পূর্ববঙ্গে হিন্দু নির্যাতনের ইতিহাস
পূর্ববঙ্গে হিন্দু নির্যাতনের ইতিহাস
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের
উপস্থিতি হাজার বছরের পুরনো। তবে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর থেকেই
পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু সম্প্রদায় নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে।
১৯৪৭ থেকে ২০২৪: পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের ইতিহাস খুব বেদনাদায়ক-
বিশেষ করে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাহীনতা যুদ্ধকালিন হিন্দুরা যে নির্যাতনের স্বীকার
হয়েছে তা অবর্ণনীয়।
এই নিবন্ধে ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন ঘটনাবলি এবং এর
প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
১৯৪৭: দেশভাগ এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের
অবস্থা
১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর পূর্ববঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়
সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সম্পত্তি দখল
এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মতো ঘটনা বৃদ্ধি পায়।
- নোয়াখালী দাঙ্গা
(১৯৪৬): দেশভাগের ঠিক আগে ঘটে যাওয়া নোয়াখালী দাঙ্গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের
বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা হয়। হাজারো হিন্দু নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়।
- জমিদারি প্রথার
বিলুপ্তি: জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি এবং ১৯৫০ সালের "ইস্ট বেঙ্গল স্টেট
একুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট" হিন্দু জমিদারদের আর্থিকভাবে
দুর্বল করে তোলে।
১৯৫০-এর দশক: সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং অভিবাসন
১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। ফলে
প্রচুর সংখ্যক হিন্দু ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
- রাজশাহী ও
খুলনার দাঙ্গা: ১৯৫০ সালে এই দুই জেলায় ব্যাপক হিন্দু নির্যাতন হয়।
- প্রচলিত আইন: তৎকালিন পাকিস্তান
সরকার হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন করতে থাকে।
১৯৬৫: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং হিন্দুদের
অবস্থা
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় হিন্দুদের পাকিস্তানের শত্রু মনে করে বৈষম্যের
শিকার করা হয়। তখনও অনেকে গৃহত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
- শত্রু সম্পত্তি
আইন: যুদ্ধের পরে শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণয়ন করা হয়, যার ফলে হিন্দুদের
বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হয়।
১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধ এবং হিন্দুদের ভূমিকা
১৯৭১
সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালিন সবচেয়ে বেশী প্রাণ দিয়েছে এদেশের হিন্দুসম্প্রদায়ের
লোক। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও তারা ছিল
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল বেশিদিন ভোগ করতে পারেনি তারা।
সব সময়ই পীড়ন নিপীড়নের খাঁড়া বয়ে বেড়াতে হয়েছে।
·
গণহত্যা: পাকিস্তানি সেনারা হিন্দুদের নির্যাতন,
হত্যা এবং ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা চালায়। প্রাণ বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানী সামরিক
বাহিনীর কাছে কেউ নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিলেও বলতো, ‘কলমা বাতাও’। তাতেও নিশ্চিত
হতে না পারলে বলতো, ‘লুঙ্গি উতারো’। অর্থাৎ কাপড় খুলে পরীক্ষা করতো হিন্দু না
মুসলমান।
·
শরণার্থী সংকট: প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ ভারতে শরণার্থী
হিসেবে আশ্রয় নেয়, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল হিন্দু।
স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুদের অবস্থা (১৯৭২-২০০০)
স্বাধীনতার পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি যুক্ত হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায়
হিন্দু সম্প্রদায় নানা নিপীড়নের শিকার হয়।
- ১৯৭৫-এর
রাজনৈতিক পরিবর্তন: বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনের সময় হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বাড়ে।
- ১৯৯২: বাবরি
মসজিদ ভাঙার পর বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া: ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার
পর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘরবাড়ি আক্রান্ত
হয়।
২০০১-২০১৪: রাজনৈতিক সহিংসতা এবং
হিন্দু নির্যাতন
২০০১ সালের নির্বাচন বিএনপি ও জামাতে ইসলামী সহ ৪ দলীয় ঐক্যজোট সরকার গঠন
করার পরে ব্যাপকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়। এই সময়ও হাজার হাজার
হিন্দু পরিবার ভারতে পালিয়ে যায়।
- মন্দির ধ্বংস ও
ধর্ষণ: এই সময়ে মন্দির ধ্বংস, নারীদের ওপর নির্যাতন এবং সম্পত্তি দখলের মতো
ঘটনা ঘটে।
- ২০১৩ সালের
শাহবাগ আন্দোলন: জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে উত্তেজনার সময়
হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
২০১৫-২০২৪: সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
এই সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিমাণ কিছুটা কমলেও বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি হিন্দুদের অনিরাপদ করে তুলেছে।
- ২০২১: কুমিল্লা পূজামণ্ডপ হামলা: দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় একটি মন্দিরে কোরআন অবমাননার অভিযোগে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, এতে বেশ কয়েকজন নিহত হয় এবং মন্দির ও হিন্দু বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়।
- ২০২২-২০২৩: বিভিন্ন জায়গায় মন্দির আক্রমণ এবং ধর্মীয় স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
০৫ আগষ্ট ২০২৪ এর পর
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক সহিংসতা
ঘটে, যা রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে তীব্র আকার ধারণ করে। ৫ আগস্ট ব্যাপক আন্দোলনের
মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। দেশজুড়ে একটি
রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, যা কিছু উগ্রপন্থী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে কাজে লাগায়।
এই সময় বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে
হামলা চালানো হয়।
প্রধান ঘটনাবলি:
- খুলনা বিভাগে সহিংসতা: খুলনা জেলায় ৭৪টি বাড়ি ও ব্যবসা ধ্বংস করা হয়। যশোরের বেজপাড়ায় ২০০ হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হয়, যেখানে অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
- নিহত ও আহত: বিভিন্ন হামলায় অন্তত ৯ জন নিহত এবং বহু পরিবার গৃহহীন হয়। এছাড়া অনেককে অপহরণ করা হয় এবং নারীদের উপর সহিংসতা চালানো হয়।
- মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর: পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ৫-৯ আগস্টের মধ্যে ৩০টি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর এবং ৪টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
- রাজনৈতিক প্রতিহিংসা: এই সহিংসতাগুলোর পেছনে ধর্মীয় উন্মাদনার পাশাপাশি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ
সরকারের কাছে দ্রুত এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। তারা এই ঘটনাগুলোকে
বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলাফল হিসেবে দেখছে এবং ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের
দাবি জানিয়েছে।
এই সহিংসতার ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে
এবং আন্তর্জাতিক মহলে এর প্রতিক্রিয়া তীব্র হচ্ছে।
পরিসংখ্যান ও প্রভাব
তৎকালিন বৃটিশ শাসিত ভারতের আদমশুমারি অনুসারে ১৯৪১ সালে পূর্ব বাংলায়
হিন্দু বসতি ছিলো ২৮ শতাংশ। ১৯৪৬ এর দাঙ্গায় পালিয়ে এবং ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে স্বেচ্ছায় বহু হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। ফলে ১৯৪৭ এর
পরে হিন্দু জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ শতাংশ। ১৯৫০ এর দাঙ্গায় এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত
যুদ্ধে এবং পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে যেতে যেতে ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭.৯৫ শতাংশে
নেমে এসেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে অনেক হিন্দু পরিবার
তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ১৯০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত আদমশুমারী
একটি চিত্র নিম্নে দেয়া হলোঃ
আদমশুমারী রিপোর্টঃ ১৯০১-২০২২ |
উপসংহার
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে সুশাসন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সময়ে কিছু উগ্রবাদী সংগঠণ নানাভাবে ধর্মীয় উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে। হিন্দুরাও এবার তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া চট্টগ্রাম রংপুর সহ কয়েক জায়গার ঘটনা পর্যালোচনা করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশংকা করছে অনেকে।
পৃথিবীর কোথাও ধর্ম নিয়ে এমন মানুষে মানুষে এতো বিভাজন নাই। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্ম অনুসরপণ করে, কিন্তু দেশপ্রেমে সবাই এক। এর পরিসমাপ্তি কোথায়?