চিন্তা করা মানা
কয়েকদিন আগে আমার এক বন্ধুর মেয়ের সাথে দেখা হল। ধরা যাক, তার নাম ফারজানা। সদ্য গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা এই ফারজানা বিগত কয়েক বছর ধরে এক ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী তাকে আর তার বাবা-মাকে ইদানীং নাকি আশেপাশের পরিচিত সবাই মিলে চিন্তা করতে মানা করছে।
আমি বললাম, "সে তো ভালো কথা। শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাই তো বলবে।"
কিন্তু ফারজানা বলল, মোটেও তা নয়। তার এই সমস্যার শুরু সে কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে। আত্মীয় পরিজন থেকে শুরু করে বেশ কিছু পাড়া প্রতিবেশী তার মাকে নিয়মিত জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, "ভাবী, ফারজানার জন্যে ছেলেটেলে পাওয়া গেল?" উত্তরে 'না' শুনলেই তারা বলতে শুরু করেন, "চিন্তা করবেন না, ও ঠিক হয়ে যাবে।" কোনটা যে ঠিক হয়ে যাবে, তা কিন্তু কেউ ব্যাখ্যা করেন না।
ফারজানার মা হয়ত রাতে কী রান্না করবেন তা নিয়ে ভাবছেন, এমন সময় পাশের বাড়ির সেলিনা ভাবী বলে উঠলেন, "আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে টেনশন করছেন। একদম চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।"
ফারজানার মা এর পর থেকে সেলিনা ভাবীকে দেখলে খুব সচেতন ভাবেই মুখটা হাসি হাসি করে আলাপ জমাতে যান। অমনি সেলিনা ভাবী জানতে চান, "কি ব্যাপার ভাবী, এত খুশি খুশি লাগছে! ভাল কোন সম্বন্ধ এসেছে নাকি?" যেন এই মুহূর্তে ফারজানার বিয়ে ছাড়া তার বাবা-মায়ের অন্য কোন বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার কোন অধিকারই নেই। ইদানীং আবার ফারজানার বেশ কিছু বান্ধবী, যাদের ইতিমধ্যেই বিয়ে হয়ে গেছে, তারাও সেই একই ভাবে ফারজানাকে চিন্তামুক্ত রাখার দায়িত্ব সুয়োমোটো নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
ঠিক এই একই সমস্যার কথা শুনেছিলাম চাকুরীজীবি একটি মেয়ের কাছে। ধরা যাক, তার নাম সানজিদা৷ দীর্ঘ চাকরিজীবনে সরকারি চাকরি করা মহিলাদের মধ্যে হাতে গোনা দুচারজন 'সানজিদা'র সাথে আলাপ হয়েছে। সানজিদার বিয়ে হয় একত্রিশ বছর বয়সে৷ ফারজানাকে যে সমস্যাটা এসএসসি পাশ করার পর থেকেই সামলাতে হচ্ছে, সেই একই সমস্যা মফস্বল থেকে আসা সানজিদাকে সামলাতে হয়েছিল গ্র্যাজুয়েশনের পর থেকে। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্ব চলাকালীন যার শুরু হয়েছিল এবং তা চলেছিল চাকরি পাওয়ার পরেও প্রায় বছর তিনেক... বিয়ে না করা পর্যন্ত। কিন্তু সানজিদা জানালো, তা নাকি আসলে ছিল সাময়িক বিরতি। বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই সেইসব মানুষজন আবার সানজিদাকে চিন্তা করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া শুরু করে। সেইসব শুভানুধ্যায়ীরা দেখা হলেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত, "বিয়ের তো একবছর হয়ে গেল... কোন সুখবর আছে নাকি?" উত্তরে 'না' শুনলেই সেই একই ক্ল্যাসিক্যাল ভঙ্গিতে তাদের অভয়বাণী ধেয়ে আসত, "চিন্তা করিসনা। ও ঠিক হয়ে যাবে।"
ফারজানা, সানজিদারা এখানে একটা ছোট্ট সাবসেট মাত্র। মোদ্দা কথা হল, আমাদের সমাজে অধিকাংশ নারীদের কিছু বিষয়ে পাংচুয়ালিটি মেনে চলা বোধহয় আজও বাধ্যতামূলক। 'সময় হয়েছে বিয়ে করে ফেল', 'সময় হয়েছে বাচ্চা নিয়ে ফেল', 'সময় হয়েছে বাচ্চাকে সঠিকভাবে মানুষ কর', 'সময় হয়েছে বাচ্চার বিয়ে দে', 'সময় হয়েছে বাচ্চাকে বাচ্চা নিতে বল'... এ যেন এক অনন্ত প্রক্রিয়া। আর সব থেকে দুঃখের কথা এই যে, ফারজানা বা সানজিদাদের সাথে আলোচনা করে যেটা বুঝলাম, এই প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সমাজে হাজারো পুরুষতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কেক-এ, এ যেন চেরি অন দ্য টপ।
আর ফারজানা-সানজিদাদের মত যারা এই গতে বাঁধা আরোপিত পাংচুয়ালিটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের ইচ্ছেডানায় ভর করে উড়ে চলার সাহস দেখাতে পারে, তাদের স্যালুট জানাতেই হয়। আশা রাখি, এই ফারজানা বা সানজিদারাই পরবর্তী প্রজন্মকে গতে বাঁধা পাংচুয়ালিটির বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারবে।
লিখেছেন: বিপ্লব কুমার দে