পথের পাঁচালীর বিভূতিভূষণ ও রমার অসম বিয়ের কাহিনী
দ্বিতীয় স্ত্রী রমা'র সাথে বিভূতিভূষণ বন্দোপ্যাধ্যায় |
বিভূতিভূষণ
বন্দোপ্যাধ্যায় ও রমা দেবী। দুজনের বয়সের ব্যবধান ২৯ বছর। বিয়ের প্রস্তাব এসেছি্লো
রমা'র কাছ থেকে। সময় চেয়েছিলেন 'পথের পাঁচালী'র স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দোপ্যাধ্যায়।
রমা’কে বুঝিয়েছিলেন নানা ভাবে। বয়সের অসম্ভব তফাতকে একেবারে গুরুত্বই দেননি রমা
দেবী।
রমা'র
বাবা ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়
ছিলেন আবগারি দপ্তরের আধিকারিক। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি
বনঁগা শহরে বদলি হয়ে আসেন৷ ষোড়শীকান্তের মেজ মেয়ে রমা'র হৃদয়ে তখন থেকেই সাহিত্যের
প্রতি প্রেম৷ একজন প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারেন “পথের পাঁচালী”র স্রষ্টা বিভূতিভূষণ
বন্দোপ্যাধ্যায় এই শহরে থাকেন৷ প্রিয় লেখকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা মনের কোণে জাগ্রত
হয়। বিলম্ব না করে সোজা চলে যান লেখকের বাড়ি৷
বাড়ির
অন্দরে খবর গেলো। মাদুর এনে বারান্দায় পেতে বসতে দিলেন লেখকের ভাগ্নী উমা৷ একটু
পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দোপ্যাধ্যায়। রমার হাতে তখন
অটোগ্রাফের খাতা। বিভূতিভূষণকে দেখে চোখে—মুখে খুশির ঝিলিক৷ লেখকের মুখ অবশ্য বেশ
গম্ভীর। অভিব্যক্তিতে বেদনার ছাপ। সৌজন্যমূলক কিছু কথার পরে রমা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন
অটোগ্রাফের খাতা। সেই খাতায় বিভূতিভূষণ লিখে দিলেন— “গতিই জীবন,গতির দৈন্যই মৃত্যু”৷
এবার
বাড়ি ফেরার পালা। তবে লেখককে আন্তরিক ভাবে অনুরোধ করেছিলেন, তাদের বাড়ি একদিন আসার
জন্য৷ উত্তরে বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তিনি একদিন তাদের বাড়ি যাবেন। কিন্তু
সঠিক দিন তিনি বলতে পারছেন না। কারণ তাঁর বোন জাহ্নবি নদীতে স্নান করতে গিয়ে আর
ফেরেনি। খোঁজাখুঁজি চলছে, তবে হয়তো সে জলে ডুবে মারা গেছে! রমাকে সঠিক ভাবে
অভ্যর্থনা করতে না পারার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখপ্রকাশ করলেন বিভূতিভূষণ৷
২৯ বছর ব্যবধানের দুই
নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব, চিঠি চালাচালি। রমার বাবা ষোড়শীকান্ত একদিন এসেছিলেন তাঁর
কন্যার প্রিয় লেখকের বাড়ি। ক্রমেই দুই পরিবারের কাছাকাছি আসা। বন্ধন আরও নিবিড় হয়।
বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো রমা'র কাছ থেকেই। সময় চেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। বোঝালেন নানা
ভাবে। বয়সের অসম্ভব তফাতকে একদম গুরুত্ব দিলেন না রমা৷ ১৯৪০সালের ০৪ ডিসেম্বর
(অনেকের লেখায় ০৩ডিসেম্বর) রমার বিয়ে হয়ে গেল অমর কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে। বয়স যেমন সেই বিয়েতে বাধা হয়নি। ঠিক তেমন স্বামী-স্ত্রী'র বয়সের
ব্যবধান দাম্পত্য সম্পর্কে কোনোদিন প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারেনি৷
পুত্রবধূ ও পুত্রকে রমা
বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, মরতে তিনি ভয় পান না। কারণ ওপারের ঘাটে তাঁর জন্য অপেক্ষা
করবেন স্বামী বাংলা সাহিত্যের অমর কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷
বিভূতিভূষণের প্রথম স্ত্রী
গৌরীদেবীর প্রয়াণের পর লেখক আর নতুন করে বিয়ের কথা ভাবেননি। কিন্তু মানুষ ভাবে এক,
হয় আরেক৷ শেষপর্যন্ত কন্যাসম রমাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাদের সম্পর্কে ভালবাসার
বাঁধন ছিলো অটুট৷ এর একটি প্রতিচ্ছবি আমরা দেখি, ১৯৪০ এর পর বিভূতিভূষণের
দিনলিপিতে কল্যানীদেবী্র (রমা'র ডাক নাম) নাম উল্লেখ সর্বত্র৷
নিজের জীবনে স্বামীকে রমা
পেয়েছেন মাত্র ১০ বছর৷ ১৯৫০-এর ০১ নভেম্বরে বিহারের ঘাটশিলা শহরে বিভূতিভূষণ পাড়ি
দিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। তিন বছরের শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এলেন
রমা। সত্যি বলতে, এরপর তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন স্বামীর প্রচারে, স্বামীর স্মৃতি
রক্ষায়৷
রমা’র লেখা “কাছে থেকে
দেখা” নামের জীবনী উচ্চ প্রশংসিত এবং জনপ্রিয়৷ কেবলমাত্র ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র
পৃথিবী একটি বিশেষ কারণে রমা দেবীর কাছে কৃতজ্ঞ। আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও শত
প্রলোভনেও অনেককে “পথের পাঁচালি” উপন্যাস চলচ্চিত্র রূপায়িত করার প্রস্তাব ফিরিয়ে
দিয়ে তিনি তুলে দিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম সত্যজিৎ রায়ের হাতে৷ তারপরের ইতিহাস আমাদের
কারো অজানা নয়৷
মৃত্যুর
আগে রমা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন আলঝেইমার্স রোগে। প্রিয়জনকে চিনতে
পারতেন না। কিন্তু তাঁর রচিত “বিভূতিজীবনীর” প্রচ্ছদ দেখে ছেলেকে বলেছিলেন, “তোর
বাবার ছবিটা খুব ভালো এঁকেছে”৷
ইন্টারনেট অবলম্বনে