শয়তানের বাক্স
কথিত শয়তানের বাক্স |
একটা
সময় আমাদের হুজুররা বলতেন ছবি আঁকা হারাম। ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার পর বললেন, ছবি
তোলা হারাম। তারপর যখন ছবি তোলা বিশ্বজনীন হয়ে গেলো, ছবি ছাড়া পাসপোর্ট করা যায় না,
হজ্জ্ব-ওমরাহয় যাওয়া যায় না, বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়া যায় না - তখন বলতে লাগলেন
ছবি তোলা হারাম, তবে বিশেষ প্রয়োজনে জায়েজ আছে।
গ্রামের
বাজারে চায়ের দোকানে কাউকে চা পান করতে দেখলে ছোটোমোটো হুজুররা ‘যেনো হারাম খাচ্ছে’
এমন চেহারা করে তার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ ফিরিয়ে নিতো। ঘৃণা প্রদর্শনের
বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আবডালে থুথুও ফেলতো। অথচ হাদিসে আছে গরম কিছু খাওয়া মাকরুহ। মাকরুহ
মানে কাজটা করা উচিৎ না বা করা ভালো না।
টেলিভিশন।
টেলিভিশনকে হারাম করার জন্য হুজুরদের ফতোয়ার শেষ ছিলো না। গ্রামে-গঞ্জে কতো টেলিভিশন
যে হুজুররা ভেঙ্গেছেন! বলা হতো, টিভি দেখা হারাম। টিভি হলো শয়তানের বাক্স। মাদ্রাসার
ছেলেপেলেদের টিভি দেখা নিষেধ ছিলো। কেউ লুকিয়ে ঝুকিয়ে দেখলে ওস্তাদরা জিজ্ঞেস করলে
স্বীকার করতো না, মিথ্যার আশ্রয় নিতো। অথচ টিভি দেখা নয়, বরং মিথ্যা বলা গুরুতর পাপ।
তারপর
হুজুররা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে প্রশ্ন-উত্তর বিষয়ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে টিভিতে চেহারা
দেখাতে শুরু করলেন। প্রশ্নকর্তারা একটু মাসআলা জানার জন্য টিভিতে সরাসরি ফোন করে এটা
সেটা প্রশ্ন করতেন। সেসব প্রশ্নের জবাব দেয়া হতো হাদিস বা ফতোয়ার ভিত্তিতে। যে প্রশ্নের
উত্তর হাদিসেও নাই, বলা হতো, ‘এ ব্যাপারে তো হাদিসে স্পষ্ট কিছু বলা নেই, তবে আপনি
এইভাবে বা সেইভাবে কিংবা আপনার যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবে করতে পারেন’। অর্থাৎ নিজস্ব
মনগড়া উত্তর বানিয়ে বানিয়ে বলতে হতো। কারণ, প্রশ্নের উত্তর তো দিতে হবেই। নইলে প্রশ্নকর্তা
না জানি ভেবে বসে ধুর… ‘হুজুর কিছু জানেনা। ভুয়া হুজুর’! মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র
কোরাআন এসব অনুষ্ঠানে প্রায় অনুপস্থিত।
তারপর
বিশেষ ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে ধর্মীয় প্রশ্নোত্তর বিষয়ক টিভি অনুষ্ঠানের
এনটিভির উপস্থাপক চিহ্নিত রাজাকার জামাত নেতা মওলনা আবুল কালাম আজাদ পালিয়ে দেশত্যাগ
করলে এই ধরণের অনুষ্ঠান প্রচারে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে। তবে এখনো কিছু কিছু টিভিতে চালু
আছে।
এরপর
এলো স্মার্টফোন। ফেসবুক, টিকটক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ইউটিউব – অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহারের
স্বর্ণযুগ। ইন্টারনেট ব্যবহারের নয়া নয়া মাধ্যম। সবার হাতে স্মার্টফোন। পারিপার্শিক
অবস্থা দেখে হুজুররা আর বসে থাকতে পারলেন না। আগের সব ফতোয়া ভুলে ইন্টারনেট যুগের সুবিধা
‘ইস্তেমাল’ করতে শুরু করলেন। এখন স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট ছাড়া হুজুরদের চলেই না। এখন
সবার সাথে সমান তালে হুজুররা সুন্দর সুন্দর পোজ দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে ছাড়েন। আর
ভক্তরা কমেন্ট করেন, মাশাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ ইত্যাদি।
ছবি
তোলা তো এখন মামুলী ব্যাপার। ইন্টারনেটে ওয়াজের ভিডিও, অনলাইনে টকশো, ওয়াজ বা এমনি
ভিডিওর মাধ্যমে ঝগড়াঝাটি, গালিগালাজ সবই এখন জায়েজ হয়ে গেছে! এখন আর বিশেষ প্রয়োজন লাগে না। এক হুজুর আরেক
হুজুরের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়। একজন বলে অমুক সুন্নী, আরেকজন বলে অমুক ওহাবী, ওহাবীদের
সাথে নামাজ পড়া জায়েজ নাই। আরেকজন বলে অমুক আহলে হাদিস। কেউ আবার ব্যঙ্গ করে বলে আহলে
খবিস। একজন আরেকজনকে কাফের ঘোষণা দেয়। বাটপার, বদমাইশ, চিটার – আরো কতো কি বলে।
ওয়াজে
জিকিরের নামে গান, নানারুপ কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি করে আরেকজনের নামে গীবত ইত্যাদির ভিডিও-
সবকিছু এখন জায়েজ হয়ে গেছে। অথচ কোরআন অনুযায়ী গীবত জিনাহ ব্যাভিচারের চেয়েও জঘন্য
পাপ!
অনেকে
বলেন, সত্য বা উচিৎ কথা বলা গীবত না। অথচ এ ব্যাপারেও নবীজি(সাঃ)-এর হাদিস আছে। এক
সাহাবী নবীজি(সাঃ)কে প্রশ্ন করেন; ‘কেউ যদি সেই কাজ সত্যি করে তা বলাও কি গীবত’? নবীজি(সাঃ)
উত্তর দিলেন; “যা সত্যি তা বলা গীবত, আর যা সত্যি নয় তা হলো তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ”।
তাহলে
কি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে হারাম জিনিষ হালাল হয়ে গেলো? কোরআন তো আগেরটাই আছে! হাদিসও
আগে যা ছিলো এখনও তাই আছে। মাঝখান থেকে অনেক হারাম জিনিষ হালাল হয়ে গেছে। অথচ হারামকে
হালাল বা হালালকে হারাম বলার ক্ষমতা আল্লাহ নবীজি(সাঃ)কেও দেননি-(৬৬:১)।