কুরআন অনুযায়ী ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ধর্মগ্রন্থপ্রাপ্ত লোকেরাও জান্নাতে যাবে!

 
ছবিঃ প্রতীকী



ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটি গুরুতর অভিযোগ, ইসলাম ইহুদি খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ঘৃণা করতে শেখায়। ইসলাম ব্যতীত আর সকল ধর্ম বিশ্বাসকে ভ্রান্ত মনে করে এবং অন্যান্য সব ধর্মাবলম্বীদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে শেখায়। এসব অভিযোগের জবাবে অনেকে আবার মুসলমানরা কোথায় কতোভাবে নির্যাতিত তার তালিকা তুলে ধরেন। এই নিবন্ধে খুজতে চেষ্টা করবো অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে কোরআনে কি আছে।

 

বিষয়টি মুসলিম অমুসলিম সবার কাছে বেশ অপরিচিত মনে হতে পারে। কারণ ধর্মের নামে বিভাজন, বিভক্তি, রক্তপাত যাদের পকেট ভারি করছে তারা কোরআন বহির্ভূত বিভিন্ন উদ্ভট বক্তব্য, একপেশে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে আমাদেরকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করাতে তৎপর!

 

কোরআনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে বহুমুখী বর্ণনা আছে, বিশেষ করে ইহুদি খ্রিস্টান বা আহলে কিতাবদের সম্পর্কে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরণের বর্ণনাই পাওয়া যায়। অন্যান্য অনেক ধর্মাবলম্বীদের নাম উল্লেখ না করে বিভিন্ন বিশ্বাসকে বিশেষায়িত করে যেমন; কাফের বা যারা অবিশ্বাসী মুশরিক এবং মুনাফিক বা যারা ছদ্মবেশী ধার্মিক- তাদের পরিণাম নিয়ে বলা হয়েছে।

 

কাফের মুশরিক এবং মুনাফিকদের পরিণাম বা পরিণতি বেশ স্পষ্ট- যদিও আমরা ধার্মিকরাও সেই কুফরী বা মুনাফিকিতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বা অজ্ঞতাবশতঃ জড়িয়ে যাই। তাই আপাতঃদৃষ্টিতে কাউকে ধার্মিক মনে হলেও সে আল্লাহর দৃষ্টিতে কাফের মুশরিক বা মুনাফেক হতে পারে। আবার আপাতঃদৃষ্টিতে কাউকে কাফের বা মুশরিক মনে হলেও তার অন্তরের বিশ্বাস একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। 

 

আহলে কিতাব এবং মুসলিমদের মধ্যেও বহু দলমত আছে। এদের মধ্যে কারা সরল সত্যে অবিচল তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন এবং এ ফয়সালা একমাত্র আল্লাহই করবেন। এই নিবন্ধে আমরা কেবল কোরআনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে যে বর্ণনা আছে তার সাধারণ ধারণা নেয়ার চেষ্টা করবো।

 

কে বেহেস্তে যাবে কে দোযখে যাবে এর চূড়ান্ত রায় কেবল বিচার দিনেই মিলবে। তবে শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী নয়, নিজেদের মাজহাব বা উপ-মাজহাব অনুসারী অনুবাদক বা তাফসীর কারকগণ নিজেদের বিশ্বাস বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আয়াত গুলোর অনুবাদ করার কারণে এসব আয়াতের অনুবাদ বা তাফসির কেন্দ্রিক একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে।

 

আমি কোরআনের বিভিন্ন অনুবাদকের অনুবাদ এবং তাফসীর পর্যালোচনা করে যতোটুকু বুঝতে পেরেছি তার আলোকে বিভিন্ন সুরার বাংলা উচ্চারণ ও অনুবাদ উদ্ধৃত করে পর্যালোচনা করবো, যাতে আমরা একটা মোটামুটি ধারনা নিতে পারি। তবে এ নিয়ে আমাদের বিতর্কে জড়িয়ে লাভ নেই। এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ।

 

সূরা হাজ্জ আয়াত-১৭

“ইন্নাল্লাযীনা আ-মানূওয়াল্লাযীনা হা-দূওয়াসসা-বিঈনা ওয়ান্নাসা-রা-ওয়াল মাজুছা ওয়াল্লাযীনা আশরাকূ ইন্নাল্লা-হা ইয়াফসিলুবাইনাহুম ইয়াওমাল কিয়া-মাতি ইন্নাল্লা-হা ‘আলা-কুল্লি শাইয়িন শাহীদ”-(২২:১৭)।

 

(যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদী হয়েছে, যারা সাবিয়ী, খৃষ্টান, অগ্নিপূজক এবং যারা মুশরিক - কিয়ামাত দিবসে আল্লাহ তাদের মধ্যে ফাইসালা করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের উপর সাক্ষী)।

 

সুতরাং আল্লাহ সকলের ভিতরের, বাইরের খবর জানেন। বিচার দিনে তিনি যার যার কর্মফল বন্টন করবেন। আমরা কেবল কে কি বুঝলাম সে কথা বলতে পারি। সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহর।

 

সূরা বাকারা আয়াত-৬২ 

“ইন্নাল্লাযীনা আ-মানূওয়াল্লাযীনা হা-দূওয়ান্নাসা-রা- ওয়াসসা-বিঈনা মান আ-মানা বিল্লা-হি ওয়াল ইয়াওমিল আ-খিরি ওয়া‘আমিলা সা-লিহান ফালাহুম আজরুহুম ‘ইনদা রাব্বিহিম ওয়ালা- খাওফুন ‘আলাইহিম ওয়ালা-হুম ইয়াহঝানূন”-(২:৬২)।

 

এই আয়াতের কিছু আন্তর্জাতিক মানের অনুবাদ উপস্থাপন করছিঃ

বাংলা কোরয়ান থেকেঃ

“নিশ্চয়ই মুসলিম, ইয়াহুদী, খৃষ্টান এবং সাবেঈন সম্প্রদায়, (এদের মধ্যে) যারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং ভাল কাজ করে, তাদের জন্য তাদের রবের নিকট পুরস্কার রয়েছে, তাদের কোন প্রকার ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবেনা”।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের অনুবাদঃ

“নিশ্চয়ই যাহারা ঈমান আনিয়াছে, যাহারা ইয়াহুদী হইয়াছে এবং খ্রিস্টান ও সাবিঈন যাহারাই আল্লাহ্ ও আখিরাতে ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, তাহাদের জন্য পুরস্কার আছে তাহাদের প্রতিপালকের নিকট। তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না”।

ড: আবু বক্কর মোহাম্মদ জাকারিয়া সাহেবের অনুবাদঃ

“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে, যারা ইয়াহুদী হয়েছে এবং নাসারা ও সাবিঈরা* -(তাদের মধ্যে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি এবং নেক কাজ করেছে - তবে তাদের জন্য রয়েছে তাদের-রবের নিকট তাদের প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না”।

*(সাবিঈ- বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের পূজারী মতান্তরে ফেরেশতাদের উপাসনাকারী)।

 

ড: আবু বক্কর মোহাম্মদ জাকারিয়া এবং অন্যান্য আরো প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী ‘সাবেঈ’ হচ্ছে বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের পূজারী মতান্তরে ফেরেশতাদের উপাসনাকারী বা যাদের সুনির্দিষ্ট সু-সংগঠিত কোনো ধর্ম নাই। প্রাচীন বা সনাতন বা যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাভিত্তিক ধর্মাবলম্বী। আর ‘ম্যাজিয়ান’ হচ্ছে প্রাচীন পারস্যের অগ্নি উপাসক। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে অন্য একটি নিবন্ধে আলোচনা করেছি।

 

যাইহোক, আয়াতগুলির অনুবাদে ব্রাকেটের অংশটুকু অনুবাদকের নিজস্ব মত, আয়াতের অংশ নয়। অর্থাৎ তিনি এমনটি বুঝেছেন বা বোঝাতে চেয়েছেন।

 

আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস বলতে আমরা ইসলাম গ্রহনকে বুঝতে চাই। ইসলাম গ্রহণ করলে ইহুদি, খৃষ্টান বা সাবেঈন কেনো, বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন, শিখ, নাস্তিক যেই হোক, সে তো ঈমানদার বা মুসলমানই হয়ে গেলো। তাহলে আলাদা  আলাদা শ্রেণী উল্লেখ করতেন না আল্লাহ।  

Yusuf Ali:

“Those who believe (in the Quran) and those who follow the Jewish (scripture), and the Christians and the Sabians -any who belive in Allah and the Last Day, and works righteousness shall have their reward with their Lord; on them shall be no fear, not shall they grieve”.

বঙ্গানুবাদঃ (যারা (কুরআনে) বিশ্বাস করে এবং যারা ইহুদি (ধর্মগ্রন্থ) এবং খ্রিস্টান ও সাবিয়ানদের অনুসরণ করে - যারা আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস করে এবং সৎকাজ করে তাদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে তাদের পুরস্কার রয়েছে)। তাদের কোন ভয় থাকবে না, তারা দুঃখ পাবে না)।

 

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী অনুদিত “দ্য হোলী কুরআন” ইউরোপ’ আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয়। সৌদি আরবের ‘কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স’ ইংরেজি ভাষাভাষীদের জন্য এই অনুবাদ মনোনীত করে।

 

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, “Those who follow the Jewish (scripture), and the Christians” – তাওরাত-ইঞ্জিলের মধ্যেই কিন্তু নবীজি(সাঃ) এবং কোরআন সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে এবং খাঁটি ইহুদি খ্রিস্টান মানে নবীজী এবং কোরআনকে বিশ্বাস করে, যেমনটা আমরা হযরত মুসা ও ঈসা(আঃ)কে নবী হিসেবে এবং তাওরাত-ইঞ্জিলকে আসমানী কিতাব হিসেবে বিশ্বাস করি।

মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর ইংরেজি অনুবাদের বঙ্গানুবাদঃ

“তারা যারা ঈমান এনেছে (আরবের মোহাম্মদের প্রতি), বা ইহুদী, খ্রিস্টান বা সাবিয়ানই হোক না কেন যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের প্রতিদান তাদের পালনকর্তার কাছে নিশ্চিত। তাদের কোন ভয় নেই, তারা দুঃখিত হবে না।”

 

কোরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত সূরা মায়েদার ৬৯ নং আয়াতে আল্লাহ এই আয়াতের পুনরাবৃত্তি করেছেনঃ

“এটা সুনিশ্চিত যে, মুসলিম, ইয়াহুদী, সাবেঈ এবং খৃষ্টানদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং সৎ কাজ করে, এইরূপ লোকদের জন্য শেষ দিনে না কোন প্রকার ভয় থাকবে আর না তারা চিন্তান্বিত হবে”।

 

এ দুই আয়াতে বিশ্বাস এবং ভালো কাজের পূর্ব শর্ত দেয়া হয়েছে। এই বিশ্বাস এবং সৎকর্মের ব্যাপকতা যারা জানেন না তারা কোরআন পড়েন ঠিকই, কিন্তু বুঝে পড়েন না। কোরআনের মৌলিক নির্দেশনা তাদের কাছে পরিষ্কার নয় বা নিজস্ব মাজহাব বা বুঝ অনুযায়ী বোঝেন। বাকি অধিকাংশই হুজুর যা বলে তাতেই মারহাবা! ‘এই বিশ্বাস এবং সৎকর্ম বিষয়ে আলাদা একটি নিবন্ধ লেখার ইচ্ছা আছে’।

 

আমার মনে হয় এসব অনুবাদ বা বিশ্লেষণে কোরআনের বক্তব্য বেশ পরিষ্কার। কিন্তু ইহুদি-খ্রিস্টান সবাই গণহারে বেহেস্তে যাবে এটা কিভাবে সম্ভব! যেখানে হানাফিদেরই বেহেশ্তে ঢুকতে দিতে চায় না সালাফিরা।

 

আমাদের খুব পরিচিত আয়াতঃ

“ইন্নাদ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম - (আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম একমাত্র ধর্ম-(৩:১৯)।“

“ওয়া রাদীতুলাকুমুল ইছলা-মা দীনান” - (এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসাবে অনুমোদন দিলাম-(৫:৩)।“

 

সুরা আল ইমরানের ৮৫ নং আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকে বলে থাকেন, ‘ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না’:

“ওয়া মাই ইয়াবতাগি গাইরাল ইছলা-মি দীনান ফালাই ইউকবালা মিনহু ওয়া হুওয়া ফিল আ-খিরাতি মিনাল খা-ছিরীন-(৩:৮৫)।“

(আর যে কেহ ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম অন্বেষণ করে তা কখনই তার নিকট হতে গৃহীত হবেনা এবং পরলোকে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে)।

 

কিন্তু এর ঠিক আগের আয়াতে অর্থাৎ সুরা আল ইমরানের ৮৪ নং আয়াতে আল্লাহ ইসলাম ধর্মের সংংজ্ঞা দিয়েছেন- কারা মুসলিমঃ

“কুলআ-মান্না-বিল্লা-হি ওয়ামাউনঝিলা ‘আলাইনা-ওয়ামা-উনঝিলা ‘আলাইবরা-হীমা     ওয়া ইছমা-‘ঈলা ওয়া ইছহা-কা ওয়া ইয়া‘কূবা ওয়াল আছবা-তিওয়ামাঊতিইয়া মূছা-ওয়া ‘ঈছা-ওয়ান্নাবিইয়ূনা মির রাব্বিহিম লা-নুফাররিকুবাইনা আহাদিম মিনহুম ওয়া নাহনূ লাহূমূছলিমূন-(৩:৮৪)।

(বলুন: আমরা আল্লাহর প্রতি এবং আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং ইব্রাহীম (Abraham), ইসমাঈল (Ismael), ইসহাক (Issac), ইয়াকুব (Jacob) এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস করি। এবং আল-আসবাত [ইয়াকুবের বারো পুত্র] এবং যা মূসা (Moses), ঈসা (Jesus) এবং নবীগণকে তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তাদের মধ্যে একে অপরের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা (ইসলামে) তাঁর (আল্লাহর) কাছে আত্মসমর্পণ করেছি)।

 

ইহুদি খ্রিষ্টান এবং আব্রাহামিক সবাইকে কোরআন মুসলিম বলেছে। এজন্যেই মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবতাহীম(আঃ)।

 

সুরা হাজ্জ আয়াত-৭৮

“এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত; তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম এবং এই কিতাবেও, যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী স্বরূপ হয় এবং তোমরা স্বাক্ষী হও মানব জাতির জন্য”-(২২:৭৮)।

 

ইহুদি খৃষ্টানদের সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্যও আছে কোরআনে। তবে নেতিবাচক ইতিবাচক উভয় ক্ষেত্রেই একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ অংশকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

 

সূরা আল ইমরান ৬৭ নং আয়াতঃ

“মা-কানা ইবরা-হীমুইয়াহূদিইইয়াওঁ ওয়ালা-নাসরা-নিয়ইইয়াওঁ ওয়ালা-কিন কা-না হানীফাম মুছলিমাওঁ ওয়ামা-কা-না মিনাল মুশরিকীন-(৩:৬৭)।

(ইবরাহীম ইয়াহুদী ছি্লোনা এবং খৃষ্টানও ছিলোনা, বরং সে সুদৃঢ় মুসলিম ছিল এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলোনা)।

 

এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিত বোঝা যায় যে, ইহুদি খ্রিস্টানদের একাংশ উন্মতে মোহাম্মদীকে ইব্রাহিম(আঃ)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে মেনে নিচ্ছিলো না। কেবল নিজেদেরকে ইব্রাহিম(আঃ)-এর উত্তরাধিকারী দাবি করছি্লো। তারা শিরকও করতো। তখন আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, ‘ইব্রাহিম ছিলো একজন মুসলিম এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না’। ইহুদিরাও হযরত ইব্রাহিম(আঃ)-এর জন্য দোয়া করে, যেমনটা আমরা নামাজে ‘দরুদে ইব্রাহিম’ পড়ি।

 

সুরা বাকারা আয়াত-১১১

“এবং তারা বলেঃ ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ছাড়া আর কেহই জান্নাতে প্রবেশ করবেনা; এটা তাদের মিথ্যা আশা। তুমি বলঃ যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর।

 

এ আয়াত থেকে এটা পরিস্কার যে, ইহুদি খৃস্টানদের মাঝেও একদল আছে যাদের অন্য কারো বেহেশতে যাওয়া নিয়ে কঠিন আপত্তি। প্রয়োজনে তারা দোযখে যাবে তবু অন্য কারো বেহেশতে যাওয়া ঠেকাতে হবে। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, “এটা তাদের মিথ্যা আশা”। অর্থাৎ অন্য কেউও বেহেশ্তে যাবে।

 

সুরা মায়্যিদা আয়াত-৫১

“হে মু’মিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করনা, তারা পরস্পর বন্ধু; আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে নিশ্চয়ই সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেননা”-(৫:৫১)।

এখানে যুদ্ধ কিংবা বিশেষ পরিস্থিতিতে ইহুদি বা-নাসারাদের কো্নো বিশেষ অংশকে বোঝানো হতে পারে। কারণ ভিন্ন বক্তব্যও আছে একই সূরার পরবর্তী আয়াতে।

 

সুরা মায়িদা আয়াত-৮২

“তুমি মানবমন্ডলীর মধ্যে ইয়াহুদী ও মুশরিকদেরকে মুসলিমদের সাথে অধিক শক্রতা পোষণকারী পাবে, আর তন্মধ্যে মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব রাখার অধিকতর নিকটবর্তী ঐ সব লোককে পাবে যারা নিজেদেরকে নাসারাহ্ (খৃষ্টান) বলে; এটা এ কারণে যে, তাদের মধ্যে বহু আলিম এবং বহু দরবেশ রয়েছে; আর এ কারণে যে, তারা অহংকারী নয়”-(৫:৮২)।

 

আগের আয়াতে খ্রিস্টানদেরকেও বন্ধুরূপে না নেয়ার কথা বলা হয়েছে। আবার এই আয়াতে খ্রিস্টানদের ব্যাপারে ইতিবাচক বলা হয়েছে এবং মুমিনদের ঘনিষ্ঠ মিত্র বা বন্ধু বলা হয়েছে। এ আয়াতগুলো রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ বিশেষ সময়ে ইহুদিদের এবং খ্রিস্টানদের বিশেষ দলকে বোঝানো হয়েছে।

 

মদিনায় বনু নাজির, বনু কুরাইজা, বনু কাইনুকা এবং অন্যান্য ইহুদি গোত্রগুলোর সাথে বিভিন্ন সময়ে শ্ত্রুতা মিত্রতা ও কৌশলগত সমঝোতার সম্পর্ক ছিলো। এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কৌশলগত নির্দেশনা আসতো। তাই ইহুদি মানে ইহুদিদের বিশেষ গোত্র বা দলকে বোঝানো হতে পারে।

 

মদিনা ছিলো একটি গণতান্ত্রিক ইসলামী রাষ্ট্র - যার সংবিধান বা শাসনতন্ত্র ছিল কোরআন, আর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন নবীজি(সাঃ)। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ছিলো। কিন্তু রাষ্ট্রের যে আইন বা বিধান তা অমান্য বা অস্বীকার করলে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে, বহিঃশত্রুর সাথে আঁতাত করলে তা এখনকার আধুনিক রাষ্ট্রেও রাষ্ট্রদ্রোহীতা যা সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

 

ইসলাম ধর্মে ৪ বিয়ে বৈধ বা সম্পদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ইসলামী বিধান ইউরোপিয়ান বা ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে চলবে না। সেসব দেশে থাকতে হলে সেসব দেশের আইন সংবিধান মেনে চলতে হবে। আইএস, আল-কায়দার সাথে যোগাযোগ থাকলে সে আমেরিকার নাগরিক হলেও তার পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হবে।

 

একাত্তরে যারা পাকিস্তানিদের সাথে সখ্যতা রেখেছিলো তারা ‘রাজাকার’। পাকিস্তানিরাও মুসলিম। কিন্তু আমরা তো মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করিনি, পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করেছি। মুসলমানদের হত্যা বা যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার হিসেবে। অন্যায় আক্রমণের স্বীকার হলে মুসলমানদের সাথে কি যুদ্ধ করা যাবে না? যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। বিশেষ ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর সাথে আচরণের নির্দেশের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর সার্বজনীন আচরণের মানদন্ড হিসেবে বোঝানো হয়নি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলছেনঃ

সুরা মুমতাহানা আয়াত-৮

“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ হতে বহিস্কৃত করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহতো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন”-(৬০:৮)।

 

নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম আচরণকারীদের ভালোবাসেন। তবে এখনো ইরান, ইরাক, ফিলিস্তিন, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর সাথে ইহুদি-খ্রিস্টানপ্রধান দেশগুলোর শত্রুতা-মিত্রতার সম্পর্ক আছে। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত নির্যাতিত মুসলমানরা ইসরাইলের দখলদারদের সাথে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ন্যায্য হকদার এবং কেবল একজন মুসলমান হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসেবে আমাদের সর্বাত্মক ভালোবাসা থাকবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি, আর ইসরাইলের দখলদারদের জন্য থাকবে ঘৃণা। একইভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বা উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের প্রতি হিংসার আগুনে জ্বলা কাশ্মীরি বা নাগরিকত্ব বঞ্চিত ভারতীয় বা উইঘুরের মুসলমানরা আমাদের পূর্ণ সমর্থন বা সহানুভূতি পাবে। কিন্তু সেকারণে তো একজন নিরীহ ইহুদি, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু বা চাইনিজের সাথে অন্যায় আচরণ করতে পারি না।

 

একজন সন্ত্রাসী টুইন-টাওয়ারে হামলা করে, তার জন্য আমেরিকানরা যদি সব মুসলমানকে ঘৃণা করে তা অবশ্যই অন্যায়। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধর্মকে ততক্ষণই ব্যবহার করা হয় যতক্ষণ তা জাতীয় স্বার্থের সহায়ক। যখনই ধর্ম রাজনৈতিক বা জাতীয় স্বার্থের মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন মুসলিম-অমুসলিম সব দেশে ধর্মকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়। সৌদি আরবের প্রধান শত্রু ইরান, ইয়েমেন। আবার প্রধান মিত্র আমেরিকা, আর ইসরাইল গোপন মিত্র।

 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মিত্র ইন্ডিয়া এবং রাশিয়া। কিন্তু শত্রু মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। আবার পাকিস্তানের মিত্র চীন, আমেরিকা, কিন্তু শত্রু আমরা।

 

ইহুদি খ্রিস্টান অন্যান্য সবাইকে ভিনগ্রহে পাঠিয়ে দিলেও আমাদের শত্রুর অভাব হবে না। তখন শিয়া-সুন্নি, ওহাবী-সালাফিদের মধ্যে মিসাইল আদান প্রদান হবে। বর্তমান রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক নয়। পশ্চিমা দেশগুলোতেও বৈচিত্রতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সার্বজনীন শাসন ব্যবস্থার প্রাধান্য। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে ধর্মের ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

কোরআন পড়ুন, বুঝে পড়ুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url