গুনীজনের বাণী
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ |
যে ছাত্রছাত্রীরা জেনে যায় তারা শিক্ষককে কলার ধরে পদত্যাগ করাতে পারে তারা ভবিষ্যতে আর যাই করতে পারুক পড়ালেখা করতে পারবে না। ওটা তাদের হবে না।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আমরা সবাই
চিনি। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির উদ্যোক্তা।
১৯৯০ এর দিকে বাংলামটরে অবস্থিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের
তরফে পাঠচক্রের আয়োজন হতো। বই পড়া প্রতিযোগিতা হতো।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৬২ সালে
মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রথমে মাস তিনেক বেসরকারি মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ এবং পরে রাজশাহী
সরকারি কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ৩০ বছর পর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
তাঁর শিক্ষকতা জীবনের নানা স্মৃতি নিয়ে ১৯৯৯ সালে একটি বই বের করেন তিনি- নাম “নিস্ফলা
মাঠের কৃষক”। এই বইয়ে এক হোমরাচোমরা কর্তৃক তাঁকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টার একটি বর্ণনা
আছে। ঘটনাটি এরকমঃ
“অধ্যপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেব তখন একটি টেকনিক্যাল কলেজের
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হবার পর এক ব্যক্তি কলেজে এলেন তার ছেলেকে
ভর্তির তদবির নিয়ে। সমস্যা হলো তার ছেলে কলেজ কর্তৃক ভর্তির জন্য নির্ধারিত নম্বরের
চেয়ে বোর্ড পরীক্ষায় ২ নম্বর কম পেয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই আবু সায়ীদ সাহেব রাজী হলেন
না। কারন তাকে নিতে গেলে ওরকম আরো ৪০/৫০ জনকে নিতে হবে। অনেক অনুরোধ উপরোধ করে যখন
কাজ হলো না তখন লোকটি আবু সাঈদ সাহেবকে শাসিয়ে গেলেন,- ‘ভর্তি না করে কিভাবে এ
কলেজে অধ্যক্ষ পদে থাকা যায় তা তিনি দেখে নেবেন’।
এরপর আবু সায়ীদ সাহেবকে একে একে ফোন করলেন শিক্ষা বিভাগের ডিপিআই
শামসুল হক এবং প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী। ওনারা কোনোভাবে ভর্তি
করানো যায় কিনা সে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সবাই আবু সাঈদ সাহেবের ব্যাখ্যা শুনে নিবৃত
হন।
পরে ফোন এলো সরাসরি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মফিজউদ্দীন সাহেবের
কাছ থেকে। এবার কোনো অনুরোধ নয়, সরাসরি বলা হলো ভর্তি করানোর জন্য। জবাবে আবু সায়ীদ
সাহেব বিনীতভাবে বলেছিলেন— ❝আপনি বললে অবশ্যই নেব।
আপনি ওর দরখাস্তের উপরে আমাকে লিখিত নির্দেশ দিন।❞ শুনে মন্ত্রী মহোদয় চুপ
হয়ে গিয়েছিলেন।
ব্যাপারটি ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হলো না। ঐ হোমরাচোমরা
আবার এসেছিলেন কলেজে ওনার পুত্রসহ। এসে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকেই ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ❝জানেন আপনার মতো একশোটা মাষ্টারকে আমি কিনতে পারি...❞ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবও ছেড়ে দেননি লোকটিকে। বলেছিলেন—❝আপনি কি জানেন, আপনার মতো একশোটা অশিক্ষিতকে আমি পড়ালেখা শেখাতে পারি।❞
এরপর লোকটি অনেক চেঁচামেচি বকাবকি করেছিলেন তাঁকে। সেদিন অধ্যাপক
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেব খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন লোকটিকে। ঐ কথাটি বলার
জন্যই এতো লম্বা কাহিনি। লোকটিকে বলেছিলেন,— ❝আপনি আমার মতো কতোজন শিক্ষককে
কিনতে পারেন জানি না। কিন্তু যে ছেলের জন্য আপনি এতসব করতে চাচ্ছেন তাকে স্বাচ্ছন্দে
বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। ওর পড়ালেখা হবে না। যে ছাত্র একবার জানতে পারে তার শিক্ষকেরা
তার বাবার টাকায় কেনা চাকর। সে আর মানুষ হয় না।❞
বিষয়টি এরকমই। যে ছাত্রছাত্রীরা জেনে যায় তারা শিক্ষককে কলার ধরে
পদত্যাগ করাতে পারে তারা, ভবিষ্যতে আর যাই করতে পারুক পড়ালেখা করতে পারবে না। ওটা তাদের
হবে না।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বলা যায়; শিক্ষকরা শুধু নয়, কোনো
সরকারী কর্মকর্তারই দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা উচিৎ না। অধ্যাপক আবুদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেব
তাঁর বইতে ১৯৯৯ সালেই লিখেছেন — ❝সেদিন শিক্ষকসত্তার অহংকারে
গলা উঁচু করে তাঁকে কথাগুলো বলেছিলাম, কিন্তু আজ পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়; আমার নয়,
সারাদেশে সবখানে তার দম্ভই আজ জয়ী হয়ে গেছে। জাতির শিক্ষকেরা আজ ছাত্রদের বাবার পয়সায়
কেনা ব্যক্তিগত ভৃত্যের কাতারে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন।❞
এসব বন্ধ হোক। তবে ছাত্রছাত্রীদের উলঙ্গ বেয়াদবীকে প্রশ্রয় দিয়ে
নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে...!!
(ইন্টারনেট থেকে নেওয়া,
পরিমার্জিত, ও সংযোজিত।)
মূল লেখাঃ দেবপ্রসাদ বিশ্বাস (ব্লগার) কর্তৃক ২৯.০৮.২৪ তারিখে