তানি ও আমদানি কয়েক দিনের জন্য বন্ধ ছিল।
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪