হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কেমনে (পর্ব-১)

 

ছবিঃ প্রতিকী



আমাদের সমাজে হাদিসের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো, “হাদিস ছাড়া নামাজ পড়বেন কিভাবে? কোরআনে তো নামাজের সময়, রাকাত, প্রক্রিয়া-পদ্ধতি কিছুই নাই।” অর্থাৎ হাদিস ছাড়া নামাজ আদায় করা অসম্ভব!

 

এই লেখায় প্রমাণ করবো যে আমরা হাদিস দিয়ে নামাজ পড়ি না। নামাজ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রচলিত ধারণার সাথে হাদিসের উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক নাই। যুগযুগ ধরে প্রার্থণার যে রেওয়াজ চলে এসেছে, যার বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা আছে হাদিসে, তার সাথে সালাত অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যের বিশেষ সম্পর্ক নেই। এই লেখায় তুলে ধরবো হাদিসের সালাত ও আমাদের নামাজের মধ্যকার বৈপরীত্য।

 

কোরআনে আল্লাহ বারবার সালাত প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু মুসলমানদের জন্য আল্লাহর সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ এবং অনুমোদিত জীবন বিধান পবিত্র কুরআনে নামাজের পরিচিত কাঠামোর সুস্পষ্ট বর্ণনা নাই। প্রতিদিন কতো ওয়াক্ত নামা্জ,‌ কোন কোন সময় পড়তে হবে, কোন নামাজ কতো রাকা্‌ত, প্রতি রাকাতে কি কি পড়তে হবে; ঈদ, তারাবি এবং অন্যান্য প্রচলিত নামাজের প্রক্রিয়া পদ্ধতি সম্পর্কে কোরআনের বর্ণনা থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। অথচ কুরআনের ১০-১৫ আয়াতে আমাদের পরিচিত নামাজের প্রতিটা জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব ছিলোনা।

 

দোয়া বা প্রার্থনা অর্থে সালাত শব্দটি ব্যবহৃত হলেও কোরআনের সালাত প্রতিষ্ঠা করতে প্রধানত কুরআনের নিরবিচ্ছিন্ন অনুসরণকে বোঝানো হয়েছে। নামাজের নিয়ম জানার জন্যই প্রধানত হাদিসের প্রয়োজন পড়ে। কারণ কোরআনে নামাজের সুনির্দিষ্ট কাঠামো নাই। কিন্তু হাদিস থেকে নামাজের সর্বসম্মত কাঠামো বের করাও কোনো সাধারণ শায়খুল হাদিসের পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার হাজার হাদিস থেকে ছোট ছোট তথ্য জোড়া দিয়ে ইজমা কিয়াসের ভিত্তিতে নামাজের পরিচিত কাঠামো তৈরি করেছেন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক ও ইমাম হাম্বলের মত সর্বকালের সেরা স্কলাররা।

 

আহলে হাদিসের লোকেরা নাসিরুদ্দিন আলবানীর মাজহাব বা তার বই অনুযায়ী নামাজ পড়ে। প্রতিটা মাজহাবের বড় বড় আলেমদের মধ্যেও নামাজের অসংখ্য মাসালার বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। নামাজের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের অবিতর্কিত ধারাবাহিক এবং সম্পূর্ণ বিবরণ প্রচলিত হাদিসে নাই। এর কারণ রাসুল(সাঃ)-এর প্রধান সাহাবিরা নামাজের উল্লেখযোগ্য বর্ণনা দেননি। এ থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে, সময় কাঠামো বা অংগভংগিই সালাত প্রতিষ্ঠা নয়,- হাদিসের সালাতের মূল কথাও কোরআন প্রতিষ্ঠা বা কোরআনের নিরবিচ্ছিন্ন অনুসরণ। কিন্তু নামাজের ফজিলত ফাজায়েলের হাজার হাজার জাল হাদিস কিচ্ছা কাহিনীর আড়ালে পড়ে আছে সালাত আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।

 

আমরা হাদিস অনুযায়ী নামাজ পড়ি না। নামাজ নিয়ে ঝগড়া করি। অমুকের নামাজ হয় না, তমুকের পিছনে নামাজ হবে না, অমুক মসজিদে নামাজ পড়া বেদাত। সুতরাং আলাদা মসজিদ বানাও, শিরক বেদায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো ইত্যাদি।

 

ইসলামের প্রধান ইবাদত যা সকল মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায় ফরজ তার প্রক্রিয়া পদ্ধতি যেহেতু কোরআনে নাই তাহলে নামাজের হাদিসগুলো বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা আবশ্যক ছিল। কিন্তু নামাজের মৌলিক কাঠামো সংরক্ষণের কোনো তৎপরতা নবীজি(সাঃ)’র প্রধান সাহাবীদের মধ্যে দেখা যায় না। অসময়ের দশ ফোঁড় হিসেবে দ্বিতীয় প্রজন্মের ইমামরা নামাজের কাঠামো দাঁড় করানোয় রাসুল(সাঃ) কিভাবে নামাজ পড়েছেন- এ বিতর্কে বিশ্ব বরেণ্য সুন্নী আলেমরাও চারটি মাজহাবে বিভক্ত।

শিয়াদের নামাজ তো সিলেবাসেরই বাইরে। কিন্তু সময়ের এক ফোঁড় হিসেবে নামাজের সর্বসম্মত কাঠামো যারা পাথরে খোদাই করে রাখতে পারতেন, তারা এ নিয়ে মাথাই ঘামাননি।

 

নবীজি(সাঃ)এর নামাজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নিকটতম প্রত্যক্ষদর্শী কারা ছিলেন? হযরত আবুবক্কর(রাঃ), হযরত ওমর(রাঃ), হযরত ওসমান(রাঃ) ও হযরত আলী(রাঃ)। ইতিহাস ও সিরাতের বর্ণনানুযায়ী নবীজি(সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়ায় হযরত আবুবক্কর(রাঃ)’র ইমামতিতে নামাজ আদায় করেন। নবীজি(সাঃ) কিভাবে নামাজ পড়েছেন তার সবচেয়ে নিকটতম প্রত্যক্ষদর্শী নিঃসন্দেহে হযরত আববক্কর(রাঃ)। কিন্তু প্রধান ও প্রসিদ্ধতম হাদিস গ্রন্থ বুখারী শরীফ খুলে গুনে গুনে দেখুন সালাত অধ্যায়ে হযরত আবুবক্কর(রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসও নাই।

 

শুধু হযরত আবুবক্কর(রাঃ) নয়, প্রধান সাহাবিরা বুখারি শরীফের সালাত অধ্যায়ে অনুপস্থিত। তাহলে তাঁরা নবীজি(সাঃ)কে নামাজ পড়তে দেখেননি? নবীজি(সাঃ) কিভাবে নামাজ পড়েছেন তা তারা আমাদের জন্য বর্ণনা করলেন না কেন? হাদিস ছাড়া মুসলিম ঊম্মত কেয়ামত পর্যন্ত কিভাবে নামাজ পড়বে তা ইসলামের প্রথম খলিফা ও নবীজি(সাঃ)র মনোনীত ইমাম একবারও ভাবলেন না? রাসূল(সাঃ)-এর নামাজের সঠিক পদ্ধতি খোলাফায়ে রাশেদিন সংরক্ষণ, সংকলন বা বর্ণনা করেননি কেনো?

 

“হাদিস সংকলনের ইতিহাস” বইয়ে মাওলানা মোঃ আব্দুর রহিম উলেখ করেছেন, হযরত আবুবকর(রাঃ) তার বর্ণিত হাদিস সমূহের মধ্যে ‘একটি শব্দও যদি রাসুল সাঃ এর মূল বাণীর বিন্দুমাত্রও বিপরীত বা পার্থক্য হয় তবে তাকে জাহান্নামের ইন্ধন হতে হবে, এই ভয়ে হাদীস বর্ণনা করেননি।‘ প্রায় ২৩ বছর নবীজি(সাঃ)’র ইমামতীতে নামাজ আদায়ের পরও হযরত আবুবক্কর(রাঃ) রাসুল(সাঃ)-এর নামাজের নির্ভুল বর্ণনা দিতে পারলেন না?

 

নবীজি(সাঃ) দিনে কয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন? কোন নামাজ কোন সময় পড়তেন? আসরের নামাজ কয় রাকাত পড়তেন? মাগরিবের নামাজের কেরাত জোরে পড়তেন না আস্তে পড়তেন? বুকে হাত বাঁধতেন না নাভির নিচে হাত বাঁধতেন? ঈদের নামাজ কয় তাকবীরে পড়তেন? এগুলো হযরত আবু বক্কর রাঃ নিশ্চিত করে বলতে পারতেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

 

নামাজের সর্বসম্মত নিয়মাবলী নবীজি(সাঃ)এর জীবদ্দশাতে সংরক্ষণ করার সম্ভাব্য উচিত ছিল খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে। কিন্তু খোলাফায়ে রাশিদিন বা সাহাবীদের যুগের এমন কোনো সম্পূর্ণ ও সার্বজনীন নথি পাওয়া যায় না। তাতে নামাজের ধারাবাহিক বর্ণনা থেকে আন্দাজ করা যায় যে, নামাজ অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যের সাথে আমাদের সমাজে প্রচলিত নামাজের অঙ্গভঙ্গি ও ফজিলত ফাজায়েলের বিশেষ সম্পর্ক নেই।

 

নবীজি(সাঃ) নামাজের যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোরআন প্রতিষ্ঠা। এর বাইরে আর সবকিছুই ছিলো ঐচ্ছিক বা গৌণ। নামাজে কি পড়া হয়, কোরআন না হাদিস? যারা হাদিসকে ওহী মনে করেন তারা বলছেন, হাদীস হচ্ছে ওহিয়ে গাইরু মাতলু। অর্থাৎ  হাদিস নামাজে তেলাওয়াত বা পাঠযোগ্য নয়। রাসুল(সাঃ)-এর সাহাবী তাবেয়ীরা নামাজে কোরআন বহির্ভূত কোনো কিছু পড়তেন না। নামাজের মাধ্যমে সমাজে কোরআন কায়েম হয়েছে, সারা পৃথিবীতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভাতৃত্ব, ন্যায়বিচার, সাম্য, সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু আমরা আসল উদ্দেশ্য ভুলে নামাজ পড়াকেই বড় ইবাদত মনে করি।

 

ইবাদত শব্দের আরেকটি রূপ হচ্ছে আব্দ। আব্দ থেকে এবাদত। আব্দ মানে বান্দা বা চাকর। আর মাবুদ মানে মনিব। চাকরের কাজ মনিবের আদেশ নিষেধ মেনে চলা। অর্থাৎ মুনিবের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নাম হচ্ছে এবাদত। আমাদের মনিবের আদেশ-নিষেধের কিতাব হচ্ছে কোরআন।

 

আপনি একজন চাকরিজীবী হলে আপনার চাকরি বিধিমালায় বলা আছে আপনার কি কি করতে হবে, আর কি কি করা যাবে না। আপনি সেই বিধিমালা ভালোভাবে বুঝে সেই অনুযায়ী আপনার দায়িত্ব পালন করবেন। আপনি নিয়োগকর্তা হলে আপনার কর্মচারীদের জন্য একটা সার্ভিস রুল তৈরি করবেন। যাতে চাকরির বিভিন্ন বিধান, সুবিধা-অসুবিধা, বিভিন্ন ভাতা, বোনাস, পুরস্কার এবং চাকরি বিধিমালা ভঙ্গ করলে তার শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে। আপনার সহকর্মী বা সুপাভাইজার আপনার চাকরির বিধিমালা বুঝতে সাহয্য করবেন। কিন্তু তিনি যদি আপনাকে পরামর্শ দেন যে, আপনার এই চাকরির বিধিমালা বোঝার দরকার নাই, শুধু প্রতিদিন ৫ বার এই বিধিমালা পড়বেন।

 

মনে করেন এই সার্ভিস রুল ইংরেজিতে লেখা এবং আপনি ইংরেজি পড়তে পারেন, কিন্তু অর্থ বোঝেন না। সার্ভিস রুলের একটা শব্দেরও অর্থ না বুঝে আপনি প্রতিদিন আয়োজন করে পাঁচবার এই সার্ভিস রুল পড়েন। আপনার বস দেখছেন যে আপনি আপনার সার্ভিস রুল অনুযায়ী সময়মতো অফিসে আসছেন না, আপনার যা করার কথা তার কিছুই আপনি করছেন না। আবার সার্ভিস রুলে যা পরিস্কার ভাবে নিষেধ করা আছে তা আপনি নির্বিকার ভাবে করে যাচ্ছেন। আপনার কর্মে বিরক্ত হয়ে আপনার বস আপনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সার্ভিস রুল পড়েননি’? ‘হ্যা স্যার, প্রতিদিন ৫ বার করে পড়ি’। ‘তাহলে সার্ভিস রুল অনুযায়ী কাজ করছেন না কেনো’? ‘স্যার, সার্ভিস রুলে কি লেখা আছে তা তো আমি বুঝি না। কারণ আমি ইংরেজি পড়তে পারি কিন্তু এর অর্থ বুঝি না। তবে সুপারভাইজারের কথামতো প্রতিদিন পাঁচবার সুর করে সার্ভিস রুল পড়ি’।

আপনার বসের প্রতিক্রিয়া কি হবে? বা আপনি বস হলে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে?

 

একজন কর্মচারী যখন চাকরিতে যোগ দেয় সে তার প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস রুল ভালোভাবে পড়ে, তার যাবতীয় দায় দায়িত্ব বুঝে নিয়ে চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু আপনি সার্ভিস রুল দিনে ৫০ বার পড়লেও আপনার বসের কিছু যায় আসে না, যদি আপনি আপনার চাকরির বিধিমালা না বোঝেন এবং সে অনুযায়ী কাজ না করেন।

 

একজন ভালো ম্যানেজারের দায়িত্ব হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে, তার দলের সবাই সার্ভিস রুল বুঝেছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করছে। যেসব চাকরিতে সার্ভিস্ রুল অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়, যেমন; পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়- পুলিশ বা মিলিটারী একাডেমিতে। যেখানে কঠোর প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতিটা সদস্যকে প্রতিটা কাজ যথাযথ বুঝিয়ে দেয়া হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের সকল সদস্য নিয়ম-অনিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা থাকলে সে প্রতিষ্ঠানের কারো পক্ষে নিয়ম ভঙ্গ করা কঠিন। কারণ একটা আইন যদি সমাজের সব মানুষ জানে তবে কারো পক্ষে সে আইন ভঙ্গ করা বেশ কঠিন।

 

সমাজের সবাই আইন জানলে সাধারণ মানুষই পুলিশের ভূমিকা পালন করে। তারা অপরাধীকে ধরে পুলিশের সোপর্দ করে। এই কারনে নতুন কোনো আইন যেমন; বাল্যবিবাহ, যৌতুকের দাবি, যৌন হয়রানি ইত্যাদি বিষয়ে সরকার গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে গণসচেতনতা তৈরি করে। গণ মানুষের সহায়তা ছাড়া কোনো অপরাধ দমন করা সম্ভব হয় না।

 

রাসুল(সাঃ) নামাজের মাধ্যমে সমাজে কোরআন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে কেবলমাত্র কোরআন প্রতিষ্টা করেছেন।

 

নামাজে হাদিস, ফিকাহ, সিরাত, ইতিহাস, আজব দুনিয়া গজব কাহিনী পড়া হয় না। কেবলমাত্র কোরআন পড়া হয়। নামাজে তাকবীরে তাহরিমা থেকে সালাম পর্যন্ত যা পড়া হয় সবই কোরআন। কোরানের বাইরে আর যে সব দোয়া দরুদ পড়া হয় তা 'দলীয় সংগীত'। এক মাজহাবে দাত, আরেক মাজহাবে বেদাত। (চলবে……...)

 

(ইন্টারনেট অবলম্বনে)

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url