হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে (পর্ব-৬)
প্রতিটা সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর
নিজস্ব কিছু নিয়মকানুন থাকে। কঠোর অনুশীলন এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটা
সদস্যকে বাহিনীর নিয়ম কানুন মেনে চলায় অভ্যস্ত করে তোলা হয়। এসব নিয়ম কানুনের উদ্দেশ্য,
সদস্যদের আচরণে পরিবর্তন আনা। সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর পোশাক, স্যালুট এবং প্রশিক্ষণে
ভিন্নতা আছে। সেনা সদস্যদের সেলুটের সময় হাতের তালু বাইরের দিকে থাকে, আর নৌবাহিনী
সদস্যদের সেলুটের সময় হাতের তালু ভেতরের দিকে থাকে। দুই বাহিনীর সদস্যরা দুইভাবে স্যালুট
দিলেও মূল উদ্দেশ্য এক। চেইন অব কমান্ড বা কমান্ডিং সিস্টেমকে সম্মান দেখানো।
নামাজের শারীরিক ভঙ্গি এবং কাঠামো নিয়ে
মারামারি করে আমরা মসজিদ আলাদা করে ফেললেও বাস্তবে তা নামাজের একেবারেই ঐচ্ছিক বিষয়।
যেমন, ইদের নামাজ ৬ তকবির বা ১২ তকবিরে পড়া উভয় নিয়মকেই সহীহ বলেছেন ইমাম আবু হানিফা।
অর্থাৎ ৬ তাকবির ৮ তকবির ১৬ তাকবির এগুলো সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়। তবে যেহেতু এর পক্ষে
বিপক্ষে সহীহ হাদিস আছে, তাই এগুলো নিয়ে চিরস্থায়ী ঝগড়া করা যাবে।
ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক,
ইমাম হাম্বলের মতো পন্ডিতরাও নামাজের সর্বসম্মত কাঠামো দাঁড় করাতে পারেননি। প্রতিটা
মাজহাবের আলেমদের মধ্যেই নামাজের অসংখ্য মাসআলা নিয়ে বিরোধ আছে। এর অন্যতম প্রধান
কারণ, নবীজি(সাঃ) কিভাবে নামাজ আদায় করেছেন বা কিভাবে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন
তার সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ এবং ধারাবাহিক বিবরণ তার প্রধান সহচররা কেউ দেননি।
‘হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে’- হাদিস
ছাড়া ইসলামকে অসম্পূর্ণ প্রমাণের প্রধান অজুহাত হলেও বাস্তবে আমরা হাদিস অনুযায়ী
নামাজ
পড়ি না। আমরা নামাজ পড়ি হাজার বছর ধরে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী। হাজার বছর ধরে ক্বাবায়
নিয়মিত নামাজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সে অনুযায়ী সারা পৃথিবীর মুসলমানরা নামাজ পড়ে। কিন্তু
নামাজের নিয়ম-কানুন আবিষ্কার করে যুগে যুগে অনেক মুফতি মুহাদ্দিস ‘চৌধুরী’ সেজে বসে
আছেন। তারা হাদিস ফিকাহ আবিষ্কার না করলে নাকি মানুষ নামাজ পড়তে পারতো না। কিন্তু
বাস্তবে এসব হাদীস ফিকাহর কিতাব ‘মাথা কাটা সৈন্যের পা কাটার মতো’।
“এক যুদ্ধ শেষে এক যোদ্ধা নিজের বীরত্বের
বর্ণনা দিতে গিয়ে বললো, ‘আমি এক শত্রুসেনার পা কেটে দিয়েছি। শ্রোতারা জিজ্ঞেস করলো,
‘ভাই তুমি মাথা না কেটে পা কাটলে কেনো’? সে বললো, ‘মাথাটা আগেই কাটা ছিলো’।“
হাদিস দিয়ে নামাজের সর্বসম্মত কাঠামো দাঁড় করানো
সম্ভব নয়। নামাজের কাঠামো সম্পর্কে ধারণা নাই এমন কেউ হাদিস দিয়ে নামাজ পড়তে পারবে
না। নামাজের অসংখ্য হাদিস যেমন বর্ণিত হয়নি, তেমনি নামাজ নিয়ে অসংখ্য জাল হাদিসেরও
আজ পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।
একটা জাল হাদিস বানান যেটা মুহাদ্দিসরা
ধরতে পারবে না, এমন চ্যালেঞ্জ দেয়া শাইখুল হাদিসের বিরুদ্ধে ৮০ ভাগ হাদিস অস্বীকারের
অভিযোগ তুলেছেন আরেক আজহারী শায়খুল হাদিস। এক শায়খের হাদিস আরেক শায়খ মানে না।
রাসুল(সাঃ) যেভাবে নামাজ আদায় করেছেন
ঠিক সেভাবে নামাজ পড়তে হবে, এমন একটি হাদিসের ভিত্তিতে আহলে হাদিস আন্দোলন শুরু হয়েছে।
রাসূল(সাঃ) বলেছেন, “সল্লু কামা রাআইতুমুনি উসল্লি” অর্থাৎ তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছো সেভাবে নামাজ
পড়বে (তাওহিদ পাব্লিকেশন হাদিস নং ৬৩১)।
তো নবীজি(সাঃ)কে নামাজ পড়তে শুধু আবু
হুরায়রা, আবু সাঈদ খুদুরী(রাঃ) দেখেছেন? হযরত আবুবকর(রাঃ), ওমর(রাঃ) দেখেননি? নবীজি(সাঃ)-এর
সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর হযরত আবুবকর(রাঃ)। তিনি হিজরতের সময়ও নবীজি(সাঃ)’র সাথে ছিলেন।
তিনি নামাজের সঠিক এবং সম্পূর্ণ কাঠামো বর্ণনা করা তো দূরের কথা, বুখারী শরীফের সালাত
অধ্যায়ে হযরত আবুবকর(রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসও নাই।
রাসুল(সাঃ) কিভাবে নামাজ পড়েছেন তার
বিস্তারিত বর্ণনার জন্য ইমাম বুখারীর কাছে হযরত আবুবক্কর(রাঃ) বা ওসমান(রাঃ)দেরকে নির্ভরযোগ্য
মনে হয় নাই? অথচ বুখারী শরীফেই বর্ণিত আছে যে, রাসূল(সাঃ) বলেছেন, জান ও মাল দিয়ে
আবুবকরের চেয়ে অধিক কেউ আমার প্রতি এহসান করেনি। আমি কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ
করলে অবশ্যই আবু বকরকে গ্রহণ করতাম।
সম্প্রতি “রাসূল(সাঃ)-এর নামাজ” শিরোনামে
নাসির উদ্দিন আলবানীর বই’কে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে আহলে হাদিস আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে।
‘হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বা কেমনে’ এই প্রশ্ন করা ওলামাদের কারো যে নামাজ হয় না তা আমরা
আলবানী সাহেবের বই থেকে জানলাম। কিন্তু প্রসিদ্ধ ইমামদের চেয়েও রাসূল(সাঃ)-এর নামাজের
বিশুদ্ধতম বিবরণ দিলেন নাসির উদ্দিন আলবানী! (আলহামদুলিল্লাহ!)।
নাসির উদ্দিন আলবানীর ১০০ ভাগ সহীহ নামাজের
আন্দোলনের ভিত্তিও এই হাদিস- যে নামাজ পড়তে হবে নবীজি(সাঃ) যেভাবে নামাজ পড়েছেন।
নইলে মসজিদ আলাদা, মাদ্রাসাও আলাদা। তো আলবানীর আগে সবাই আবু জেহেল, আবু লাহাবদের মতো
নামাজ পড়তেন? আবার শায়খ আলবানীর বই বাংলায় পাওয়া গেলেও আহলে হাদিসের আলেমরা সবাই
নামাজ শিক্ষার উপর আলাদা আলাদা বই লিখেছেন। অর্থাৎ কেয়ামত পর্যন্ত নামাজ শিক্ষা দেয়া
শেষ হবেনা!
নামাজের মাসআলা নিয়ে বিরোধের জের ধরে
সম্প্রতি তাবলীগ জামাতকে নিষিদ্ধ করেছে সৌদি আরব। “তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে
দেখেছো সেভাবে নামাজ পড়বে” এই স্লোগান দিয়ে জোরে আমীন, বুকের উপর হাত বাধার আন্দোলন
শুরু হলেও বাস্তবে হাদিসের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাসির উদ্দিন আলবানীর হাদিস পুরোটা
দেখুনঃ
এ হাদিস বিশ্লেষণ করলে আমরা পরিস্কার
দেখতে পাই, নবীজি(সাঃ) হযরত মালেক(রাঃ) এবং তার সাথীদেরকে উপদেশ দিয়েছেন- তাদের পরিবার-পরিজনদের
জ্ঞান শিক্ষা দিতে বলেছেন এবং তাদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দিতে বলেছে্ন। কিন্তু এ উপদেশগুলো
আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি! এরপর হযরত মালেক(রাঃ) আরও কয়েকটি বিষয় বলেছেন
যা পরবর্তী বর্ণনাকারী মুসান্নাফ-এর “মনে আছে বা মনে নাই”! এই হলো হাদিস বর্ণনাকারীদের
কঠিন স্মৃতিশক্তি। ‘মনে আছে কি মনে নাই’- তাও মনে নাই!
এরপর নবীজি(সাঃ) বলেছিলেন, “সাল্লু কামা
রাআয়তুমনি উসল্লী”- তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবে সালাত আদায়
করবে। যারা ছিলেন তারা নিজ চোখে নবীজিকে নামাজ পড়তে দেখেছেন। কিন্তু আমরা যারা নবীজিকে
নামাজ পড়তে দেখিনি, আমাদের জন্য সে নামাজের পরিপূর্ণ বর্ণনা হাদিসে দেননি কেনো?
“সাল্লু কামা রাআইতুমনি উসল্লী” এ বিখ্যাত
হাদিসের বর্ণনাকারী আমাদেরকে রাসূল(সাঃ)-এর নামাজ সম্পর্কে দুটি তথ্য দিয়েছেনঃ ‘নামাজের
সময় আযান দিবে এবং যে ব্যক্তি বয়সে তোমাদের চেয়ে বড় সে ইমামতি করবে’। এ হাদিসটি মারাত্মক
স্ববিরোধী।
এ কথাটা নবীজি(সাঃ) কাদেরকে বলেছেন এ
প্রশ্নের উত্তর বেশিরভাগ শায়খুল হাদিসের কাছে নাই। কারণ আমরা হাদিসের কিতাব থেকে হাদিস
পড়ি না। আমরা হাদিস পড়ি আমাদের দলীয় শায়খদের বই থেকে। তারা কাস্টম মেইড হাদীস দিয়ে
নতুন নতুন মতবাদ তৈরি করেন।
এ হাদিসে বলা হলো ‘তোমরা আমাকে যেভাবে
সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবে সালাত আদায় করবে’। একই সাথে বলা হচ্ছে, যে বয়সে বড়
সেই ইমামতি করবে। কিন্তু নবীজি(সাঃ)র নামাজে যে বয়সে বড় সে ইমামতি করতো না। নবীজি(সাঃ)র
চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবীরা নবীজির ইমামতিতে নামাজ পড়তো। তাহলে যে বয়সে বড় তার ইমামতিতে
নামাজ পড়া, নবীজির মত নামাজ পড়া হলো কিভাবে?
এখনকার সময়েও বয়স দিয়ে ইমাম নির্বাচিত
হয় না। এছাড়া এই হাদীসে রাসূল(সাঃ)-এর নামাজের আর কোন কাঠামোগত বর্ণনা নাই। হানাফী
মাজহাব অনুযায়ী কেবল তাকবীরে তাহরিমার সময় দুই হাত তুলবে। কিন্তু আহলে হাদিসের মতে
তাকবীরে তাহরীমার সময় রুকু কালে রুকু থেকে ওঠার সময় এবং দ্বিতীয় রাকাত তথা প্রথম
তাশাহুদ থেকে উঠার সময় রাফি ইয়াদাইন না করলে নামাজ শুদ্ধ হবেনা। সূরা ফাতেহার পর
হানাফীরাও আমীন বলে। কিন্তু আহলে হাদিসদের দাবি আমীন জোরে না পড়লে নামাজ শুদ্ধ হবেনা।
আচ্ছা আমীন কি আযানের মতো জোরে না একামতের মতো জোরে বলতে হবে? কতো কিলোহার্জ বা ডেসিবল
জোরে বলতে হবে? এগুলো তো হাদিসের কিতাবে নাই।
রসুল(সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে যেভাবে
নামাজ পড়তে দেখেছো সেভাবে নামাজ পড়বে’। এখন আমরা তো নবীজিকে নামাজ পড়তে দেখিনি,
সুতরাং হাদিসের কিতাবই ভরসা। কিন্তু দুইদলের বাইরে তো হাদিস আছেই। এর বাইরে ২২ তাকবীরের
নতুন দল বানাতে চাইলে তার পক্ষেও বুখারী শরীফের সহীহ হাদিস আছে। আমীন জোরে না আস্তে
তো মামুলী বিষয়, হাদিস অনুযায়ী সুরা ফাতিহা এবং অন্য সুরার মাঝখানে আস্ত সুরা ইখলাস
ঢুকিয়ে দিতে পারবেন।
হযরত ইকরিমা(রঃ) বলেন, ‘আমি মক্কা শরীফে
এক বৃদ্ধের পিছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি ২২বার তাকবীর বললেন। আমি ইবনে আব্বাস(রাঃ)কে
বললাম, লোকটি তো আহাম্মক! তিনি বললে্ ‘আরে, এটাতো নবী(সাঃ) সুন্নত’। অর্থাৎ নবীজি(সাঃ)
২২ তাকবিরেও নামাজ পড়েছেন। সুতরাং ১২ তাকবীর, ৪২ তাকবির নামাজের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য
বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, আল্লাহর শ্রেষ্টত্ব ঘোষণা করা। হাদিসটি দেখুনঃ
কিন্তু ৩২ তাকবীর বা ৪২ তাকবীর তো হাদিসে
নাই। হযরত ইকরিমা(রঃ) বর্ণনা না করলে ২২ তাকবীরের হাদিসও থাকতো না। কারণ ইবনে আব্বাস(রাঃ)
২২ তাকবিরকে নবীজি(সাঃ)এর সুন্নাহ বললেও আর কোনো সাহাবী এ হাদিস বর্ণনা করেননি। হযরত
ইকরিমা(রঃ)র মতো একজন জাদরেল তাবেঈ পর্যন্ত ২২ তাকবিরকে আহাম্মকী মনে করে বসে আছেন।
অথচ তা নবীর সুন্নাহ। বুখারী শরীফে সহীহ সনদে বর্ণিত হলেও আমাদের জীবনে আমরা কেউ ২২
তাকবিরে নামাজ পড়িনি। কারণ আল্লাহর কিতাবে নাই এমন সবকিছুই ঐচ্ছিক। নবীজি(সাঃ) ঐচ্ছিক
বিষয়গুলো একেক সময় একেক ভাবে করতেন যাতে লোকেরা সেটাকে নিয়ম না বানায়।