দেশ চালাবে কারা?

 



সূচনা

১৯৪৭ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারতবর্ষ। জন্ম নেয় পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নামে দুটি দেশ। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের মূল ভূখন্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাকিস্তানের মূল ভূখন্ড থেকে উড়ালপথে বাংলাদেশের দূরত্ব ২২০০ কিলোমিটার এবং সড়ক পথে হিন্দুস্থানের ভেতর দিয়ে দূরত্ব ৩৫০০ কিলোমিটার। অবস্থান ও ভাষাগত কারণে এবং বিমাতাসূলভ বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

 

অবতরণিকা

স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতার স্থপতিকেই সপরিবারে শেষ করা হলো স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে। সেই অভ্যুত্থানের সুবিধাভোগী পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ, বৈধ বা অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা জেনারেল জিয়ার সরকারকে ৬ বছরের মাথায় বিদায় জানানো হলো তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। কলে-কৌশলে ক্ষমতায় এলো জেনারেল এরশাদ। এরশাদ সরকারকেও এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় জানানো হলো। তাকে সহ তার সরকারের অনেককে দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া হলো।

 

সূচনা হলো এক নতুন অধ্যায়ের। দেশে দৃশ্যমান তিনটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি। আওয়ামীলীগ দেশের সবচেয়ে পুরনো দল। এই দলের নেত্রীত্বেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হয়েছিলো দেশ।

 

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বা বলা যায় ক্ষমতা দখল করে মসনদে বসে নানা ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে অন্য দল থেকে নেতা ভাগিয়ে নিয়ে দল গঠন করে। এইভাবে গঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টি পালাক্রমে দেশ চালানোয় সে দুটি দলেও কিছু যোগ্য লোক ছিলো এবং এখনও আছে।

 

 

উল্লেখ্য, দুই সেনা শাসকই ক্ষমতা দখল করে পাতানো হ্যাঁ/না ভোটের ব্যবস্থা করে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে তারপর দল গঠন করে। তাদের অধীনে সব নির্বাচনই ছিলো প্রহসনমূলক। তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু ছিলো। সংসদের তেমন ভূমিকা ছিলো না। রাষ্ট্রপতি ছিলো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার মুখের কথাই ছিলো আইন। সে আইন পাশ করানোর জন্য কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন করে সুবিধানুযায়ী আসন সংখ্যা নিজ দলের দখলে নিতো তারা।

 

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অংশগ্রহণ করায় ঘটনাক্রমে দুই তৃতীয়াংশ আসন দখল করতে ব্যর্থ হয় এরশাদ। ফলে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল তথা নানা জনবিরোধী আইন করায় তা সংসদে পাশ করানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। বিএনপি জামাত নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। আওয়ামীলীগও সংসদে ও বাইরে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তখনকার প্রধান দাবি ছিলো নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। অতঃপর কৌশলের আশ্রয় নেয় এরশাদ। ত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কেউ নির্বাচনে যাবে না, একথা জেনেও এরশাদের গ্রীহিত বিভিন্ন পদক্ষেপের বৈধতা দিতে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন দরকার। তাই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ১৯৮৮ সালের একক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ২৫১টি আসন দখল করে এরশাদ।

 

উল্লেখ্য, সে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাতে ইসলামী সহ তাদের শরীক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। অতঃপর দেশব্যাপী শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। তার ঠিক দুইবছরের মাথায় বিদায় নিতে হয় এরশাদকে। তিনিও স্বৈরশাসক আখ্যা পান।

 

নব্বইয়ের গণভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারী তিন জোট যথা; আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে পাঁচ দল এই মোট ২০ টি দলের যুগপৎ  আন্দোলনের ফলে তৎকালিন ক্ষমতাসীন এরশাদের জাতীয় পার্টি বিদায় নেয়।

 

অতঃপর তিনজোটের রূপরেখা অনুয়ায্যী তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। ১৯৯১ এর নির্বাচনে বিএনপি দলীয় জোট জয়লাভ করে – যদিও তাদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ক্যু এবং সূক্ষ কারচুপির অভিযোগ তোলে আওয়ামীলীগ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনা। শতকরা হিসেবে বেশি ভোট পেলেও মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে আসন সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হয় বলে আওয়ামীলীগের নেতারা অভিযোগ করেন।

 

বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলেও দেশ পঁচাত্তরের পট পরিবর্তণের পর যেরূপ উল্টোদিকে যাত্রা শুরু করেছিলো তার আর অবসান ঘটেনি। এরশাদের আমলে উল্টোধারা ততোটা বেগবান না থাকলেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লোভে তার পুরোপুরি অবসান হয়নি। তাদের শাসনকালিন সময়ে নেতা সঙ্কটের কারণে তারা জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগের মতো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল থেকে নেতা ভাগিয়ে নিয়ে দল গঠন করেন তারা।

 

 

ক্ষমতার কাড়াকাড়ি

১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ক্ষমতায় থেকে সেনা পাহারায় একক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বাগিয়ে নিয়ে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে। বিতর্কিত সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ২৮৯টি আসন দখল করে। ওই সংসদে আনুষ্ঠানিক কোনো বিরোধীদল ছিলো না। মাত্র একটি আসন পেয়ে বিরোধী নেতার চেয়ারে বসেছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত হত্যাকারীদের ফ্রিডম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ ফারুক রহমান। বাকি ১০টি আসন পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে এবং সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের তীব্রতায় মাত্র ১২ দিনের মাথায় সংসদ ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয় বিএনপি। তবে বিরোধীদের দাবির মুখে সেই সংসদেই তত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করা হয়।

 

তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ এর জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দলীয় জোট জয়লাভ করে। ২০০১ এর নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি। এই নির্বাচনেও বিএনপিকে কারচুপির মাধ্যমে জেতানো হয়েছে বলে তত্বাবধায়ক সরকারকে অভিযুক্ত করে আওয়ামীলীগ। কথিত আছে, নির্বাচনে বিএনপিকে জয়লাভ করানোর জন্য ব্যপক তৎপরতা চালায় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা “আইএসআই”। প্রচুর অর্থও ঢালে তারা।

 

“এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বিরোধিতার মুখে তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ড। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এই দেশটির পিছনে লেগে থাকে যুক্তয়াষ্ট্র। তারই ফলশ্রুতিতে পূনঃপুনঃ সঙ্কটের মুখে পরে দেশ। আর এ কাজে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে পরাজিত পাকিস্তানী শক্তি ও এদেশীয় কিছু দেশ বিরোধী এজেন্ট এবং স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল।“

 

যাইহোক, ১৯৯৬ সালের আইন অনুযায়ী পরপর তিনটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার কথা ছিলো। সেই অনুযায়ী ২০০১, ২০০৬ সালেও তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা।

 

তত্বাবধায়ক সরকার আইন অনুযায়ী তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা ছিলো সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির। তাতেও অনৈতিকতার আশ্রয় নেয় ক্ষমতাসীনরা। নিজেদের পছন্দের বিচারপতি যাতে সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে যেতে পারে এবং তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারে সেই সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়ে সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ফলে তাতেও সেই সময়ের বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করে। এ ছাড়াও ২০০৭ এর তত্বাবধায়ক সরকারের আওময়কালে বিএনপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ায় একে একে পদত্যাগ করেন তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা। রাষ্ট্রপতি নিজেই হয়ে যান তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। পরস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে।

 

ব্যপক আন্দোলনের মধ্যেও ২০০৭ এ এককভাবে নির্বাচন করে বিএনপি। আওয়ামীলীগ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় গঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকার চেষ্টা করে বড় দুই দলের নেতৃত্বে পরিবর্তণ আনতে। দুই দলের নেত্রীকেই বিভিন্ন মামলায় কারাবন্দী করা হয়। আওওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত সফরে বিদেশ গেলে তাকে দেশে আসতে বাধা সৃষ্টি করা হয়।

 

খালেদা জিয়ার জৈষ্ঠপুত্র ও বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি তারেক রহমান মায়ের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সীমাহীন আর্থিক দূর্নীতি ও সন্ত্রাসের রাজনীতির কারণে ভবিষ্যতে আর রাজনীতি না করার অংগীকারনামা নিয়ে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

 

২০০৭ এর সেনা সমর্থিত তত্বাবধ্যায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। অতঃপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দলীয় জোট ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ২৬৩ টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামীলীগ এককভাবে ২৫১টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

 

উপসংহার

আলোচিত প্রত্যেক দলকেই দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে উৎখাত করা হয়। তারমধ্যে জনরোষে পড়ে শেষ সময় অর্থাৎ বর্তমান সময়ে এসে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। দলটির প্রধান এবং সরকার প্রধানকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। দেশে ঈর্শাজনক উন্নতি সত্ত্বেও নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে গা-ঢাকা দিতে হয় দলীয় নেতাদের।

 

উপরে বর্ণিত প্রত্যেকটি দলই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দেশের প্রধানতম দল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এতোকাল।

 

এই পর্যায়ে এসে মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ তার এক নাটকের মাধ্যমে পাখির ভাষা বোঝে এমন এক ব্যক্তির মুখ দিয়ে পাখির ভাষা উচ্চারণ করিয়েছিলেন “মানুষ খারাপ”। আসলে আমরা মানুষই খারাপ!

 

 

 

কথায় আছে, ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন’। তাহলে দেশের নেতৃত্ব দেবে কারা? দেশ চালাবে কারা?

 

পরিশিষ্ট

জনমত পর্যালোচনা

এ যাবৎ কালের পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রত্যক্ষ ভোটে অংশগ্রহণ না করলেও এখনো পর্যন্ত দেশের জনমতের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লোক বড় ৩টি দলের সমর্থক। ১০ শতাংশ জনমত জামাতের পক্ষে। বাদবাকি অন্যান্য দলের পক্ষে। অথচ গন অভ্যুত্থান বলি আর যেভাবেই বলি বর্তমানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে তাদের কথোপকথনে বেরিয়ে আসে তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কোনো দলকেই আর ক্ষমতায় আসতে দিতে চায় না। আওয়ামীলীগ ও তার জোটভুক্ত দলগূলোকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা। এটা কি আদৌ সম্ভব! মোটেও না। যদিও দেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারেরই কোনো ধারণাই নাই। সরকার প্রধান দেশত্যাগ করায় এবং মন্ত্রী পরিষদ ও সংসদ সদস্যগনের অনুপস্থিতির কারণে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন রাষ্ট্রপতি।

 

অতএব, এই সরকারের উচিৎ গ্রহণযোগ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সুষ্ঠ নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া। নির্বাচনই জনগণের ম্যান্ডেট আদায় করার একমাত্র পন্থা, অন্য কোনো উপায়ে না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url