রিকশার শহর ঢাকা

 
বর্তমানে ঢাকার রিকশা


আপনারা কেউ ভিক্ষুকের আন্দোলন দেখেছেন? আমি দেখেছি।

“১৯৬৯ সাল। ঢাকায় তখন আইউবশাহী পতনের আন্দোলন তুঙ্গে। মিছিলের পর মিছিল। আইউব খান পদত্যাগের কিছুদিন আগে বা পরে ঢাকায় ভিক্ষুকদের আন্দোলন দেখেছি। দাবি বেশি ছিলো না। একটাই দাবি, যা তারা শ্লোগানে বলছিলো, “৫ পয়সা ১০ পয়সার কম ভিক্ষা দেওয়া চলবে না”।

ওই সময় দোকানিরা ১ পয়সা, ২ পয়সার কয়েন দিয়ে বিদায় করতো। করবেই বা কি? এতো পরিমান ভিক্ষুক হতো, শুক্রবারে শুধুমাত্র ভিক্ষা দেওয়ার কাজেই দোকানের একজন কর্মচারী নিয়োজিত থাকতো। দোকানের সামনে লাইন দিতো। সবাইকে বিদেয় করতে হলে দোকানির সামর্থ অনুযায়ী যা পারতো, তাই দিতো। অচিরেই সেদিন দেখতে হয় কিনা কে জানে!”

যাইহোক, বিষয় প্রসঙ্গে আসি। ‘রিকশার শহর ঢাকা’ এটা বিশ্বব্যপী নাম আছে। শুনেছি এককালে ইংল্যান্ডের শাসনাধীন ঢাকা শহরের স্মৃতি সংরক্ষণার্থে লন্ডন শহরের একটি নির্দিষ্ট সড়কে রিকশা চলাচল করে। নিউইয়র্কের কিছু এলাকায়ও রিকশা চলে আজকাল।

 

লন্ডন শহরে রিকশা                                     নিউইয়র্ক শহরে রিকশা  

ঢাকায় রিক্সা চলাচল মোটামুটি কন্ট্রোলে ছিলো। ২০২০ সালে দেশে করোনা রোগ বিস্তারলাভ করলে মাঝে মাঝে ‘লক ডাউন’ দিতে হতো। বাস চলাচল বন্ধ রাখতে হতো। বাস বন্ধ থাকায় যেসব সড়কে রিকশা চলাচল নিষেধ ছিলো, সেসব সড়কেও রিকশা চলাচল শুরু হয়। মানুষ আগারগাঁও, মিরপুর থেকে রিকশায় মতিঝিল এসে অফিসে করতো। কেউ কেউ উত্তরা, ম্নারায়ণগঞ্জও চলে যেতো রিকশায়। সেই যে শুরু হলো তারপর আর সহজে কন্ট্রোল করা যায়নি।

বছর দুয়েক আগে ঢাকার দুই সিটি মেয়র ডিআইটি রোডে রিকশা বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়। রামপুরা, বাড্ডা এলাকায় রিকশা চালকদের সাথে পুলিশের ব্যপক সঙ্ঘর্ষ হয়। পরে সিদ্ধান্ত থেকে পিছে হটে মেয়রদ্বয়। তারও অনেকে আগে দূরপাল্লার রোডে ‘থ্রি হুইলার’ বন্ধের নির্দেশ দিয়ে ব্যর্থ হয় সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

মাস কয়েক আগেও সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তৎকালিন সরকার। এভাবে প্রতিটা পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ায় সড়কে রিকশার চলাচল আরো বেড়ে যায়।

গত জুলাই মাসের পর থেকে দেশে অবরোধ, রাস্তা ব্লক ইত্যাদি কারণে বাস চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় প্রধান প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল আরও বেড়ে যায়। ৫ ই আগস্ট-এর পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। বড় যানবাহন চলাচল কমে যায়। পুলিশ না থাকায় ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। সবকিছুই যখন অনিয়ম হয়ে যায় তখন রিকশা, অটো রিক্সা কি আর নিয়ম মানে – যার চালকদের অধিকাংশই অশিক্ষিত!

গত তিনমাসে ঢাকায় রিকশার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এমন অবস্থা যে বড় গাড়িগুলো রিকশার প্যাচে পড়ে এগুতে পারে না। মানুষজনও রিকশার কারণে রাস্তা পার হতে পারে না। ওরা কোনো নিয়ম-কানুন মানে না। বড় গাড়িকে বেরিকেড দিয়ে নিজে আগে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সাইড তো দেয়ই না। ওরা সিগন্যালও মানে না। সড়ক শৃংখলা তো জানেই না। দেশের আইন মানে না কেউই। ওরা তো রিকশাচালক। মানুষের মধ্যে আইন অমান্য করার প্রবণতা এতো বেড়ে গেছে যে, যে যেমন ভাবে, যে যেমন বোঝে এবং বলে যেন সেটাই আইন- শুধু খুঁটির জোর থাকলেই চলে।

 
আয়েশী ভঙ্গিতে ঢাকার স্মার্ট রিকশাচালক

এবার আদালতের সিদ্ধান্তে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করতে গিয়ে তুলকালাম কান্ড হয়ে গেলো। এমনটা অনাকাঙ্খিত। কিন্তু ঢাকায় এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে অন্য কোনো যানবাহন চলাচলের উপায় নাই। এর এরপরও এভাবে ঝোঁকের মাথায় হুট করে কোনো পদক্ষেপ নিলে তার ফলাফল পজিটিভ আশা করা যায় না। সবকিছুরই পাল্টা প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে ব্যবস্থা নিতে হয়।

ভারতের রাজস্থানের রাজধানী মানসিংহের শহর জয়পুর ছোট শহর না। সেখানে সাড়া শহর জুড়েই অটো চলে। তবে শৃংখলা মেনে। এক এলাকার অটো আরেক এলাকায় যায় না। যার যার নির্ধারিত রুটে চলাচল করে। নির্দিষ্ট লেনের বাইরে যায় না। ওভারটেক করার জন্য পাল্লা দেয় না। তাতে দ্রুতযান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে না। অটোগুলোও সব এক সাইজের এবং বড় আকৃতির। তাতে বেশি প্যাসেঞ্জার নেয়া যায়। ফলে সংখ্যাও নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কলকাতার মুকুন্দপুর এলাকা, যে এলাকায় হাসপাতাল বেশি- সেখানেও অটো বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখেছি। তবে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে। প্রধান সড়কে ওঠার অনুমতি নেই।

মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে রিক্সা চালনা একটি সহজ পেশা। ব্যাটারিচালিত রিকশার আমদানি হওয়ায় তা আরো সহজ হয়ে গেছে। লাফ দিয়ে ঢাকায় এসে রিকাশার হ্যান্ডেল ধরলে কারো মাতব্বরি শুনতে হয় না। নিজের মতো করে চলা যায়। সেজন্যেই শ্রমজীবী মানুষের বড় একটা অংশ এই সহজ পেশা বেছে নেয়।

দেখা গেছে রিক্সার প্রকৃত চালক দুপুরে একটু খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে তার ১২-১৪ বছর বয়সের ছেলে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। একটা ১২-১৪ বছর বয়সের ছেলে রাস্তার নিয়ম কানুন বুঝবে?

ঢাকা শহরের রাস্তায় রিক্সা বন্ধ করতে হলে এক দিনেই পুরা ঢাকা শহর রিকশামুক্ত করা যাবে না। আগেকার নিয়মে একটা একটা করে রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে কাজ করতে হবে। তবে তার আগে রাস্তায় শৃংখলা মেনে চলার জন্য রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণটা জরুরী। রিক্সা বন্ধ না করে আপাততঃ কিছু নিয়ম বেঁধে দিতে হবে। নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি নেয়া যেতে পারেঃ


(১)  এডহক ভিত্তিতে কিছু লোক নিয়োগ করে এলাকাভিত্তিক অনুসন্ধানী টিম গঠন করতে হবে। উক্ত টিম ঢাকা শহরের প্রতিটা রিকশা গ্যারেজ খুঁজে বের করে মালিকের বিভিন্ন নিয়ম কানুনের মধ্যে আনতে হবে।

(২)  প্রতিটা রিক্সা সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত করাতে এবং নম্বর প্লেট ইস্যু করতে হবে- যেটা পাকিস্তান আমলেই ছিলো।

(৩)  রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য্য করতে হবে। ফি-এর হার রিকশার ক্যাটাগরি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।

(৪)  কোন এলাকার রিকশা কোন কোন সড়কে চলতে পারবে তা রেজিস্ট্রেশন পেপারে উল্লেখ থাকতে হবে।

(৫)  চালকদের অনুমতিপত্র বা লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। লাইসেন্স প্রদানের সময় রাস্তায় চলাচলের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে অনুমতিপত্র বুকলেট আকারে তৈরি করে তাতে নিয়মকানুন মুদ্রণ করা যেতে পারে। তবে মৌখিকভাবেও বুঝিয়ে দিতে হবে।

(৬)  সিটি কর্পোরেশনের লাইসেন্স ছাড়া কোনো চালককে রিক্সা দিলে সেই রিকশার মালিক ও চালকে উভয়ের নিকট থেকে জরিমানা আদায় করতে হবে।

(৭)  রাস্তায় যেহেতু রিকশা চলার আলাদা লেন নেই সেহেতু রাস্তার বাম পাশ দিয়ে দুইটা রিকশা ক্রস হয়, এই পরিমানের বেশি জায়গায় রিকশা চলতে পারবে না। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে চালককে জরিমানা গুনতে হবে।

(৮)  রোদে প্যাডেল মেরে রিকশা চালানো যে কি কষ্ট তা আমরা সবাই জানি। ৭০-৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ, শারীরিক প্রতিবন্দীরাও রিকশা চালায়। তাছাড়া আধুনিক যুগে রিকশায় ব্যাটারি, মটর সংযোগ করে মানুষ একটু আরাম করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে রিকশার গতি নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত গতির বেশি গতিতে চালালে জরিমানা আদায় করতে হবে।

(৯)  গতি মৌখিকভাবে বা লিখিত আকারে বেঁধে দিলে হবে না। এক্ষেত্রে রিকশায় যে মটর লাগানো হয় তার হর্স পাওয়ার এবং আরপিএম নির্ধারণ করে দিতে হবে। সেটা নিশ্চিত করার জন্য রেজিষ্ট্রেশনের সময় এবং পরবর্তীতে সময়ে সময়ে চেক করতে হবে।

(১০) সিটি কর্পোরেশনের এডহকভিত্তিতে নিয়োগকৃত লোক পুলিশের সাথে সমন্বয় করে সড়কে রিকশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করবে, যাতে কেউ অনিয়মিতভাবে চলতে না পারে।

(১১)  প্রধান প্রধান সড়কে রিকশা চলা বন্ধ করতে হবে। 

উপরোক্ত সুপারিশ কেবলমাত্র একটা ধারণা। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন অনুযায়ী ধারা পরিবর্তন, সংযোজন, পরিমার্জন করে নেবে।

সকলকে ধন্যবাদ।






Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url