সুচিত্রা কন্যা মুনমুন সেনের স্বামী ছিলেন ত্রিপুরার রাজকুমার
ভরত মুনমুন |
বাংলা
সিনেমার মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের তিন প্রজন্মের নারীদের আগলে রেখেছিলেন সুচিত্রা
তনয়া মুনমুন সেনের স্বামী ত্রিপুরার রাজকুমার ভরত দেব বর্মণ।
ভরত নামটার চেয়ে ‘হাবি’ নামেই টালিগঞ্জ পাড়ার মানুষদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। মুনমুনের ঘনিষ্ঠরাও ভরতকে হাবি বলেই ডাকতেন। তাঁর নামটাই হাবি হয়ে গেছিল। ভরত দেববর্মণ- তিনিই একমাত্র পুরুষ যিনি তিন সেন প্রজন্মকে রক্ষা করেছিলেন বরাবর। তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শুধু সুচিত্রা সেনের জামাই হিসেবেই ভরত দেব বর্মণের পরিচয় ছিলো না। তিনি ছিলেন ত্রিপুরা রাজকুমার। বাবা মহারাজা রমেন্দ্রকিশোর দেববর্মণ। মা ইলা দেবী। ভরতের মাসি জয়পুর রাজমাতা গায়েত্রী দেবী। বোন দেবিকা দেবী। এহেন রাজকীয় পরিচয় সরিয়ে রেখে সেন নারীদের ভরত চিরকাল আগলে গেছেন। স্বামী, বাবা, জামাই হিসেবে তিনি একশোতে একশো পেয়ে গত ১৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ৮৩ বছর বয়সে অমৃতলোকে পাড়ি জমালেন তিনি।
সুচিত্রা
সেনের জামাই হিসেবে প্রথম পছন্দ ভরত ছিলেন না। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কোনো এক অধ্যাপকের
সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করেন সুচিত্রা সেন। বিয়ের কথা এগোতে থাকে। কিন্তু ততোদিনে
মেয়ে মুনমুন সেন মন দিয়ে বসে আছেন ভরতকে। মেয়ের ভালো ভেবেই শেষ অবধি ভরতকে
জামাই করার মত দেন সুচিত্রা সেন।
ভরত-মুনমুনের বিয়ের ছবি |
মুনমুন-ভরতের বিয়ে ছিলো কলকাতার শিরোনামে থাকা বিবাহ বাসর। অথচ মেয়ের বিয়ের পর জামাই-ই হয়ে উঠল সুচিত্রার কাঙ্খিত ছেলে। সুচিত্রা সেনের পর্দানসীন থাকা সম্ভব হতো না ভরতের সাহচর্য ছাড়া।
সিনেমা থেকে মায়ের প্রস্থানের সময়ে মেয়ের সিনেমায় প্রবেশ। মুনমুনের জীবনেও ভরত এসেছিলেন সম্পদ হয়েই। বিয়ের পর যেখানে অভিনেত্রীদর সিনেমা ছেড়ে দিতে হয়, সেখানে বিয়ের পরই মুনমুন শুরু করেন তাঁর অভিনয় জীবন। রবি সোম, রাজবধূ প্রথম দুটি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ।
সুচিত্রা চাননি মেয়ে সেই সিনেমায় আসুক। সুচিত্রাও বিয়ের পরে সিনেমায় এলেও স্বামীর সাহচর্য মহানায়িকার কপালে জোটেনি। এক কাপড়ে মেয়েকে নিয়ে স্বামীর ঘর ছাড়তে হয়েছিলো সুচিত্রাকে। এরপর ইন্ডাস্ট্রির কাদাধূলো ঝেড়ে তাঁকে মহানায়িকা হতে হয়। তাই মুনমুনের সিনেমায় আসা নিয়ে তীব্র সংঘাত হয় মা ও মেয়ের। তখনও স্ত্রীর পাশে থেকেছিলেন ভরত। এমন সহায়ক হাজব্যান্ড ক’জন মেয়ের ভাগ্যে জোটে!
মুনমুন
যখন অরুন্ধতী দেবীর 'দীপার প্রেম' করলেন তখন সুচিত্রা শান্ত হয়ে বললেন "ঠিক
পথে এগোচ্ছ।" টলি বলির ব্যস্ততম নায়িকা মুনমুনের সংসার সামলানো সম্ভব ছিলো না।
দুই মেয়ে রাইমা ও রিয়াকে শিশু বয়স থেকে মানুষ করেছেন ভরত। স্ত্রী বাড়ি ফিরলে
তাঁর জন্য খাবার পর্যন্ত সাজিয়ে দিতেন। বৃদ্ধা শাশুড়ির একাকীত্বে বন্ধু হয়ে
উঠেছিলেন ভরত। তিনটে প্রজন্মের চার নারীর যেন নয়নের মণি ছিলেন ভরত।
দুই মেয়ে ও স্বামীর সাথে মুনমুন সেন |
মুনমুন সেন বিশ্ববাসীর চোখে চিরকালীন সেক্স ফ্যান্টাসি হয়ে থাকতে পেরেছিলেন মুক্তমনা স্বামী ভরতের সাহচর্য ও উদারনৈতিকতার কারণে। পাকিস্তানি সুঠাম ক্রিকেটার থেকে হিরো বা শিল্পপতিদের সঙ্গে মুনমুনকে নিয়ে ইয়োলো জানার্লিজম হলেও টলিউডের দীর্ঘ দাম্পত্যের উদাহরণ হয়ে রয়ে গেলেন মুনমুন-ভরত। মুনমুনের মতো খোলামেলা সাহসী পোশাক খুব কম বিবাহিতা মেয়েই পরতে পেরেছেন। মার্গো, লাক্স, ডিল্যুজ লেডির স্নানঘরে তোয়ালে বারবার খসে পড়লেও, হাজার কান ভাঙানিতেও ঘর ভাঙেনি মুনমুনের।
মুনমুন যেন পশ্চিমী স্টাইলে প্রাচ্যের মিশেল। যে মুনমুন পার্টি করতেন রাতভোর তিনিই আবার দুর্গাপুজোর সিঁদুর খেলে এসে সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে, দু পায়ে লক্ষ্মীশ্রী আলতা পরে শুয়ে পড়তেন স্বামীর কোলে মাথা রেখে। সেই আশ্রয়ের কোলহারা হলেন মুনমুন সেন। মায়ের চলে যাওয়া, স্বামীর চলে যাওয়া অনেক বড় একাকীত্ব মুনমুনের জীবনে। ভরতের মৃত্যুদিনে তার আহাজারী প্রমাণ করে, কতোটা নিবিড় ভালোবাসা ছিলো ভরত-মুনমুনের।
ভরতের মৃত্যুদিন ১৯শে নভেম্বর মিলে গেল আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের সঙ্গে। ভরত তো পুত্র, পতি, পিতা তিন রূপেই শ্রেষ্ঠ। নীরবে যে পুরুষ তাঁর নারীদের সামনে এগিয়ে দিয়েছেন মাথা উঁচু করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। নিজে সবসময় থেকেছেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। সমাজের চোখে কটুক্তি শুনতে হলেও এমন সহমর্মী 'বন্ধু' স্বামী কজন নারীর ভাগ্যে জোটে।
আনন্দবাজার
পত্রিকার সৌজন্যে
লেখকঃ
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
(আংশিক
পরিবর্তিত)