ভাগ্য-তাড়িত জীবন-কথা (পর্ব-এক) - প্রভাস ভদ্র

 

প্রভাস ভদ্র কিশোর-বর্তমান

ভূমিকা

প্রভাস ভদ্র। জন্মভিটা বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে। বাবা জেঠারা ছিলেন আইনজীবী। একান্নবর্তী পরিবার। কর্মের সুবাদে কেউ কলকাতায় কেউ অন্যত্র। বাবার আইনজীবী পেশার সুবাদে তাঁর বসবাস ছিলো ফরিদপুর শহরেই। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর স্থায়ী হন কলকাতার উপকন্ঠ বাটানগরে।

পড়ালেখা শেষ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশাজীবনে সাংবাদিকতা, সরকারি-বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি লেখালেখি করেছেন সখের বসে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়াও কয়েকটি বই লিখেছেন তিনি।

৮৩-৮৪ বছর বয়সে এখনও ভুলতে পারেননি জন্মভিটার স্মৃতি। বাংলাদেশের প্রতি গভীর টান। ফেসবুকে তার অল্পসংখ্যক বন্ধুর মধ্যে বেশিরভাগই বাংলাদেশী। বাংলাদেশের কেউ কলকাতায় গেলে দেখা করতে ব্যকুল হয়ে যান। বাংলা ভাষার জন্য অধিক ত্যাগের স্মৃতির প্রতি তার অন্তরের গভীরের কথা, ‘বাংলা ভাষা যদি টিকে থাকে তা বাংলাদেশেই থাকবে’।

কারো স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর লেখার উপরন্তু যোগ হয়েছে তার বাংলাদশে বেড়ে ওঠার স্মৃতিকথা। তাই শিরোনামে উল্লেখিত তাঁর লেখা স্মৃতিকথা “ভাগ্য-তাড়িত জীবন কথা” তাঁর অনুমতিক্রমে আমার পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম। আশাকরি লেখাটি আগ্রহী পাঠকদের সুখপাঠ্য হবে।

লেখাটি বড় হওয়ায় ৬ কিংবা ৭ পর্বে প্রকাশিত হবে। আশাকরি উৎসুক পাঠকগন সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদান্তে - এডমিন

**************************

পর্ব-এক।

******

ছিলামতো বেশ দুধে ভাতে আনন্দ আহ্লাদেই।

গ্রামের বাড়ি শিবচরে নয়, শহর ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের অনতিদূরে। বাবা, জ্যেঠু দু'জনেরই আইনজীবীর পরিচিতি। জ্যেঠুর আবার বিশেষ পরিচিতিতে 'রায়বাহাদুর' খেতাব।

মাথার ওপর দুই দাদা, দুই দিদির স্নেহ আদর প্রশ্রয় ভালোবাসা। তিন কাকার তখন কলকাতারই কাছে চাকরি। ছুটিতে বিশেষ করে পূজায় আসতেন এটা সেটা নিয়ে।

তখনতো এপার ওপার বাংলা বা দ্বিখন্ডিত বাঙালি ছিল না। হ্যাঁ আমি দ্বিখণ্ডিত বাংলা ওরফে বাঙালিই বলবো। আমার মতে, বঙ্গ নয় বাঙালিকেই দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল। বাঙাল ঘটি করা হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি করা হয়েছিল। তারও পরে দুই দেশীয় বাঙালি করা হয়েছিল। নৈলে বাঙালিরাই সর্বদা ভারত-শাসন আসনের শীর্ষে থাকতো। যেমন, নোবেলজয়ীতে এখনও সেই বাঙালিই এগিয়ে।

একথা কোনও ফালতু ফুলুকে বলছি না। রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবেও বলছি না। বলছি, অতীত ইতিহাস নির্ভর একজন সেকেলে অমেকি বাঙালি হিসেবেই।

দেশ তথা বাঙালি ভাগের পর মানুষের অবস্থাটা দাঁড়ালো কিরকম? সেই যে কি যেন গানটা, এক পা কূলে অন্য পা নায়ে, বলো যাবেকি?

অনেকেরই আবাস ব্যবসা কর্মক্ষেত্র দু'কূলে ভাগাভাগি অবস্থাতে। যে যার পছন্দের পথে থিতু হলো আস্তে ধীরে। বিলকুল ঠান্ডা মাথায়। ফলত কি দাঁড়ালো? আনুমানিক ৭৫% হিন্দু বুদ্ধিজীবী, এপারে চাকরিজীবী, বড় ব্যবসায়ী তথা বিত্তবানরা এপার বাংলায় স্থায়ী বসবাসকারী হয়ে গেলো।

সেইসময় আমার ওপরের বড় দুই দাদা দিদি ঠাকুরমা বরাবরের জন্য স্থায়ী হয়ে থাকতে চাকরিজীবি কাকাদের কাছে চলে এলো। তাতেও আমরাতো দুধে ভাতে আনন্দে আহ্লাদেই বেশ ছিলাম। অন্তত আমাদের ফরিদপুরে কোন দাঙ্গা অশান্তিতো ছিল না। আসলে ফরিদপুরের মানুষেরা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা মেজাজের, শান্ত প্রকৃতির, সদা হাস্যমুখের ছিল সেসময়। এখন জানিনা।

মুজিবুর রহমানকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ফরিদপুরের মানুষেরা সাধারণত ঠান্ডা মেজাজ আর নরম মনের মানুষ হয়, এমনই জনশ্রুতি। আপনি ব্যতিক্রম হলেন কি করে?

উত্তরে মুজিব বলেছিলেন, পলিমাটি ভেজা অবস্থায় নরমই থাকে। আমিও তাই ছিলাম। সেই নরম পলিমাটি রোদ-তাপে যেমন শক্ত পাথর হয়, আমাকেও তাই দেখছেন।


তো সেই সময় বাবার পরিচিত হিন্দুজনেরাতো তখনও সকলেই ছিলেন। ছিলেন, রায়বাহাদুর জ্যেঠুও। সহপাঠী মিত্র কবি জসিমুদ্দিন এর নাম শুনেছি এপারে এসে। ছিলেন, দাপুটে ভ্রাতৃদ্বয় রাজামিঞা, মোহনমিঞা। আমাদের এক ভাগ এপারে আসার নায়ে ওঠার সময় ওঁরা বলেছিলেন শুনেছি, ‘আমাদের এখানেতো কোনও দাঙ্গা হয়নি। হতে দেবও না। তবুও তোমরা যদি এভাবে চলে যাওতো আমাদের বদনাম হবে’।

বাবা কিন্তু বুঝেছিল, ওদের কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। তাই আমাদের নিয়ে থিতুই দিয়েছিল। তবুও আমাদের এপারে আসাটা বড়ই বিচিত্র। বাবা বাদে বাকি আমরা কিন্তু বরাবরের জন্য জন্মক্ষেত্র ওপার ছেড়ে এপারে আসিনি।

বাবা কাকারা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মেঝকাকার পরিবার তখনও কিন্তু আমাদের দেশের বাড়ি জন্মক্ষেত্রেই ছিলেন। শহর ফরিদপুর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ যাতায়াতও ছিল। মেঝকাকা আমৃত্যু আমাদের দেশের বাড়িতেই ছিলেন।

এপারে আমাদের আসাটা ছিল নিছক বেড়াতে আসা। মায়ের মন বলে কথা। কতদিন দেখেনি দাদা দিদিদের। তখনতো ফোনাফুনির যুগ ছিল না। চিঠিপত্র চলাচলও ছিল, কি এমন উন্নত গতিশীল স্বাভাবিক!

ফরিদপুরের গুড় সেসময়েও বিখ্যাত ছিল। লোক মারফত মা এপারে পাঠাতো। পাঠাতো ছোট মাটির ডিব্বায় ভরে ক্ষীর। এটা সেটা আরও অনেক কিছু। তাতেও মন ভরত না। চোখের দেখা না দেখলেই যে নয়। হামেশা কান্নাকাটি করত।

তখনও পেট থেকে পড়লেই আজকের মতো স্কুলে ভর্তি করা চালু ছিল না। প্রাইমারি পড়াশুনো বাড়িতেই হতো। সেদিক থেকে বড় আমি তখনও স্কুল পড়ুয়া নয়। বাকি ছোটরাতো নয়ই।

সেসময় পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদির প্রচলনও শুরু হয়নি। এপার ওপার নিয়মিত চেনাজানা লোকেদের যাতায়াত ছিলই। তেমনই বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য একজনের সঙ্গে আমাদেরকে এপার তথা এদেশে কিছুদিনের জন্য ঘুরতে বেড়াতে পাঠানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বেশ কিছুদিন সন্মিলিত সকলে একত্রে আনন্দে কাটালে সকলেরই ভালো লাগবে। মা সতেজ প্রফুল্ল মনে ফিরে স্বাভাবিক সংসারকর্ম করতে পারবে।

সিদ্ধান্ত-সংবাদটা শুনে দারুণ আনন্দ হয়েছিল আমার। নতুন দেশ দেখব। কলকাতা দেখব। সব ভাইবোনেদের আবার একত্রে দেখা হবে। একসঙ্গে অনেকদিন পর আগের মতো থাকবো।

কে জানত, ওই স্বপ্নময় আনন্দের আসাটাই আমাদের জন্মক্ষেত্র ছেড়ে, অন্য নামে পরিবর্তিত একটি বিদেশ ভারতেরই অন্য একটি অংশে আজীবনের জন্য আমাদের চলে আসা!!

 

ভাগ্য-তাড়িত জীবন -কথা, শুরুটা এখান থেকেই।

কোথায় কার ঠিকানায় এসে উঠলাম আমরা?

আমার বাবা এমএ এবং ল' পড়েছে কলকাতায়। সেই সুবাদে এপারের দুই দাপুটে নেতা হুমায়ূন কবীর, জাহাঙ্গীর কবীর ভ্রাতৃদ্বয় ও বিধান রায়ের আপ্তসহায়ক প্রতাপ রায় সহ বিশিষ্ট মিত্রজন ছিল অনেকেই। তাদের সহযোগিতাতেই দুই কাকা তখন কাজ করতেন বাটানগরে জুতা নির্মাণ কারখানাতে। তৃতীয়জন উত্তরবঙ্গের ইনডং চা বাগানে।

আমাদের দাদা দিদিরা এবং ঠাকুরমা যেহেতু একান্নে থাকা বাটানগরের কাকাদের কোয়ার্টারে ছিল, আমরাও স্বাভাবিক মতে সেখানেই উঠেছিলাম। উঠেছিলাম বলার কারণ আছে। কেননা, কিছুদিন আনন্দে কাটানোর পর মা যখন ফেরার ভাবনায় সঙ্গী কাকে পাওয়া যায় ভাবছিল, তখনই ভাগ্য-তাড়িত হওয়ার প্রথম সংবাদ।

তিন কাকা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমাদেরকেও আর ওপারে ফিরতে দেবেন না। দাদা দিদিদের মতো আমাকেও এখানকার স্কুলে ভর্তি করাবেন। সেইমতে সিদ্ধান্তটা বাবাকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।

সেসময় এপারে ঘরে ঘরে এই একই দৃশ্য। বিশেষ করে বাটানগর কারখানা অঞ্চলে। কেননা, বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে নতুন নগরের কারখানায় কর্মী পাওয়া যাচ্ছিলো না চাহিদা মতে। কারণ, জমিচাষ নির্ভর ছাড়াও বাকিরা মুচির কাজ জুতা কারখানার পরিবর্তে হুগলি নদী তীরবর্তী একাধিক চটকল, এবং বজবজ এর বার্মাসেলের তেলের ডিপো এবং বি এন আর রেলের কাজ করতে উৎসাহী ছিল সর্বাধিক। সেকারণে সেসময় বাটা জুতা কারখানায় নব্বই শতাংশ কর্মীই হয়ে পড়েছিল ওপার বাংলা থেকে চলে আসা খন্ডিত বাঙালিরা। যাদের সেসময় পরিচিতি ছিল, বাঙাল।

ভারতের একমাত্র পাঞ্জাবি সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোনও জাতির কপালে দেশভাগের জন্য জন্মভূমি ক্ষেত্র পরিবর্তনের নজির আছে, আমার জানা নেই। কিন্তু তাদের বাঙাল জাতীয় নাম পরিবর্তন পরিচিতি আমার জানা নেই। সম্ভবত এটা এসেছে যারা দ্বিখণ্ডিত বাঙালিতে খুশি এবং এখনও ‘সুনার বোংলা গুড়বো’ বলে সেই শ্রেণির বিকৃত উচ্চারণ থেকেই। কেননা, তারা এখনও বাঙালিকে বঙ্গালী আর পশ্চিম বঙ্গকে পশ্চিম বঙ্গাল বলতেই অভ্যস্ত।

কাকারা ওঁদের সন্মিলিত সিদ্ধান্তের কথা বাবাকে জানানোর পর অপর একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, ঐক্যমতে। সেটা হলো, সুসম বন্টনে নব আগত আমাদেরকে পাঠানো হলো, অপর কাকার অধীনে তত্ত্বাবধানে থাকার জন্য সুদূর উত্তরবঙ্গের ইনডং চা বাগানে। শুরু হলো, ভাগ্য- তাড়িত জীবন। এলাম বেড়াতে। সকল ভাইবোনেরা একসঙ্গে থাকার আনন্দ সুখের নানা রঙিন কল্পনায়। অথচ!!

-প্রভাস ভদ্র

পর্যায়ক্রমিক ছবিঃ

প্রভাস ভদ্র'র কয়েকটি ছবি

(পরের কিস্তি…… পর্ব-দুই)


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url