গণহত্যা ১৯৭১ - রাজবাড়ীর গনহত্যা (প্রথম পর্ব) - নাসির আহমেদ
শহীদ এডভোকেট কালী শঙ্কর মৈত্র |
"এপ্রিলের একদম শেষের দিকে হঠাৎ এডভোকেট কালী শঙ্কর মৈত্রর হত্যার কথা শুনে হতভম্ব। রাজবাড়ীর বাড়িতে তখন আব্বা-মা, মনিদা, বোন রোজী, ও আমি সহ পাঁচ জন অবস্থান করছি। মেজ ভাই পাকিস্তান এয়ারফোর্সে বাকি চার ভাই গ্রামের বাড়ি অবস্থান করছেন। সবাই ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য অপেক্ষায়। রাজবাড়ীতে এমনিতেই আমরা আতঙ্কে থাকতাম তার উপর কালী শঙ্কর মৈত্রের হত্যার ঘটনা আমরা আরও ভীতু হয়ে পরলাম।
কালী শঙ্কর মৈত্র'কে আমি কাকা বলেই সম্বোধন করতাম। আমাদের ঠিক দক্ষিণের পাশের বাড়িটা। কতো কীর্তন শুনেছি এই বাড়িতে। অষ্টমীর দল গান করতে আসলেই আমি ও রোজী (বোন) দৌড়ে চলে যেতাম। অষ্টমী দল রুমাল নিয়ে দল বেধে কি সুন্দর নাচগান করতো। কালী শঙ্কর কাকা উঠানের উত্তর পাশে একটা বড় হাতলওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে অষ্টমী দলের গান শুনতেন। হাতে একটা ছড়ি থাকতো। সকালে কোর্ট প্যান্ট টাই পড়ে রিক্সায় চড়ে আদালতে যেতেন। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তাকে। হঠাৎ তার হত্যার খবরটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
এপ্রিলের ২১ তারিখে পাকসেনারা রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করার আগমুহূর্তে কালী শঙ্কর মৈত্র বেড়িয়ে পরলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। বলা যায় অনেকটা একাই। স্ত্রী মারা গেছেন অনেক বছর হলো। সন্তানেররা দেশের বাইরে থাকে। সাথে ছিল একমাত্র পালিত সন্তান নিতাইদা। কালী শঙ্কর মৈত্র রাজবাড়ী শহর থেকে কয়েক মাইল পূর্বে বালিয়াকান্দি থানার ইলিশকোল গ্রামে জটু সান্যালের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই সারা দেশের খবরা-খবর রাখতেন। প্রায় ৪০ বছর রাজবাড়ীতে একচ্ছত্র আইন ব্যবসা করেছেন। ফলে তার এলাকার মানুষের সাথে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। কেউ তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না এই বিশ্বাস ছিল সবসময়। কালী শঙ্কর মৈত্রের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।
এপ্রিলের একদম শেষের দিকে এলাকার কয়েকজন স্বাধীনতা বিরোধীর মাধ্যমে খবর পায় বিহারিরা। রাজবাড়ী থেকে কয়েকজন বিহারিরা অস্ত্র নিয়ে গ্রামে ঢুকে ধরে নিয়ে যায় বৃদ্ধ কালী শঙ্কর মৈত্রকে। রাজবাড়ী শহরে তাঁকে কোট প্যান্ট পড়া অবস্থায় প্রদক্ষিন করানো হয়। এসময় তিনি কারো সাথে কথা বলার সুযোগ পাননি। কেবল তিনি কয়েকবার হাত নাড়াবার চেষ্টা করেন। এরপর বিহারিরা ট্রাকে করে কালী শঙ্কর মৈত্রকে ফরিদপুর মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে দুই ঘন্টা তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এরপর আবার তাকে বিহারিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
বিহারিরা তাঁকে ট্রাকে করে ফরিদপুর শহরের কাছে হবিগঞ্জ গ্রামে নিয়ে যায়। কালী শঙ্কর মৈত্র ইশারায় জানান তিনি তৃষ্ণার্ত। তখন একজন তাঁর হাতে সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে দেয়। হাতটা মুখে তোলার আগেই পিছন থেকে পরপর কয়েকটি গুলি করে। লুটিয়ে পড়েন কালী শঙ্কর মৈত্র। প্রকাশ্যে তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকে। বিহারিরা ট্রাক নিয়ে চলে যায় রাজবাড়ীতে। ঘটনাস্থলে কিছু মানুষ তাঁকে চিনতে পেরে কবর দেয়।
কালী শঙ্কর মৈত্র ১৯০৮ সালে বালিয়াকান্দি থানায় রুকুনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ভোলানাথ মৈত্র। কালী শঙ্কর মৈত্র বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। অল্প বয়সে তিনি বাবাকে হারান । কালী শঙ্কর মৈত্র রাজবাড়ী 'গোয়ালন্দ হাইস্কুলে' লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর ১৯২৪ সালে হিন্দু গভর্মেন্টের স্কুল, কলকাতা থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি ও বিএসসি পাশ করেন। সাইন্সের ছাত্র হয়েও ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ল' পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
গায়ের রং খুব কালো ছিল। এজন্য বিধবা মায়ের কাছে তার নাম ছিল কালাপেঁচা। বলিষ্ঠ ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। কন্ঠস্বরে ছিলো প্রচন্ড জোর ও গাম্ভীর্য। কোর্টের বাইরে কোঁচানো ধুতি আর সাদা শার্ট ছিল তার পোশাক। হাতে থাকতো ছড়ি। ফুল খুব পছন্দ করতেন, বিশেষ করে গাঁদা। সারা বছর জুড়ে থাকতো রংবেরঙের ফুল। স্ত্রীর নাম ছিল গাঁদা এ-কারণেই হয়তো গাঁদা ফুলের উপর ছিল তার বিশেষ দূর্বলতা।"
(এরপর পর্ব -২)
লেখা: বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির আহমেদ, রাজবাড়ী
নাসির আহমেদ |
লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত