হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে (পর্ব-৪)

 

চাকরিবিধি বা কার্যতালিকায় যাইই লেখা থাকুক, আমরা আমাদের সহকর্মীদের যা করতে দেখি তাই করি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তা্ব্যক্তিদের যা যা পছন্দ তাই করি। সব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সভায় বক্তারা দেশ, জাতি, পরিবেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা বললেও বাস্তবে সব প্রতিষ্ঠান তা মেনে চলেনা। কারণ কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা জানে এগুলো চন্দ্রবিন্দুর মতো লেখা থাকে কিন্তু উচ্চারণ করতে হয় না।

 

নবীজি(সাঃ) কোরআন কায়েম করেছেন অর্থাৎ কোরআনের বিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। কোরআনের পাঠচক্র আয়োজন করা হতো কোরআন মেনে চলার জন্য।

 

সেনা সদস্যদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয় শুধু তা মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য নয়, অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য। মসজিদে নববীতে সাধিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নবীজি)সাঃ) তার সহযোদ্ধাদের কোরআন শোনাতেন ‘প্রতি হরফে দশ নেকী’ হিসাব করার জন্য নয়।

 

নামাজে কোরআন থেকে পাঠ করা হয় কোরআনের নির্দেশ মেনে চলার জন্য। মসজিদে নববীতে দৈনিক ৫বার কোরআনের পাঠচক্রে মহিলারাও অংশ নিতো। কোরআন মহিলাদের দেনমোহরের অংক নির্ধারণের একচ্ছত্র অধিকার দিয়েছে।

 

খলিফা ওমর(রাঃ)-এর সময় মহিলারা উচ্চহারে দেনমোহর দাবি করলে খলিফা মহিলাদের উচ্চহারে দেনমোডহর দাবি করতে নিষেধ করেন। সাথে সাথে এক মহিলা দাঁড়িয়ে বললো, কোরআন আমাকে অধিকার দিয়েছে, আপনি নিষেধ করার কে? হযরত ওমর(রাঃ) বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, আমিই ভুল বলেছি। আমার আদেশ খারিজ। কিন্তু আমরা খলিফা ওমর(রাঃ)’র নামেও ধর্মের বিধান প্রণয়ন করি।

 

ইব্রাহিম(আঃ) মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু আবু জেহেলরা ইব্রাহীম(আঃ)-এর মূর্তি বানিয়েছে।

 

রাসুল(সাঃ) তার নিয়মিত পাঠচক্রে কোরআন পড়ে শোনাতেন, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত করো। তার সাথে অন্য কারো এবাদত করো না। আর মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণ কোরো। নিকট আত্মীয় ইয়াতীম ও ফকিরদের প্রতি সদাচরণ কোরো। আরো সদাচরণ কোরো আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রতিবেশীর সাথে। আরো সদাচরণ কোরো তোমাদের সাথীদের সাথে, অপরিচিত মুসাফিরের সাথে- যার সমূহ চলার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আরো সদাচরণ কোরো তোমাদের মালিকানাধীন গোলাম-বাঁদীর সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহতালা উগ্র, আত্মম্ভরী ও তার বান্দাদের প্রতি অহংকারী কাউকে ভালবাসেন না, যে মানুষের নিকট অহংকার বসত নিজের প্রশংসা করে।

 

আমরা যে নামাজ পড়ি তার আগামাথা কিছুই আমরা বুঝিনা। নামাজ পড়া না পড়াকেই আমরা সবচেয়ে বেশি পাপপূণ্য মনে করি। হাদিস ফিকাহ ঘেঁটে নামাজের হাজার হাজার মাসআলা ম্যানুফ্যাকচার করি, যেসবের সাথে নামাজের মূল উদ্দেশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। সারাজীবন নামাজ পড়া বেশিরভাগ মানুষকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না, নামাজে তারা কি পড়ে। বিদেশি ভাষার সুমধুর সংগীতের মতো কোনো অর্থহীন মন্ত্র মানুষের ভাবনায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। রাসুল(সাঃ)এর কোরআনের পাঠচক্রে কেউ বিদেশি ভাষার মন্ত্র পড়তো না বা শুনতো না। মাতৃভাষায় শুনতো কোরআনের পথ পাথেয়।

 

‘হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে’ এসব প্রশ্ন যারা করেন তাদের অধিকাংশই নামাজ অধ্যায়ের হাদিস আদ্যোপান্ত পড়েননি। এই উধিকাংশ মানুষ বলতে বুঝাচ্ছি, অধিকাংশ শায়খুল হাদিস, যেটা হাদিসের ছাত্রদের সাথে আলাপ করে বুঝেছি।। নামাজের যেসব হাদিস আমাদের শায়খরা জানেন তার জন্য মাদ্রাসায় পড়তে হয় না। যেসব বিতর্কিত মাসআলা নিয়ে শায়খদের মাঝে ‘বিশ্বযুদ্ধ’ চলে সেসব মাসআলার পক্ষে-বিপক্ষে দলিল খুঁজতে এন্টার্কটিকা মহাদেশ পর্যন্ত যাবে, কিন্তু প্রয়োজনীয় জরুরী হাদিসগুলো নিয়ে আলাপ করবে না। হয়তো তা শেখেও না ঝগড়ায় না লাগলে।

 

নামাজের ছোট ছোট মাসআলা শুধু নয়, দিনে কয় ওয়াক্ত নামাজ কোন কোন সময়, কোন ওয়াক্তে কতো রাকাত করে পড়তে হবে, প্রতি রাকাতে কয় রুকু, কয় সেজদা এসব গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসার জবাব হাদিস ছাড়া দেয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ইসলাম ধর্মের প্রধান এবাদত যা সকল মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায় ফরজ তার কোন ধারাবাহিক নিয়ম একটি হাদিসে নাই। কয়েক ডজন হাদিস গ্রন্থ আর কয়েক লক্ষ জাল হাদিসের মহাসমুদ্র সেঁচে নামাজের সর্বসম্মত কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি সর্বকালের সেরা ইসলামী স্কলাররা।

 

১৪০০ বছরের আসমান জমিন গবেষণার পরও সহি পদ্ধতির নামাজের জন্য আলাদা মসজিদ বানাতে হয়, কারণ অপ্রধান ঐচ্ছিক বিষয়কে আমরা প্রধান ও আবশ্যক বানিয়েছি। নামাজের আসল হিকমা অর্থাৎ কোরআনের পাঠচক্র তলিয়ে গেছে আমাদের আহাম্মকীর অতলে।

 

কিতাব ও সালাত পড়ে কেউ যদি মনে মনে ভাবে যে, হাশরের ময়দানে হযরত আবু বকর(রাঃ)কে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করবো যে, আচ্ছা, নবীজি(সাঃ) মাগরিবের নামাজ কয় রাকাত পড়তেন, ফজরের নামাজ কোন সময় পড়তেন, নাভির নিচে না বুকের উপর হাত বাঁধতেন- এসব জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনি আমাদের জন্য বর্ণনা করেননি কেন? এসব তথ্য ছাড়া আমরা কিভাবে বেহেশতের চাবি বানাবো। শুনে উনি যদি উত্তর দেন যে, ‘আরে আহাম্মক, নবীর যে সুন্নাহ আমি বর্ণনা বা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন মনে করিনি, তা যে আকামের দোকানদারী তা বুঝতে তোমার সারা জীবন লাগলো’?

 

নামাজের কোন নির্দিষ্ট কাঠামো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনীয় হলে তা নিঃসন্দেহে পাথরে খোদাই করে রাখতেন নবীজি(সাঃ)-এর সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান সাহাবী। হযরত আবুবকর(রাঃ), ওমর(রাঃ), ওসমান(রাঃ) ও আলী(রাঃ) নবীজি(সাঃ)কে অসংখ্যবার নামাজ পড়তে দেখেছেন। কিন্তু তারা নবীজি(সাঃ)-এর নামাজের যে কয়টি হাদিস বর্ণনা করেছেন তা থেকে আপনি নামাজের নিয়ম সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও পাবেন না। অথচ আমাদের পরিচিত প্রচলিত নামাজের প্রতিটা ধাপ বর্ণনার জন্য একটি হাদিসই যথেষ্ট ছিলো। (চলবে……)

(ইন্টারনেট অবলম্বনে)


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url