অনুপ, আমাকে একটা গান শোনাও দেখি
সত্যজিত রায় ও অনুপ ভট্টাচার্য |
"সত্যজিৎবাবু যখন আমাকে' গুপী গাইন বাঘা বাইন'-এর গান গাওয়ার জন্য নির্বাচিত করেন, তখন আমার বয়স ১৮ বছর। যখন ছবি রিলিজ় করে, তখন ২১।
অত কম বয়সে কি আর বোঝা যায়, কত বড় মানুষের সঙ্গে কাজ করছি?
যেহেতু উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু, তাই অনেক ছোটবেলা থেকে ওঁকে দেখেছি। যাই হোক, একদিন আমাকে ওঁর বাড়িতে ডাকেন। বলেন,
"তুমি নাকি খুব সুন্দর গান গাইতে পারো? তোমার মা বললেন।
"অনুপ, আমাকে একটা গান শোনাও দেখি।"
ছোটবেলা থেকে গানবাজনার পরিবেশে বড় হয়েছি বলে আমার ভয়ডর চিরকালই কম। তাই আমি একটা বাংলা গান শোনাই। তারপর উনি আমার কাছ থেকে একটা ক্লাসিক্যাল গান শুনতে চান। সেটা শোনার পরেই বুঝতে পারি, আমাকে ওঁর পছন্দ হয়েছে।
একদিন রিহার্সালে ডাকেন। আমার আজও মনে আছে, খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমাকে উনি 'ভূতের রাজা দিল বর' গানটি শুনিয়েছিলেন। কী অসাধারণ গলা! তারপর তো আমাদের চার মাস ধরে রিহার্সাল চলল। কিন্তু মূল টেকের দিন হল সমস্যা।
তখন লাইভ অর্কেস্ট্রেশনের সঙ্গে গাইতে হত তো... সেসব দেখে রবি ঘোষ একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। তাই 'আহা ভূত'-এর পর ঠিক তাল, লয়ে 'বাহা ভূত'টা বলতে পারছিলেন না। তাই সত্যজিৎবাবু আমাকে বলেন, ঠিক তালের সময় রবিদার কোমরে একটা খোঁচা দিতে, যাতে কিউ ধরতে অসুবিধে না হয়! সত্যিই আর কোনও ঝামেলা হয়নি সেদিন।
পরে আমি ভেবেছি, কী করে একজন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ এমন সুর দিতে পারেন যে, সে সব কালজয়ী হয়ে যায়? পরে গল্পে-গল্পে তার উত্তরও উনি আমাকে দিয়েছিলেন।
বলেছিলেন, "কী বলো তো, আমি ছোটবেলা থেকে গান জিনিসটা মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে এসেছি। ছোটবেলায় পকেটমানি দিয়ে ওয়েলিংটন থেকে বিভিন্ন রকমের রেকর্ড কিনতাম। সেসব শুনে আমার কান খুলে গিয়েছে। মনে হয়, গানের প্রতি সেই ভালবাসাই আমাকে দিয়ে ছবি করিয়ে নিয়েছে বা লিখিয়ে নিয়েছে।"
আজও কথাগুলো কানে বাজে। সংগ্রহী না হলে তো ভাল শিল্পী হওয়া যায় না! একজন মানুষ তখনই বড় হন, যখন বিনয়, শ্রদ্ধা, জ্ঞানের ও বিশ্বাসের সঠিক মিশেল ঘটে। যে বিশ্বাস উনি আমার উপর দেখিয়েছিলেন, তা আমৃত্যু ভুলতে পারব না।
'গুপী'র গান গাওয়ার জন্য তো সত্যজিৎবাবু আমার আগে কিশোরকুমারের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কিশোর রাজি হননি। অথচ দেখুন, প্রথম ছবি ওরকম সাফল্য পাওয়ার পর কিশোরকুমারকে কিন্তু ফিরে আসতে হয়েছিল। শুনেছি, অন্য এক ব্যক্তি মারফত তিনি ওঁর কানে দিয়েছিলেন যে 'গুপী'র গানগুলো তিনি গাইতে চান!
মান্না দে-ও তো এক পত্রিকার সম্পাদককে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন, গানগুলো যাতে তাঁকে গাইতে দেওয়া হয়। কিন্তু সত্যজিৎবাবু স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন,
"অনুপ ছাড়া আর কারও গলায় ওই গান মানাবে না।"
ভাবুন, বয়সে কত ছোট আমি, কিন্তু তা-ও সম্মান দিতে কার্পণ্য করেননি তিনি!"
- ড.অনুপ ঘোষাল।
সৌজন্যে : 'আনন্দলোক' পত্রিকা
(সংগৃহীত)
নোট: সত্যজিৎ রায় ও অনুপ ঘোষাল দুজনই আজ প্রয়াত।