হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে (পর্ব-২)
ছবিঃ প্রতিকী |
পবিত্র কোরআনে প্রথম যে শব্দ নাজিল হয়েছে
তা হচ্ছে ইকরা। এই ইকরা মানে শোনা বা শুনে দৌড় দেয়া না। ইকরা মানে পড়া। শুধু পড়া নয়,
ইকরা শব্দের অর্থ মনোযোগ সহকারে বুঝে বুঝে পড়া। কোনো লেখা পড়ে বুঝতে না পারলে তাকে
পড়া বলা হয় না। কি পড়তে বলা হয়েছে? কোরআন।
ইকরা এবং কোরআন একই শব্দের ভিন্ন দুটি
রূপ। যেমন জাতীয়, জাতীয়তা একই শব্দের ভিন্ন দুটি রূপ। ইকরা শব্দের অর্থ পড়া, আর কোরআন
শব্দের অর্থ যা পড়া হয়। আল্লাহ কুরআন পড়তে বলেছেন, আর নামাজ হচ্ছে সে কোরআনের পাঠচক্র।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ
করবে”-(৭:২০৪)। কোনো একটা শব্দ শোনা, যেমন; পাখির ডাক বা গাড়ির হর্ন,
যার কোনো অর্থ নেই। এটাকে ইংরেজিতে বলে Hearing.। আবার যখন মনোযোগ দিয়ে বোঝার উদ্দেশ্যে
কোনো কথা শোনা হয় তখন তাকে বলা হয় Listning.।
টোফেল বা আইএলটিএস পরীক্ষায় Listning
Test নেয়া হয়। আর কানে না শুনলে তারজন্যে Hearing Aids দেয়া হয়। সুতরাং শ্রবন করো মানে
Listen to it.। একেবারে Listning Test এর মতো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। আর নেশাগ্রস্থ
অবস্থায় যখন সে বুঝতে পারে না যে সে কি বলছে, তখন তাকে নামাজের ধারে কাছেও আসতে নিষেধ
কর করা হয়ছে-(৪:৪৩)।।
রাসূল(সাঃ) ইমাম হিসেবে কোরআন পড়ে শোনাতেন।
সাহাবীরা গভীর মনোযোগ ও একাগ্রতার সাথে কোরআন পাঠ শুনতেন। নামাজ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য
ছিলো কোরআন পড়া, কোরআন বোঝা, কোরআন মানা, কোরআন প্রতিষ্ঠা করা এবং কেবলমাত্র কোরআন
প্রতিষ্ঠা করা।
নামাজ ইসলামের মূল ভিত্তি। কারণ নামাজের
মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে কোরআনের সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নামাজের ঐচ্ছিক ও প্রতীকী
রীতি রেওয়াজ, আর নাভির নিচে না বুকের উপরে, জোরে আমীন না আস্তে আমীন- এসব অর্থহীন বিতর্কের
আড়ালে চলে গেছে নামাজ প্রতিষ্টার মূল উদ্দেশ্য।
আমরা যে নামাজ পড়ি তার সাথে নবীজি(সাঃ)
এবং সাহাবী তাবেয়ীদের নামাজের উদ্দেশ্যের কোনো মিল নেই। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন;
“পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফেরনোয় কোনো পূণ্য নাই”-(২:১৭৭)। অর্থাৎ নামাজের শারীরিক অঙ্গভঙ্গিতে
পূণ্য নেই। পূণ্য হচ্ছে বিশ্বাস ও ভালো কাজে। বিশ্বাস ও ভালো কাজ কোনটা? যে বিশ্বাস
ও ভালো কাজের বিবরণ নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ি বা শুনি। রাসূল(সাঃ) এবং সাহাবীদের নামাজ
ছিলো বিশ্বাস ও ভালো কাজের যে কার্য তালিকা আল্লাহ নাজিল করেছেন তা জানার এবং বোঝার
পাঠচক্র এবং সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা।
প্রতিটি মানুষকে তার ‘সার্ভিস রুল’ অর্থাৎ
কোরআন বুঝিয়ে দেয়ার, পড়িয়ে দেয়ার, বারবার মনে করিয়ে দেয়ার আয়োজন হচ্ছে নামাজ।
কিন্তু কুরআনের সালাতের মতো হাদিস এর সালাতের সাথেও আমাদের নামাজের যোজন যোজন দূরত্ব।
নামাজ যে কোরানের পাঠচক্র ছাড়া আর কিছুই
নয়। কোরআনের পাঠচক্র ছাড়া নামাজের যাবতীয় অঙ্গভঙ্গি যে ঐচ্ছিক এবং তা নিয়ে ঝগড়া করা
যে আহাম্মকী তা অনুধাবন করতে হবে।
আহলে কিতাবীদের জন্যও সালাত কায়েমের
নির্দেশ ছি্লো। সে সালাত বলতে যদি নামাজ বোঝানো হয় তবে আহলে কিতাবীদের নামাজের সাথে
আমাদের নামাজের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে কোরআন পাঠ। রাসুল(সাঃ) নামাজে কোরআন পাঠ করতেন।
আবু জেহেলরোও নামাজ পড়তো। তবে তাতে কোরআন পড়তো না।
রাসুল(সাঃ)-এর মক্কী জীবনে প্রকাশ্যে
নামাজ পড়ার বর্ণনা ইতিহাসে থাকলেও নামাজের জন্য মসজিদ নির্মাণ, নির্দিষ্ট সময় নামাজের
জামাতে উপস্থিত হওয়ার সরকারী ফরমান জারি বা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় হিজরতের
পর। ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে হিজরত। এ কারণে
ইসলামিক ক্যালেন্ডার গণনা করা হয় হিজরতের দিন থেকে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করে
এ কথা বলা যায় যে, হিজরত ছাড়া ইসলাম মক্কায় শুরু হয়ে মক্কায়ই শেষ হয়ে যেতো। হিজরতের
নির্দেশ এবং এর গুরুত্ব বর্ণনা করে পবিত্র কোরআনে বেশ কিছু আয়াত নাজিল হয়েছে। বুখারী
শরীফের প্রথম হাদীসটিও হিজরত নিয়ে।
প্রত্যেক কাজ নিয়ত বা উদ্দেশ্যের সাথে
সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত বা উদ্দেশ্য অনুযায়ী ফল পাবে। যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার
জন্য হিজরত করেছে তার হিজরত ইসলামের জন্য গ্রীহিত হবে। আর যে ব্যক্তিগত লাভ লোভের জন্য
হিজরত করেছে তার হিজরতে কোনো পূণ্য নেই।
বুখারী শরীফের সূচনায় বলা আছে, মানুষ
তার নিয়ত বা উদ্দেশ্য অনুযায়ী ফল পাবে। এই নিয়ত হচ্ছে আপনার অন্তরের ইচ্ছা যা একমাত্র
আল্লাহ জানেন। বেশভূষা বা লোক দেখানো ক্রিয়াকর্ম দিয়ে নয়, অন্তরের ইচ্ছা দিয়ে মানুষের
কর্মফল নির্ধারিত হবে। নামাজ-রোজা, হজ্জ্ব-হিজরত, দান-দক্ষিণা সবকিছুর প্রতিদান নির্ধারিত
হবে অন্তরের ইচ্ছা অনুযায়ী। যারা ইসলাম ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য হিজরত করেছেন তাদের
হিজরত ইসলামের জন্য গৃহীত হবে। এ হিজরত কেবল মক্কা থেকে মদিনায় অভিবাসন নয়। এরপর সাহাবীরা
সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে।
হিজরত নিছক অভিবাসন ছিলো না। পদে পদে
বিপদ, পরাশক্তির সাথে লড়াই, সংঘাত, সংগ্রামের এক জীবন মরণ বাস্তবতা। মদিনায় হিজরতের
পর রাসূল(সাঃ) একটি সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন যাতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও
সমান অধিকার ছিলো। মদিনায় রাসূল(সাঃ) যে মসজিদ নির্মাণ করেন তা ছিলো তার প্রধান কার্যালয়,
বাসভবন, বিচারালয় এবং আইনসভা।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও বিচার আচার
চাইতে মসজিদে নববীতে আসতো। অর্থাৎ মসজিদে নববী কেবল নামাজের জন্য নির্মিত হয়নি। তবে
নামাজের জামাতে উপস্থিত হওয়ার যেসব বাধ্যবাধকতা হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায় তা কুরআনের
পাঠচক্রে উপস্থিত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় ফরমান।
কুরআন মদিনা ইসলামী রাষ্ট্রের আইনের
প্রধান বা একমাত্র উৎস। কুরআন নাজিলের প্রক্রিয়া তখনও চলমান ছিলো। প্রতিদিন নতুন বিধিনিষেধ
নাযিল হতো। রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত না হলে নতুন নতুন
আইন সম্পর্কে তারা কিভাবে জানবে? তখনকার সময়ে রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ কিছুই ছিলো
না। নাগরিকদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিচারিক বিধিবিধান জানানোর
মাধ্যম ছিলো নিয়মিত বিরতিতে মসজিদে উপস্থিত হওয়া।
একটা আইন বাস্তবায়ন করতে হলে সে আইন
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রচার করতে হয়। নামাজ ছিল কোরআনের আইন কানুন প্রচার
ও প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। মসজিদে নববীতে সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে কোরআন পড়া
হতো। রাসূল(সাঃ)-এর সাথে যারা নামাজ বা কুরআনের পাঠচক্রে অংশ নিতো। তাদের জন্য কোরআন
তো ছিলো ‘বাংলা’! অর্থাৎ কোরআন তাদের মাতৃভাষা। কোরআন বোঝার জন্য তাদের আলাদা করে ভাষা
ব্যাকরণ কিছুই শেখার প্রয়োজন ছিলো না।
ঐতিহাসিক সূত্র মতে আরবের বিভিন্ন গোত্র
তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কোরআন পাঠ করতো এবং আঞ্চলিক ভাষায় লিখতো। হযরত ওসমান(রাঃ)-এর
সময় কোরআনের আঞ্চলিক ভাষার কপিগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। রাসুল(সাঃ)-এর সময়ে মানুষ তাদের
আঞ্চলিক ভাষায় কোরআন পড়তো। অর্থাৎ কোরআন পাঠ ছিল পাঠকের পরিচিত ও বোধগম্য ভাষায়।
অতএব, কোরআন আরবী ভাষায় হলেও এবং পাঠ করলেও আমাদের বোধগম্য ভাষায় তা বুঝতে হবে। (চলবে…………)
(ইন্টারনেট থেকে সংগ্রীহিত ও সম্পাদিত)