হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে (পর্ব-৭ এবং শেষ পর্ব)
ছবিঃ প্রতীকী |
নবীজি(সাঃ) কোনো এক রমজানে তিনদিন রাতে তারাবী নামাজ আদায় করেন। লোকেরা তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করেন। চতুর্থ দিন ফরজ হয়ে যাওয়ার আশংকায় তিনি আর হুজরা থেকে বের হননি। ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বলতে, লোকেরা এটাকে ফরজ বানিয়ে ফেলবে এই আশঙ্কায় তিনি আর তারাবি পড়েননি। কিন্তু রাসূল(সাঃ)-এর সময় প্রচলন না থাকলেও তারাবি নামাজেই আমাদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ!
ইমামের সাথে সম্মিলিত তারাবি সালাত আদায়ের প্রচলন করেছিলেন হযরত ওমর(রাঃ)। একজন হাফেজ সাহেব এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে তারাবি নামাজে কোরআন পাঠ করেন। তাতে আরবি জানা মানুষদেরও মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব। কোরআন এবং হাদিস অনুযায়ী সালাতে মনোযোগ দেয়া বাধ্যতামূলক। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন; “সুতরাং পরিতাপ সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য যারা তাদের সালাতে অমনোযোগী”-(১০৭:৪-৫)।
হাদিস অনুযায়ী সালাতে মনোযোগ নষ্ট করতে পারে এমন কারুকার্য, চাকচিক্য বর্জনীয়। রাসূল(সাঃ) একদা একটি কারুকার্য খচিত চাদর গায়ে দিয়ে সালাত আদায় করলেন। সালাতে এসে চাদরের কারুকার্যের প্রতি তার দৃষ্টি পড়লো। সালাত শেষে তিনি বললেন, ‘এ চাদরখানা আবুজাহামের কাছে নিয়ে যাও। তার কাছ থেকে কারুকার্য ছাড়া মোটা চাদর নিয়ে আসো। এটা তো আমাকে সালাত থেকে অমনোযোগী করে দিচ্ছিলো।
নবীজি(সাঃ) হযরত আয়েশা(রাঃ)কে বলেন, ‘আমার সম্মুখ থেকে এই বিচিত্র রঙের পর্দা সরিয়ে নাও। কারণ সালাত আদায় করার সময় এর ছবিগুলো আমার সামনে ভেসে ওঠে’।
সালাতে মনোযোগী হওয়া বলতে কি বুঝায়? ‘একজন অধ্যাপক ছাত্রদেরকে ক্লাসে মনোযোগী হতে বলার অর্থ তিনি যে লেকচার দিচ্ছেন তা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং বোঝা। যারা বিদেশে পড়তে যায় সেসব ছাত্ররা শিক্ষকের লেকচার যাতে বুঝতে পা্রে এটা নিশ্চিত হতে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টোয়েফেল বা আইএলটিএস চায়- যাতে প্রার্থীর ইংরেজী বোঝার সক্ষমতা যাচাই করা হয়। কোনো ছাত্র যদি শিক্ষকের ভাষা না বোঝে তাহলে সে শিক্ষক সক্রেটিস হলেও তার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারবে না।
ক্লাশে শিক্ষকের কথা যখন একজন ছাত্র না বোঝে তখন মনোযোগ দেয়- শিক্ষক কখন কাশি দিলেন, কখন হাঁচি দিলেন, কি রংয়ের শার্ট পরেছেন, শার্টে বোতাম কয়টা, কয়টা লাগিয়েছেন-কয়টা খোলা রেখেছেন ইত্যাদি গুরুত্বহীন বিষয়ের প্রতি। আমরা যেহেতু নামাজে পঠিত কোরআন বুঝি না, তাই আমরা হুজুরের আলখেল্লা, টুপি, পাগড়ি, আতর, সুরমা ইত্যাদিতে মনোযোগ দিয়ে মোটা তাজা আহাম্মক হচ্ছি।
আমীন জোরে না আস্তে এ বিষয়ে পিএইচডি করতে আমরা মদীনা, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি। মদিনা, আল-আজহার, হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড এগুলো অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়। তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো আহাম্মককে পাঠানো হলে সে মস্তবড় আহাম্মক হয়ে ফিরে আসবে। গাধাকে যদি উন্নতমানের খাবার দেয়া হয় সে মোটাতাজা হৃষ্টপুষ্ট গাধাই হবে, কোনোদিন ঘোড়া হবে না।
নামাজ পড়তে হবে নবীজি(সাঃ) যেভাবে পড়েছেন এই অজুহাতে মোটাতাজা আল্লামারা আমীন নিয়ে ঝগড়ায় আল্লাহর ঘরকে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেললেও হাদিস ঠিকমত পড়ে দেখে না। বুখারী শরীফের সহীহ হাদিস দেখুনঃ
হযরত উবাইদুল্লাহ(রাঃ) কাবার ইমাম ছিলেন। এখনকার ইমাম না। নবীজি(সাঃ)-এর সময়কার ইমাম। তিনি প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা এখলাস পড়ে তারপর অন্য আরেকটা সূরা পড়তেন। তাঁর পিছনে যারা বায়তুল্লাহ শরীফে নামাজ পড়তেন তারাও সবাই জাঁদরেল সাহাবী। সাহাবীরা বললেন, আপনি প্রতি রাকাতে সুরা ইখলাছ পড়েন কেনো? অন্য সুরা পড়লে তো সুরা ইখলাছ পড়ার দরকার নাই। উনি বললেন আমি এভাবেই নামাজ পড়াবো, তোমাদের পছন্দ না হলে তোমরা অন্য ইমাম খোঁজ করো।
কিন্তু তাঁর চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন আর কোন ইমাম তখনকার দিনে মক্কা এলাকায় নাই। সাহাবীদের সময়ে ক্বাবার ইমাম হওয়ার মতো তাঁর চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি ছি্লো না। চিন্তা করেন কেমন ইমাম ছিলেন তিনি। পরে নবীজি(সাঃ) মক্কায় এলে সাহাবীরা নবীজিকে ঘটনা জানালেন। নবীজি(সাঃ) বললেন, কি ব্যাপার ওবায়দুল্লাহ, আপনি সূরা ইখলাস প্রতি রাকাতে ফিক্সড করে ফেললেন কেনো? আপনি ইমামতি ছেড়ে দিবেন, কিন্তু সুরা ছাড়বেন না, কারণ কি? তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এই সূরাটা খুব ভালোবাসি’। নবীজি(সাঃ) বললেন, ‘এই সুরার প্রতি আপনার ভালবাসা আপনাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে’।
নবীজি(সাঃ) তো হযরত উবাইদুল্লাহ(রাঃ) বেদাতী বলননি, বরং জান্নাতী বলেছেন। নবীজি(সাঃ) ত্তো বললেন না যে, তোমার এতো মাতাব্বরির দরকার নেই। আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছো সেভাবে নামাজ আদায় করবে।
নবীজি(সাঃ) শুধু অনুমোদনই দেননি, বলেছন এ সুরার প্রতি আপনার ভালোবাসা আপনাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। এখন আমরা যদি হযরত উবাইদুল্লাহ(রাঃ)’র মতো নামাজ পড়ি তো হবে না? নবীজি(সাঃ)-এর অনুমোদনও তো হাদিস। কিন্তু এ হাদিস আমরা জানিনা। কারণ এ হাদিস আমাদের ঝগড়ায় লাগে না।
নামাজ নিয়ে বড় বড় শায়খরা যা বলছেন তা বেশিরভাগই শুনে শুনে বলা কথা। হাদিসের সাথেও এসবের কোনো মিল নেই। কিন্তু অনেকেই সোজা সাপটা উত্তর জানতে চান যে, ‘তাহলে নামাজ পড়বো কিভাবে’? আর সোজা-সাপটা উত্তর দিতে গেলেই আপনি তো মাদ্রাসায় পড়েননি আপনি কেনো নামাজ নিয়ে কথা বলছেন? আপনি মানুষকে গোমরাহ করছেন। আপনি ইহুদীর দালাল ইত্যাদি!
নামাজ আপনি যেভাবে পড়েন সেভাবেই পড়বেন। আমাদের উদ্দেশ্য আপনাকে এটা পরিষ্কার করা যে, ‘হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে’ এই প্রশ্নটা বেশ অবান্তর এবং হাস্যকর। যেমন; ধরুন সড়কের অনিয়ম নিয়ে ট্রাফিক আইনের ব্যাখ্যা করে আমি একটি বই লিখলাম। আমার নাতি নাতনিরা এসে দাবি করলো যে, আমার দাদার বইয়ের নিয়ম-কানুন না মেনে আপনি সড়কে গাড়ি চালাবেন কিভাবে, রাস্তা পাড় হবেন কিভাবে, ট্যাক্স দেবেন কিভাবে? তো আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে? কেউ যদি বলে যে আপনার দাদার বই লেখার আগে মানুষ কিভাবে গাড়ি চালাতো? আর আপনার দাদাকে এই বই লিখতে বলেছে কে? এই একই প্রশ্ন ইমাম বুখারীকে যদি করা হয়, ‘এসব হাদিস সংগ্রহ করতে আপনাকে বলেছে কে’?
নামাজ আমরা বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, নাসাঈ এসব কিতাব অনুযায়ী পড়ি না। আমরা নামাজ পড়ি প্রচলিত ঐতিহ্যগত নিয়ম অনুযায়ী। সে ঐতিহ্যের কিছু ভিন্নতা আছে। তার বৈচিত্র্যময় বর্ণনা এসব অননুমোদিত অসম্পাদিত এবং অসম্পূর্ণ হাদিস ফিকাহ আর নূরানী নামাজ শিক্ষার কিতাবে।
এই ঐতিহ্যগত নিয়মে যেমন বৈচিত্র বা ভিন্নতা আছে, তার বৈচিত্রময় বর্ণনা এসব হাদিস ফিকাহর কিতাবেও আছে। সুতরাং হাদিসের কিতাব অনুযায়ী নামাজের কোনো মিলিটারী মান দাঁড় করাতে গেলে শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা মসজিদ বানাতে হবে। এসব কিতাব ধর্মের মানদন্ড নয়, এগুলো ঝগড়ার মানদন্ড।
হাদিসের কিতাবে না থাকলেই বেদাত। শুরু হয়ে গেলো কামড়াকামড়ি। কারণ একই ইমামের হাদিস বা ফিকাহর কিতাবে পরস্পর বিরোধী হাদিস বা ফতোয়া আছে। আবার হাজারও প্রশ্নের উত্তর হাদিস ও ফিকাহর কিতাবেও নাই। তাই এসব প্রশ্নই অবান্তর, অপ্রয়োজনীয়, অসার।
কোরআনে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকলে তা প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত যে কোনো রীতিতে করলেই হলো। মাদানী, আজহারী হুজুররা কেউ মদিনা আল আজহারে গিয়ে নামাজ শেখেনা। সবাই যার যার বাপ-দাদার নিয়মেই নামাজ পড়ে। মদিনা, দেওবন্দ ঘুরে এসেও বাপ-দাদার নিয়মই থাকছে। ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু হানিফা- সবাই বাপ দাদার কাছ থেকেই নামাজ পড়া শিখেছে। কোনো ফিকাহর কিতাব পড়ে শেখেনি। আপনিও আপনার বাপ-দাদার রীতিতেই নামাজ পড়বেন।
আপনার নামাজ হয় না, এ ফতোয়া জারি করার হনু কে? তাকে নবীর নায়েব নিয়োগ করলো কে? নবীজি(সাঃ) কিভাবে নামাজ পড়েছেন সে কিভাবে জানে? নামাজ হবে কি হবে না এ শর্ত কি হাদিসের ভিত্তিতে আরোপ করা যাবে? কোরআন এবং সহিহ হাদিস অনুযায়ী কোরআন বহির্ভূত বর্ণনার ভিত্তিতে আরোপিত শর্তের কোনো মূল্য নেই। নামাজের পরিচিত কাঠামো নবীজী(সাঃ)-এর প্রধান সাহাবীরা কেউ বর্ণনা বা সংরক্ষণ করেননি বা করার প্রয়োজন মনে করেননি।
তবে হাদিস থেকে নামাজ সম্পর্কে প্রাপ্ত ধারণা অনুযায়ী বোঝা যায়, রাসূল(সাঃ)-এর সময় নামাজ ছিলো মূলত মাতৃভাষায় কোরআনের পাঠচক্র। যাতে সব বয়সের সব শ্রেণী-পেশার পুরুষ-মহিলারা অংশ নি্তো। নিজ মাতৃভাষায় দিনে পাঁচবার কোরআনের পাঠচক্রে অংশ নিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে বুঝে বুঝে কোরআন পড়া, শোনা এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মাধ্যমে রাসূল(সাঃ)-এর সাহাবীরা প্রত্যেকে জীবন্ত কোরআন হয়ে ওঠে। এভাবে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কোরআন প্রতিষ্ঠা করেন।
জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সালাত কায়েম বা কোরআন প্রতিষ্ঠা করার নামে আমরা প্রতিনিয়ত ঝগড়া করছি। অথচ “আকিমুসসালাহ” বা সালাত প্রতিষ্ঠা হলো কোরআনের নিরবিচ্ছিন্ন অনুসরণ। অতএব,কোরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন। *সমাপ্ত*
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত