নৌকায় ইউরোপ যাওয়ার পথে ১৪ দিন অনাহারে থেকে মৃত্যু, মৃতদেহ ফেলে দেয়া হয় সাগরে
ফাতি হুসেইন ছবিঃ বিবিসির সৌজন্যে |
নিজের সঞ্চিত সব অর্থ দিয়েও ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি ফাতি হুসেইনের
সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুর উপকণ্ঠ ইয়াকশিদ এলাকায় মূলত স্বল্প
আয়ের মানুষ বসবাস করেন। ওই এলাকায় বাড়ি ফাতি হুসেইনের(২৬)। বাড়ির পাশে বিউটি
পারলার চালাতেন তিনি। ব্যবসা ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন কাউকে না জানিয়ে ফ্রান্সের
একটি দ্বীপের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন ফাতি। দুই সপ্তাহ পর বাড়িতে এসেছে তার মৃত্যুর
খবর।
ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে ঝুঁকিপূর্ণ সাগরপথ বেছে নিয়েছিলেন ফাতি।
এজন্যে নিজের জমানো সব অর্থ দিয়েছিলেন একটি চক্রকে। ভারত মহাসাগর হয়ে ফ্রান্সের
মায়োতি দ্বীপে যেতে একটি নৌকায় উঠেছিলেন। কিন্তু মাঝ সাগরে আরও অনেকের সঙ্গে
ফাতিকে রেখে পালিয়ে যান সেই চক্রের সদস্যরা। এরপর দুই সপ্তাহ নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে না
খেয়ে আরও অনেকের সঙ্গে ফাতিরও মৃত্যু হয়।
ফাতি
বাড়ি ছাড়ার ১৪ দিন পর তার মৃত্যুর খবর পায় পরিবার। ফাতির বোন সামিরা বিবিসিকে
বলেন, ‘সেই নৌকার যারা কোনোমতে বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের কাছ থেকে মৃত্যুর খবর পাই
আমরা। তারা জানান, অনাহারে থাকতে থাকতে মৃত্যু হয় ফাতির। অনেকে তাজা মাছ ও
সমুদ্রের পানি খেলেও ফাতি তা পারেনি। মৃত্যুর আগে ফাতির বিভ্রম হচ্ছিলো। মৃত্যুর
পর অন্যরা তার মৃতদেহ সাগরে ফেলে দেয়।’
আন্তর্জাতিক
অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, ফাতিসহ ৭০ জনের বেশি মানুষ দুটি ছোট নৌকায় করে
যাচ্ছিলেন। নৌকা দুটি ডুবে ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয় ৪৮ জনকে।
মাদাগাস্কারের উত্তর–পশ্চিমে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান মায়োতি দ্বীপের। আইওএমের
হিসাব অনুযায়ী, ফ্রান্সের এই ছোট দ্বীপে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিবছর শত শত
মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
ফাতির জীবন বাজির যাত্রা
ফাতি
ইউরোপ যেতে ০১ নভেম্বর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান। তা জানতো না তার পরিবার। ছোট বোনকে
ছাড়া আর কাউকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানাননি ফাতি। বোনকে বলেছিলেন, ব্যবসা থেকে
সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ইউরোপে যাচ্ছেন। মোগাদিসু থেকে বিমানে ফাতি প্রথমে যান কেনিয়ার
উপকূলীয় শহর মোম্বাসায়। সেখান থেকে নৌকায় মায়োতির উদ্দেশ্যে ১ হাজার ১০০
কিলোমিটারের ঝুঁকিপূর্ণ পথে।
ব্যবসা
ভালো চললেও ফাতি কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিতে গেলেন, তা মানতেই পারছে না তার পরিবার।
সামিরা বলেন, ‘ফাতির ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু এরপরও তার এমন সিদ্ধান্ত পরিবারের
সবাইকে অবাক করেছি্লো। আমার জানামতে, ফাতি সমুদ্র একদমই পছন্দ করতো না। আমি বুঝতে
পারছি না, কেনো সে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। চিরবিদায়ের আগে একবার যদি তাকে বুকে আগলে
ধরতে পারতাম!’
মৃত্যুর
মুখ থেকে ফেরা ফাতির সহযাত্রীরা জানিয়েছেন, মোম্বাসা থেকে একটি বড় নৌকায় করে
যাত্রা শুরু করেন তারা। কিন্তু যাত্রাপথে ওই চক্রের সদস্যরা জানান, নৌকায় কারিগরি
ত্রুটি দেখা দিয়েছে। সেখান থেকে তাদের ফিরে আসতে হবে। এরপর কেনিয়ায় ফেরার পথে বড়
নৌকা থেকে তাদের দুটি ছোট নৌকায় তোলা হয়। এরপর বলা হয়, ‘তিন ঘণ্টার মধ্যে আপনারা
মায়োতি পৌঁছে যাবেন।’
জীবিত উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের ধারণা, ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মাঝপথে ফেলে রেখে আসা হয়েছিলো। কারণ, নৌকায় ওঠার আগেই সেই চক্রকে সব অর্থ পরিশোধ করেছিলেন তারা। মাঝপথে গিয়ে নৌকা নষ্ট হওয়ার কথা বলে তাদের ফেলে আসার বিষয়টি ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। সামিরা বলেন, এক বা দুই দিন নয়, একে একে ১৪ দিন সাগরে ভাসলেও কেউ তাদের উদ্ধার করতে যায়নি। অবশেষে মৃত্যু হয় ফাতির।
বিজ্ঞাপন
দিয়ে প্রতারণা
মায়োতি
দ্বীপ ছাড়াও ইউরোপের আরও বিভিন্ন অঞ্চলে নেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন চক্র ফেসবুক ও
টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এমন বেশ কিছু বিজ্ঞাপন
দেখেছে বিবিসি। বিজ্ঞাপনে নানা ধরনের কথা বলে প্রলুব্ধ করা হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত
পরিবারগুলোর অভিযোগ, বড় নৌকার কথা বললেও ছোট নৌকায় করে নেওয়া হয়, যেগুলো
স্থানীয়ভাবে কাওসা নামে পরিচিত।
সোমালিয়া
থেকে মায়োতি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এমন পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তারা
জানান, সোমালিয়া থেকে মায়োতি যাওয়ার পথ মূলত দুটি। একটি মোম্বাসা থেকে মায়োতির
অদূরে কমোরোস দ্বীপপুঞ্জ হয়ে। এতে খরচ তুলনামূলক কম। দ্বিতীয় পথ প্রথমে বিমানে
ইথিওপিয়া, এরপর সেখান থেকে মাদাগাস্কার। কারণ, সোমালিয়ার নাগরিকেরা আগাম ভিসা ছাড়া
সেখানে যেতে পারেন।
ক্ষতিগ্রস্ত
কিছু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোম্বাসা থেকে মায়োতি যেতে
বাংলাদেশি মুদ্রায় সাত লাখের বেশি টাকা দিতে হয়। অর্ধেক দিতে হয় আগাম। বাকি অর্ধেক
নৌকায় ওঠার আগে।
জীবনের
ঝুঁকি নিয়ে মায়োতি দ্বীপে যাওয়ার চেষ্টার ঘটনা দিন দিন বিপজ্জনকহারে বাড়ছে বলে
জানান আইওএমের আঞ্চলিক কর্মকর্তা ফ্রানজ সিলেস্তিন। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এ পথে
যাওয়ার চেষ্টা করে সম্প্রতি ২৫ জনের সলিল সমাধি হয়েছে। মূলত কমোরস দ্বীপপুঞ্জ ও
মাদাগাস্কার হয়ে বেশি মানুষ যাওয়ার চেষ্টা করেন। অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য চলতি
বছরটি ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী।’
সূত্রঃ
প্রথম আলো