ভাগ্য-তাড়িত জীবন-কথা (পর্ব-তিন) - প্রভাস ভদ্র
পর্ব-তিন।
*********
কিন্তু ওই যে নাম
দিয়েছি, ভাগ্য-তাড়িত।
মাত্র একটি বছরে
বিলকুল সব পাল্টে যেতে থাকলো। কারণ, বাবা আসায় কাকারা সবাই দায় দায়িত্ব মুক্ত, যেহেতু
বাবা আলিপুর জর্জকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেছে। তাছাড়া বড়া ভাই বলে কথা। যৌথ
পরিবারের বড় কর্তা।
কিন্তু এতো চাকরি নয়,
যে মাসের শেষে নির্দ্ধারিত পরিমাণ বেতন হাতে আসবেই। এখানে উপার্জন পসার পরিচিতির
নির্ভর। সময় লাগবে। বাবাকে সেই সময়টুকু কাকারা দেয়নি। যে যা পারে বাবার হাতে গুজে
দিয়ে একান্নবর্তী সংসারের দায় দায়িত্ব কর্তব্য থেকে রেহাই খালাস।
অত সংখ্যক সন্মিলিত
মানুষের সংসার চালাতে বাজারে বাবার প্রচুর ধার দেনা হয়ে যাচ্ছিল। বাঙাল আমরা তিন
বেলা ভাত খেয়ে অভ্যস্ত, এক বেলায় নেমে এলাম। পোশাক আসাকে দৈন্যতা প্রকট হলেও
দারিদ্র্য দেনা মুক্ত হওয়া যাচ্ছিল না।
কিন্তু মায়ের প্রাণ
মন বলে কথা। এসব দেখেশুনে ঠাকুরমা একদিন বাবাকে একান্তে ডাকলেন। স্নেহ দরদি
পরামর্শ দিলেন, মা হয়ে বলছি- তুই এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা সংসার শুরু কর। হয়তো
ভাবছিস, নতুন জায়গায় সবে ওকালতি শুরু করেছিস, চালাতে পারবি কিনা? আমার আশীর্বাদ
সঙ্গে থাকবে তোর। দেখ বাবা শীতকালে জলে নামতেই যা ভয়। নেমে পড়লে আর কোনও শীত থাকে
না।
সেকেলে মানুষ বাবা, মা অন্ত প্রাণ। মায়ের কথা শিরোধার্য করে অনতিবিলম্বে বাবা একদিন পুকুরে নেমেই পড়েছিল। প্রথমে মাত্র একখানা ঘরের ভাড়াটে হয়ে। পরবর্তীতে দু'খানা ঘরের এবং সবশেষে তিন ও চার খানা ঘরের ভাড়া বাড়ীতে নিজের মা, আমার মা এবং আমাদের নয় ভাইবোনদেরকে নিয়ে বাবার আমরণ সংগ্রামী জীবন ছিল।
কম বেশি সংগ্রামটা
ছিল, আমাদের পরিবারের সকলেরই। আমার ধারণা, ওপার ছেড়ে এপারে আসা দ্বিখন্ডিত নব্বুই
শতাংশ বাঙালির জীবনই সেসময় তাই ছিল। আসলে ওপারের বাঙালিরা এপারের বাঙালিদের তুলনায়
পরিশ্রমী এমনিতেই বেশি। তাই ঠেলায় পড়ে চাপ নিতে তেমন কিছু কষ্টকর অসুবিধা মনেই
হয়নি।
আমার জীবন অভিজ্ঞতায়
জানা এবং শেখা -খেটে খাওয়া মানুষেরা না খেয়ে কখনও মরতেই পারে না। বেকার জীবন
যাপনেও থাকে না, যদি অবশ্য শারীরিক অক্ষমতা না থাকে তার। না থাকতে হয়না যদি না তার
যেকোনও কাজে ছুৎ মার্গ থাকে। যেজন্যই সারা ভারতে এখনও এপারের বাংলার বাঙালিরা
সংখ্যায় বেশি বেকার জীবনে থাকে। অথচ, অন্যান্য ভারতীয়রা এখানে বাঙলায় এলেই ঠিক
কিছু না কিছু একটা কাজ জুটেই যায়। সেজন্যই এই বাংলায় ওদের বসবাস সংখ্যা নিয়ত
বাড়ছেই। কিছু কিছু শ্রমের শ্রমিক, ব্যবসায় ব্যবসায়ীতো ওরাই ক্রম বর্দ্ধমান। অথচ, অতীতে
এককালে এসবেতো বাঙালিরাই সর্বাধিক ছিল।
কৈশোরে প্রথম যে
স্কুলে পড়তাম পথে কম্যুনিষ্ট পার্টির বৃহৎ অফিস ছিল। টিনের ছাউনিঅলা বিশাল গুদাম
ঘরের মতো অফিস। সেসময়কার আঞ্চলিক সর্বোচ্চ নেতার ওটিই ছিল আবাস। অবিবাহিত সুপুরুষ
মানুষটিকে দেখতে খুবই সুন্দর ছিল। আগোছালো পোশাক। চুল দাঁড়ি রুখুসুখু অপরিপাটি। কিন্তু
চোখের চাহনি ছিল দীপ্ত। কথাবার্তা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আসলে সে সময়ের কমরেডদের
আচরণ পোশাক আসাক সকলেরই মোটামুটি এরকমই ছিল। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে অতি সাধারণ
হয়েই মিলেমিশে থাকতো। আজকের নেতাদের মতো ঠাটবাট বিলাস ছিল না।
স্কুল যাতায়াতে নিছক
কৌতূহলেই আমি ওই অফিসের সুমুখে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কমরেডদের দেখতাম, পুরনো খবরের
কাগজের ওপর পেল্লাই উঁচু মুড়ির ঢিপিতে বৃত্তাকারে বসে তেলেভাজা সহযোগে খেতে। সঙ্গে
কেটলির চা কাঁচের গেলাসে ঢেলে খেতে। দেখতাম, পুরনো খবরের কাগজের ওপর পুরনো দাঁতনকে
তুলির মতো ব্যবহারে নানা কথার পোস্টার লিখতে। গরীব মানুষের ওপর শাসকদের অত্যাচারের
নানারকম নির্মম ছবি আঁকতে। পোস্টারে লেখা প্রতিবাদী দারুণ দারুণ কথাগুলি কিশোর
আমার মন ছুঁয়ে যেতো। মন বলতো, প্রতিটি মানুষেরই উচিত, কম্যুনিষ্ট হওয়া। লেখা ও আঁকা
ছবিতে এরা যা যা বলছে, করতে চাইছে সেসব অবশ্যই নির্ভুল এবং সঠিক।
সেই অতীত সময়কালে এই
বিশ্বাসী ভাবনা একা আমার ছিল না। আমার অনুমানে মনে হয়, সেসময় ওপার থেকে আসা ৯০%
বাঙালীরই তাই মনে হয়েছিল। নাহলে ওপার থেকে আসা বাঙালী-স্রোতের পূর্বে এই বঙ্গের
বিধানসভায় কেন মাত্র ৩ জন এম,এল,এ (জ্যোতি বসু, সোমনাথ লাহিড়ী, বজবজের বঙ্কিম
মুখার্জী) ছিল! দ্বিখন্ডিত বাঙালির আগমনে রাজনৈতিক ভাবে সবচাইতে লাভবানতো হয়ছিল, সেসময়ের
বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিই। পরবর্তীতে শাসন ক্ষমতায় আসতেও পেরেছিল ওদের জন্যই।
আমার মতে, পশ্চিমবঙ্গের
রাজনৈতিক ক্ষমতায় ওঠা নামা পরিবর্তনে মুসলমানরা একমাত্র ভারসাম্য নির্ভর নয়, ওপার
বাংলা থেকে আসা বাঙালিদের সমর্থন ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
-প্রভাস ভদ্র
প্রভাস ভদ্রঃ পর্যায়ক্রমিক ছবি |
(পরের কিস্তি…… পর্ব-চার)