আমাদের আমেরিকা কানেকশন
ছবিঃ প্রতীকী |
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিলো বলে আমেরিকা আমাদের শত্রু তালিকায়
এক নম্বরে ছিলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও আমেরিকা ঠিকই এদেশে বিষবৃক্ষ রোপন করে চলেছে
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত।
অন্যদিকে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষকে যদি বিদেশে বসবাসের জন্য কোনো
রাষ্ট্রকে বেছে নিতে বলা হয়, পছন্দের তালিকায় আমেরিকাই থাকবে এক নম্বরে। তাহলে শত্রু
ভাবার কারণ কি? কারণ একটাই, স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং আজও পর্যন্ত সেই নীতিতে অটল থাকা।
আমেরিকা কিভাবে বিষবৃক্ষ রোপন করে চলেছে? সমসাময়িক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ
করে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি এখানে।
১৯৭৮-১৯৮১ সময়কালে আমি চট্টগ্রাম থাকতাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে
যাতায়াত করতাম। একদিন সকালে ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ষ্টেশনের কাছাকাছি তখনকার
মোটামুটি বড় এবং পরিচ্ছন্ন একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে বসেছি। তখন চট্টগ্রামের রেস্টুরেন্টগুলোতে
সকালের নাস্তায় ডাল ভাজি কিংবা অন্য কিছুর পরিবর্তে চায়ের মধ্যে পরোটা ভিজিয়ে খেতো।
আমার আবার অভ্যাসটা ভিন্ন। আমি ওভাবে খেতে পারি না। চা খাই নাস্তার পরে।
তো নাস্তা খেতে গিয়ে যে টেবিলটায় জায়গা ফাঁকা পেলাম, আমার সামনের
টেবিলেই অল্প বয়সী এক সাদা চামড়ার বিদেশি চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খাচ্ছিলো। দেখে একটু বিব্রতই
লাগলো। আমি পরিবেশনকারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে একটা ডিম মামলেট করে দিতে পারবে?
বললো, পেঁয়াজ কাটা নেই পোজ করে দিতে পারবো। ‘রেস্টুরেন্টে সধারণতঃ পেঁয়াজ মরিচ খরচ
না করার জন্য চালাকি করে এগুলো করে’। যাইহোক, বললাম তাই দাও। আমাকে ডিম দিয়ে পরোটা
খেতে দেখে ওই বিদেশী ভদ্রলোক পরিবেশককে ডেকে আমার দিকে ইশারা দিয়ে দেখিয়ে ডিমের অর্ডার
দিলো, যেটা পরিবেশনকারী দেয়ার পরে বুঝলাম। ভদ্রলোক ডিম পরোটা চা দিয়ে একেবারে মেখে
ফেললো। দেখে মায়া লাগলো।
ততোক্ষণে তার টেবিল ফাঁকা হয়ে গেছে। আমার আবার বিদেশি লোক দেখলে তার সাথে আলাপ জমিয়ে একটু অভিজ্ঞতা নেয়ার প্রবনতা ছিলো। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তার টেবিলে গিয়ে বসলাম।
কোন দেশ থেকে এসেছো?
আমেরিকা
এখানে কি কাজ?
গ্রামীণ ব্যাঙ্ক
শুনে একটু অবাক লাগলো। তখন দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা। নিজের দেশের
লোকই চাকরি পায় না, আবার বিদেশি লোক! তাও আবার যে সে দেশের লোক না, আমেরিকার!
তখন থেকেই ভাবতাম, মূল ধারার ব্যাংক না হয়েও গ্রামীণ ব্যাংক নামের
একটা এনজিও প্রতিষ্ঠা হতে না হতেই এতো তাড়াতাড়ি বিদেশী কর্মচারী নিয়োগ দিলো কিভাবে?
তাও আবার বিশ্বের পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকার! লোকটাকে দেখে একজন অভিজ্ঞ পরামর্শক বা
বিশেষজ্ঞ বলেও মনে হলো না। আবার ভাবতাম, যেহেতু এনজিও টাইপ ব্যাংক, হয়তো আমেরিকার
কোনো সংস্থার সাথে যৌথ মালিকানায় করেছে। কিন্তু এখন মনেহয় অন্যকিছু।
‘তাহলে কি তখন থেকেই বিষবৃক্ষের চাড়া রোপন শুরু হয়েছিলো’? কারণ বাংলাদেশের
ভূমির একটা কোনাও আমেরিকার নজরদারীর বাইরে থাকে না। যেখানে যা কিছু ঘটছে সবার আগে খবর
চলে যাচ্ছে আমেরিকার নীতিনির্ধারণী দফতর স্টেট ডিপার্টমেন্টে। দেশের মানুষ সেসব খবর
প্রথম জানতে পারে তাদের কাছ থেকেই।
এখন কথা হলো, আমেরিকা আমাদের শত্রু কেনো? আমাদের আমেরিকার ব্লকে থাকলে
সমস্যা কোথায়? সারাবিশ্বে আমেরিকার ৮০০টি সেনা ঘাঁটি রয়েছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াতেও
আছে। দক্ষিণ কোরিয়ার লোকেরা আমেরিকানরা কীভাবে ‘হাগে-মোতে’ সেটাও অনুসরণ করে। সে সব
দেশ তো অনুন্নত না, বরং উন্নতির সোপান বেয়ে সনৈ সনৈ করে উপরে উঠছে। তাহলে আমাদের সমস্যা
কি?
সমস্যা আছে বৈ কি! জাপান কোরিয়াতে আমেরিকার সেনা ঘাঁটি থাকলেও কিছুটা
তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার বড় শত্রু তাদের পার্শ্ববর্তী দেশ উত্তর
কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া আমেরিকারও শত্রু। কিছুটা ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’র মতো আর কি।
১৯৯০-৯১ সালের দিকে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে তাদের সাথে একীভূত
করতে চেয়েছিলো। দক্ষিণ কোরিয়ার এক নাগরিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের দুই কোরিয়া তো
জার্মানীর মতো একসাথে মিলে যাচ্ছে। হলে ভালোই হবে। দেশ বড় হবে, দেশের শক্তি বৃদ্ধি
পাবে। লোকটা শুনেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো, “আমাদের কি পাগলে পেয়েছে? আমরা কিছুদিনের
মধ্যে জাপানকে টেক্কা দেবো”।
উত্তর কোরিয়া হয়তো জোর করে হলেও দক্ষিণ কোরিয়াকে তাদের সাথে মিলিয়ে
ফেলতো। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শক্তি ততোটা পোক্ত না। তারা প্রযুক্তি, সমাজ এবং
মানব উন্নয়নেই বেশি শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় করে। উত্তর কোরিয়া যাতে হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়,
সেকারণেই হয়তো আমেরিকাকে ঘাঁটি করতে দিয়েছে।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার ঘাঁটি থাকলেও তারা তাদের বেশি আস্ফালন
করার সুযোগ দেয় না। কোনো সেনা সদস্য ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে কোনো অপরাধ করলে সে
দেশের জনগণই সোচ্চার হয়ে ওঠে।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, যে দেশে আমেরিকার
সেনাঘাঁটি আছে, সে দেশ ভালো নেই।
তবে আমাদের সমস্যাটা আলাদা। আমাদের দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে
গেঁথে আছে একটাই কথা, আমেরিকা আমাদের দেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা চেয়েছিলো এক পাকিস্তান
রেখে পাকিস্তানের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ভারত রাশিয়াকে কোণঠাসা করে
রাখতে। যে কারণে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানকে যুদ্ধে
সহায়তা করতে ৭ম নৌবহর পাঠিয়েছিলো। সোভিয়েত রাশিয়া হুমকি না দিলে ৭ম নৌবহর ফেরত যেতো
কিনা, আদৌ বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা, সে সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধে
আমাদের মূল সাহায্যকারী দেশ ভারতের সামরিক শক্তি তখন যা ছিলো তাতে আমেরিকার সাথে যুদ্ধে
জড়াতে হিমশিম খেতে হতো। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘায়িত হতো যুদ্ধ।
লোকবল ক্ষয় হতো। মানুষের দুর্দশার সীমা থাকতো না। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে না দাঁড়ালে,
৭ম নৌবহর ভিড়তে পারলে ভারতের একার পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যেতো। ‘অন্যদিকে ভাবলে
সেটাই হয়তো ভালো হতো। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা মানুষ সহজে ভুলতো না। জাতি দুইভাগে বিভক্ত
হতো না!’
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ যখন চলে বিশ্বে তখন দুটি পরাশক্তি - যুক্তরাষ্ট্র
এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই দুই পরাশক্তির মধ্যে সব সময় স্নায়ূযুদ্ধ লেগে থাকতো। কে কাকে
কোনঠাসা করে বিশ্বে মোড়লীপনা বজায় রাখা যায় সেই প্রতিযোগিতা। তবে আধিপত্য বজায় রাখতে
আমেরিকা যেমন আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করতো, সোভিয়েত ইউনিয়ন তা ছিলো না। সোভিয়েত ইউনিয়ন
ছিলো শান্তিপ্রিয়। এই অঞ্চলে যাতে অশান্তি সৃষ্টি না হয় সেটাই তাদের লক্ষ্য।
আমেরিকার উদ্দেশ্য, এক রাষ্ট্রের সাথে আরেক রাষ্টের যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে
অস্ত্র ব্যবসা করা। আর সম্পদ আহোরণে কারিগরী সহায়তার মধ্যমে সম্পদের বৃহদাংশ ভোগ করা,
যেমনটা মধ্যপ্রাচ্যে করে আসছে।
শেষ পর্যন্ত নানা কলে কৌশলে সে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও ভাঙতে সক্ষম হয় আমেরিকা।
১৯৯১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৪-১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের
জন্ম হয়।
যাইহোক, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে, উপরে বর্ণিত কারণগুলি অর্থাৎ স্বাধীনতার
বিরোধিতা করা এবং স্বাধীনতার সাহায্যকারী দেশগুলোর প্রতি আমাদের আনুগত্যের কারণে তাদের
প্রভাবে চারিদিকে ভারতবেষ্টিত বঙ্গোপসাগরের পাড়ে এক খন্ড বাংলাদেশ কখনও আমেরিকাকে মিত্র
বানাতে পারেনি। এরপর আছে স্বাধীনতাযুদ্ধে বাধা দিয়ে বিফল হওয়ার গ্লানি। ফলে আমেরিকাও
বাংলাদেশকে কখনো প্রকৃত মিত্র ভাবতে পারেনি। পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের মাধ্যমে সব সময়
দেশের মধ্যে একটা জটিলতা সৃষ্টি করে রাখতে চেয়েছে, যার সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ২০২৪ সালে।
জানিনা ভবিষ্যতে কোনপথে পরিচালিত হয় বাংলাদেশ? কীভাবে নির্ধারিত হয়
বাংলাদেশের ভাগ্য!
ঘোষণাঃ
সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনা থেকে লেখা। চিন্তাধারার সাথে না
মিললে, ভিন্নমত বা ধারণা থাকলে কিংবা তথ্য উপাত্তে ভুল থাকলে দয়া করে মন্তব্য কলামে
জানিয়ে ভুল শুধরাতে সাহায্য করুন।