মুকুটহীন সম্রাট অভিনেতা আনোয়ার হোসেন
আনোয়ার হোসেন |
বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব...
আনোয়ার হোসেন। এমনই একজন আন্তর্জাতিক মানের বলিষ্ঠ অভিনেতা যাঁর সম্মানে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে টলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার দীর্ঘদিনের বন্ধ মেকআপ রুম খুলে দেয়া হয়েছিলো।
১৯৭৩ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হচ্ছিলো 'শঙ্খবিষ' চলচ্চিত্র। নায়ক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। দুঃখের বিষয় ছবিটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশের
চলচ্চিত্রে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে খ্যাত অভিনেতার নাম আনোয়ার হোসেন।
১৯৬১
সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা
চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক ঘটে।
প্রথম
দিকে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করলেও পরবর্তীতে তিনি চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে
প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৬৭
সালে খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায়
দুর্দান্ত অভিনয়ের কারণে তিনি মুকুটহীন সম্রাট উপাধি লাভ করেন।
পিতা
নজির হোসেন এবং মাতা সাঈদা খাতুনের তৃতীয় সন্তান আনোয়ার হোসেন স্কুল জীবন থেকেই
অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ থেকে অভিনয় শুরু করেন।
স্কুলে
আসকার ইবনে শাইখের 'পদক্ষেপ' নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। রূপালি জগতের তারকা ছবি
বিশ্বাস, কাননদেবী প্রমুখ অভিনয় শিল্পীদের প্রতি আকর্ষণ থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের
সিদ্ধান্ত নেন আনোয়ার হোসেন।
পরিচালক
মহিউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। মহিউদ্দিন তখন ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্র
নির্মানের কাজ করছেন।
চলচ্চিত্রের
জন্য সকল চরিত্র নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়ায় আনোয়ার হোসেন এ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ
পাননি। কিন্তু পরবর্তী ছবি ‘তোমার আমার’ এ খলনায়ক ‘বীরেন’ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ
পান।
৫২
বছরের অভিনয় জীবনে আনোয়ার হোসেন প্রায় পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন।
'লাঠিয়াল'
চলচ্চিত্রে প্রাণবন্ত, বলিষ্ঠ ও বাস্তবধর্মী অভিনয় করার জন্য ১৯৭৫ সালে প্রথম
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
পরবর্তীতে ২০১০ সালে চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।
আনোয়ার হোসেন অভিনীত রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন - বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের
প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলমান আন্দোলনরত জনতার মাঝে ব্যপক
সাড়া ফেলে। ১৯৭০ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনতাকে আজও উদ্দীপনা
জোগায়। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবীর চলচ্চিত্রটিকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী
বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেন।
আনোয়ার হোসেন অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহঃ
- চোখের জলে
- সূর্যস্নান
- জোয়ার এলো
- কাঁচের দেয়াল
- নতুন দিগন্ত
- নাচঘর
- ধারাপাত
- রাজা এলো শহরে
- বন্ধন
- গোধূলীর প্রেম
- রাজা সন্ন্যাসী
- রূপবান
- জরিনা সুন্দরী
- পরশমনি
- জংলী ফুল
- রাখাল বন্ধু
- জুলেখা
- শহীদ তীতুমীর
- বাঁশরী
- সপ্তডিঙ্গা
- গাজী কালু চম্পাবতী
- স্বর্ণকমল
- আনোয়ারা
- নীল আকাশের নীচে
- স্বরলিপি
- বাহরাম বাদশা
- লালন ফকির
- অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী
- বাঘা বাঙালী
- রংবাজ
- দয়াল মুরশিদ
- আলোর মিছিল
- ঈশা খাঁ
- কার হাসি কে হাসে
- লাঠিয়াল
- দেবদাস
- বড় ভালো লোক ছিল
- লালুভুলু
- ভাত দে
- পেনশন
- শিরি ফরহাদ
- ত্যাজ্যপুত্র
- আমার দেশ আমার প্রেম
- ঢেউয়ের পর ঢেউ
- নবাব সিরাজউদ্দৌলা
- জীবন থেকে নেয়া প্রভৃতি।
আনোয়ার হোসেনের জন্ম বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুরে ৬ নভেম্বর ১৯৩১ সালে। ১৯৫১ সালে তিনি জামালপুর থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পরে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন নাসিমা খানমকে। তিনি চার পুত্র সন্তানের জনক।
২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিংবদন্তি এই অভিনেতার জীবনাবসান ঘটে। সেই সাথে চির অবসান ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি সোনালি অধ্যায়ের। শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখকঃ
মেসবা খান
(সম্পাদিত)