জীবনযোদ্ধার রোজনামচা - যুগের চিন্তা

 

“দিনের নবী মোস্তফায়

রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়

হরিণ একটা বান্ধা ছিলো গাছেরই তলায় গো……”

 

কতো কথা মনে পড়ে……

অনেক আগে- আনুমানিক ৪০-৫০ বছর আগে দেখতাম, দোকানিরা সকালে দোকান খুলে তা সে বেলা ১০টায় হলেও- আগরবাতি জ্বালিয়ে দোকানে ধোঁয়া দিতো আর কোরান তেলাওয়াতের ক্যাসেট বাজিয়ে দিয়ে একটা আল্লাহ ভক্তের আবহ তৈরি করতো। যেন বিরাট পরহেজগার ব্যক্তি। আধঘন্টা পর আবেশ কেটে গেলে সেই ক্যাসেট প্লেয়ারেই শুরু হয়ে যেতো ঝাকানাকা গানঃ

        “ও জরিনা গ্যাছোস কিনা ভুইলা আমারে

        আমি অহন রিসকা চালাই, ঢাহার শহরে…”

               কিংবা

        “তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে

        হৃদয়ের কুঠুরেই রাখবো……।।“ ইত্যাদি

 

সেই অনুশীলন, সেই ভক্তিবিলাস এখন অতীত। সেই কালচার এখন দখল করেছে ধর্মের দোকানদাররা। বিকালে ওয়াজ মাহফিল হবে, সকাল সকাল মাইক টেষ্ট করা জন্য উচ্চস্বরে মাইকে তেলাওয়াত, গজল কিংবা আয়োজকদের পছন্দের কোনো হুজুরের ওয়াজের অডিও লাগিয়ে দিলো- বাজতে থাক। এই অবসরে গোসল খাওয়া সেড়ে আসি। বড় হুজুর আইলে তার সামনে প্রথম গজলখান আমি গাইতে না পারলে হলো!

ওদিকে পার্শবর্তী বাসার গৃহিনীরা ছোট বাচ্চা ঘুম পাড়িয়ে রেখে রান্নাঘরে রান্না করছে। মাইকের আওয়াজে বাচ্চা উঠে কান্না-গড়াগড়ি করছে শুনতে পায় নাই। কান্না-গড়াগড়ি করতে করতে একসময় ধপাস! জোরে কান্নার আওয়াজ শুনে মা’ দৌড়ে এসে দেখে তার বাচ্চা খাটের নিচে। “আহারে, আর একটু হলেই আমার সোনার মাথা ফেটে যেতো।“ ওদিকে সেই মা চুলোয় ডাল বাঘার দেয়ার জন্য ফুটন্ত তেলে পেঁয়াজ, ফোড়ন দিয়ে এসেছিলো তা আর খেয়াল নাই। পোড়া গন্ধ নাকে লেগে ছুটে গিয়ে দেখে ততোক্ষণে সব পুড়ে শেষ। আর একটু হলেই কড়াইতে আগুন ধরে যেতো।

বলি, ক্যাসেট প্লেয়ারে ওয়াজ বাজিয়ে দিলে কি কোনো সওয়াব পাওয়া যাবে? সওয়াব নিজে কামাই করতে হবে। তেলাওয়াত শুনে বা পড়ে বুঝে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চলতে পারলে তবেই সওয়াবের আশা করা যায়।

ওয়াজে হুজুর কইছে, “আপনারা স্ত্রীকে ভালোবাসেন, সে আপনার সকল কর্মের সহায়ক, আপনার বাচ্চার পরিচর্যাকারী, তার প্রাপ্য সম্মান দিন, স্ত্রীকে মারধোর করবেন ন।“ ওয়াজ শুনে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখলেন সারাদিনের পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত স্ত্রী ঘুমিয়ে গেছে। আপনাকে খেতে দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে ঢুলু ঢুলু করছে। আপনি যে ডাল ভর্তা দিতে বলে গিয়েছিলেন তা সে বেমালুম ভুলে গেছে। খেতে বসে ডাল ভর্তা না পেয়ে উঠেই ঘুমে ক্লান্ত স্ত্রীকে বেদম প্রহার। আপনার ওয়াজ ওয়াজের মাঠেই শেষ গেলো। কি লাভ হলো ওয়াজ শুনে?

এরপর আছে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বলি আর ওয়াজ মাহফিল বলি- অনুষ্ঠান এক জায়গায়, মাইকের হর্ণ লাগাবে ২-৪ কিলোমিটার জুড়ে। নারায়ণগঞ্জে দেখতাম সভা হচ্ছে দুই নম্বর রেলগেটে, মাইকের হর্ন লাগিয়েছে ৩ কিলোমিটার দূরে মাসদাইর গোরস্তানের কাছে। ঢাকায়ও তাই।

আজ দুপুরের আগ থেকেই মাইকের শব্দে ঘরে কানে তালা। একটা কাজে নাতনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম মৌচাক মার্কেটের পিছনে আনারকলি মার্কেটে। কাছেই সিদ্ধেস্বরী স্কুল। ভাবলাম স্কুলের ছোটো মাঠেই বুঝি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী সভা-টভা হচ্ছে। কিন্তু না, কোথাও খুজে পাওয়া গেলো না- কোথায় কাদের মিটিং হচ্ছে। অথচ যে স্থানে গিয়েছি সেটা বাসা থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে। ৭ বছরের নাতনি সাথে হাঁটছে আর বলছে, ‘এখানে এলে আমার কানে তালা লেগে যায়।‘ সে অবশ্য আসল ব্যাপারটা বোঝে নাই। ভেবেছে রোজকার মতো শব্দ।

এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে।

ফাউন্টেইন পেন বনাম বল পেন

চায়না পাইলট ফাউন্টেইন পেন              বর্তমানে প্রচলিত বলপেন


ছোটবেলায় আমরা ব্যবহার করতাম নিবওয়ালা ফাউন্টেইন পেন। বলপেন ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিলো। পরীক্ষার খাতায় তো বলপেন ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না, রেজল্ট জিরো।

তো নিবওয়ালা পেন যখন ব্যবহার করতাম তখন এক আনা দামের পেন কিংবা বড়জোর দুই আনা দামের প্রেসিডেন্ট পেন, আর আধ আনা বা দুই পয়সা দামের জুপিটার কালীই ছিলো গরীবের ভরসা। প্রেসিডেন্ট পেন ছিলো ‘মুগুর’ সাইজের।

চার আনা-পাঁচ আনা দামের একটা চায়না পাইলট পেনের যে কি আকর্ষণ আর সম্মান ছিলো তখন। এখনকার দিনে তা অনুধাবন করা যায় না। যার একটা পাইলট পেন ছিলো সে-ই ক্লাশের প্রভাবশালী ছাত্র। তার জীবনমান সবার উচ্চে। এরপর যদি সে ব্যবহার করতো পিলিক্যান কালী। তাহলে সে-ই সেকালের সেরা রিচম্যান। পার্কার পেনের নাম নাইবা বললাম। তাতো ছিলো সে আমলে ছাত্রদের ধরাছোঁইয়ার বাইরে। সেসব ব্যবহার করতো সাহেব-সুবারা।

‘পিলিক্যান আর জুপিটার কালির বৈশিষ্ট ছিলো; জুপিটার কালী লেখার পর শুকনোর জন্য একটু অপেক্ষা করতে হতো। লেখার সাথে সাথে ঘসা লাগলে লেপ্টে যেতো। অনেক সময় অনেকের হাতে, পরনের কাপড়ে লেগে যেতো। তাকে গন্য করা হতো ক্লাশের নোংরা ছাত্র হিসেবে। দেখতেও লাগতো ম্যাড়মেড়ে। আর পিলিক্যাম কালী লেখার সাথে সাথে শুকিয়ে যেতো, হাতে লাগতো না। দেখতেও ছিলো খুব গ্লেসী।

আর এখন?

 

এখন কোথায় গেলো সেসব প্রেসিডেন্ট আর পাইলট পেন? পরীক্ষার হল, আপিস-আদালত সবখানেই এখন হরেক রকম বলপেনের ছড়াছড়ি। নো নিষেধ-টিষেধ। তবে সব অতীত মুছে ফেলা যায় না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url