ভারতের আন্দামান দ্বীপপূঞ্জঃ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ

 
বাংলাদেশের খুলনা থেকে আন্দামানে অভিবাসিত নারায়ণ


বহু ধর্ম, বহু ভাষার দেশ ভারত। ভারতে প্রচলিত শতশত ভাষার মধ্যে ২২ টি সাংবিধান স্বীকৃত সরকারি ভাষা রয়েছে। হিন্দি এবং ইংরেজি সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারের আনুষ্ঠানিক ও অফিসিয়াল ভাষা। রাজ্য সরকার নিজ নিজ রাজ্যের ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়াও দেশটিতে রয়েছে বৈচিত্রময় জাতিগোষ্ঠী, রহস্যময় ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ।

ভারতের রহস্যময় জায়গা্র মধ্যে অন্যতম হলো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। দ্বীপপুঞ্জটি একটি বিশেষ দ্বীপগুচ্ছ এবং ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যা আগের পর্বে বর্ণনা করেছি। এ অঞ্চলটি শুধুমাত্র এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। এখানকার জনসংখ্যার বৈচিত্র্য এর ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়।

ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং অনেক দূরে। এখানকার বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা কিছুটা পূর্বের এক পর্বে আলোচনা করেছি। আজকের আলোচনার বিষয় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাগত বাঙালিদের প্রসংগে।

উপমহাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে ভারবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে। এখানে যে দ্বীপগুলি রয়েছে তারমধ্যে নীল দ্বীপ নামে ছোট্ট একটি দ্বীপ রয়েছে যার স্থানীয় বাসিন্দা্রা বেশিরভাগই এসেছে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ থেকে। পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে লোকজন কীভাবে এবং কবে এই অঞ্চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলো তা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে বসতি স্থাপনের সূচনা

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে আন্দামানে মানুষের যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে। দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমানা বিভক্ত হয়। এর ফলে অনেক মানুষ, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হন। এই সময়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বহু মানুষ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পাড়ি জমায়। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও এদের একটি গন্তব্য হয়ে ওঠে।

ভারত সরকার দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অভিবাসনকে উৎসাহিত করে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে অভিবাসিত হিন্দু ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত করার জন্য সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৫০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বহু পরিবারকে এখানে পুনর্বাসন করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পূনর্বাসন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অভিবাসন হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর দমন-পীড়ন এতটাই বেড়ে যায় যে বহু মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে কিছু শরণার্থী আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে চলে যায়, যেখানে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।

বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া

ভারত সরকার সাবক পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে। বিশেষত ১৯৫০-এর দশকে সেই প্রকল্পের মাধ্যমে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসের সুযোগ তৈরি করা হয়। অভিবাসিত পরিবারগুলোকে কৃষিকাজের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়। তাদের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ, জীবিকা নির্বাহের উপকরণ সরবরাহ এবং স্থানীয় সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।

সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং তৎপরবর্তি বাংলাদেশের অভিবাসীরা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করে। এর ফলে দ্বীপপুঞ্জের সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ বৈচিত্র্য যোগ হয়। তাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, এবং সংস্কৃতি দ্বীপপুঞ্জের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধি এনেছে। নীল দ্বীপে এখনো মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের মতোই পোষাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর মধ্যে বাংলাদেশের ছাপ রয়েছে। বর্তমানে যেমনি এসেছে আধুনিকতার জোয়ার, তেমনি তাদের পুরনো সংস্কৃতি আজও ধরে রেখেছে।

জীবিকার সংগ্রাম

দ্বীপপুঞ্জে বসতি স্থাপন করা সহজ ছিলো না। প্রাথমিকভাবে অভিবাসীদের অরণ্য পরিস্কার করে কৃষিকাজ শুরু করতে হয়েছি্লো। তাছাড়া স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে কিছুটা সাংস্কৃতিক সংঘাতও দেখা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দ্বীপপুঞ্জের প্রতিকূল আবহাওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অভিবাসনের ইতিহাস কেবল ভৌগোলিক বা সামাজিক নয়, বরং এটি মানবিকতা ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই অভিবাসন প্রক্রিয়া একটি যুগের সংকট ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যা বর্তমানের দ্বীপপুঞ্জের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের অভিবাসী পরিবারের বংশধর।

বর্তমান অবস্থা

রূপকথার গল্পের মতোই অপূর্ব সুন্দর আন্দামানের নীল দ্বীপের গ্রাম্য পরিবেশ। সাদা বালির নয়নাভিরাম দৃশ্য, নীলের মাঝে সবুজ দ্বীপ যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করে, তেমনি ফল, ফুল, পশু-পাখি বৈচিত্রে ভরা এখানকার গ্রাম্য পরিবেশ।

নীলদীপের বেশিরভাগ মানুষই বাংলা ভাষী। ১৯৫০ এর দশকে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা, যশোর, নোয়াখলী, কুমিল্লা থেকে ওপার বাংলায় যাওয়া মানুষেরা আজও ভুলতে পারেনি তাদের নাড়ীর টান। তাদের কথা বলার ধরণ আচার-আচরণে তার ছাপ আজও ভীষণভাবে স্পষ্ট।

তবে এপার বাংলা থেকে লোকজন আন্দামানে গিয়ে বসতি স্থাপন করলেও পরবর্তীকালে তামিল, তেলেগু, বিহারী এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে।

(বাংলাদেশের খুলনা থেকে যাওয়া নীল দ্বীপের বাসিন্দা নারায়ণের একটি সাক্ষাৎকারের খন্ডিতাংশ। ভিডিওর কৃতজ্ঞতাঃ Bengali Good Food)



জীবিকার মাধ্যম

আন্দামান-নিকোবারে কৃষিকাজের পাশাপাশি মানুষজন অন্যান্য পেশায়ও জড়িত। বিশেষ করে এখানে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছ। অনেকে গাড়ি চালিয়ে পর্যটকদের সারাদিন ঘুরিয়ে দেখায়। কেউ কেউ বেছে নিয়েছে গাইড, ফটোগ্রাফার ইত্যাদি কাজ।

 

পরিবেশ ও অন্যান্য দ্বীপের সাথে যোগাযোগ

এখানকার গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটলে বোঝার উপায় নেই এটা ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এতো দূরে। মনে হবে সমতল ভূমিতেই হাঁটছি। এই দ্বীপে গ্রামের পথে  মানুষ হেঁটে অথবা বাইসাইকেলে যাতায়াত করে। প্রচুর বাইকও আছে।

নীল দ্বীপের সাথে আন্দামানের অন্যান্য দ্বীপের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ফেরি। আগে ছিলো শুধু সরকারি। বর্তমানে প্রাইভেট ফেরিও চলাচল করে।

 
আন্দামানের নীল দ্বীপের একটি গ্রামীণ রাস্তা

চিকিৎসা ব্যবস্থা

স্থানীয়দের চিকিৎসার জন্য রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে ছোটখাটো অসুখ হলে সরকারিভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেয়া হয়। গুরুতর রোগীকে প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার (পোর্ট ব্লেয়ার) কিংবা ভারতের মূল ভূখন্ডে যেতে হয়।

 

শিক্ষা ব্যবস্থা

এখানকার মানুষজন উচ্চশিক্ষা গ্রাহণের জন্য বেছে নেয় ভারতের মূল ভূখন্ড, যেমন; চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, পন্ডিচেরি, এমনকি কলকাতাকেও।

 

উপসংহার

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আন্দামান যেন ‘এক টুকরো বাংলাদেশ’। একটু বাংলাদেশের ছোঁয়া। 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url