পদ্মা পাড়ের মেয়ে গীতা দত্ত-বলিউডের এক সময়ের সুপারহিট গায়িকা
“তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার”
“নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে”
“এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়”
“ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজে”
কিংবা
“মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত গায়া”
“আজ কি রাত পিয়া, দিল না তোড়ো
মন কি বাত পিয়া মান লো”
“বাবুজি ধীরে চল না”
“তদবির সে বিগড়ি হুয়ি তকদির বানা
লে”
এমন অনেক জনপ্রিয় গানের কালজয়ী
শিল্পী ভারতের মহাগায়িকা গীতা দত্ত। নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না, তিনি
এই বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া বৃহত্তর ফরিদপুরের মেয়ে। মূল নাম গীতা ঘোষ
রায়চৌধুরী। প্রথমে তার নাম গীতা রায় হিসেবে প্রচারিত হতো। নায়ক ও পরিচালক গুরু
দত্তের সাথে বিয়ে হওয়ার পর গীতা দত্ত নামে সংগীত জগতে পরিচিতি লাভ করেন।
গীতা দত্ত ২৩ নভেম্বর ১৯৩০ তারিখে বাংলাদেশের
বৃহত্তর ফরিদপুরের বর্তমান শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার টেংরা গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায়চৌধুরী ও মা অমিয়া দেবীর ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন
পঞ্চম। তার বাবা ছিলেন ইদিলপুরের জমিদার। শৈশবে তিনি স্থানীয় ইদিলুপর স্কুলে লেখাপড়া
শুরু করেন।
ছোট থেকেই গীতা দত্তের গানের
প্রতি আগ্রহ আর সুরেলা কণ্ঠ মা-বাবার নজরে আসে। স্থানীয় গুরু হরেন্দ্রনাথ নন্দীর কাছে
তালিমের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভিটেমাটি ছেড়ে সপরিবারে
কিছুদিন আসাম এবং কলকাতায় থেকে ১৯৪২ সালে বাবা-মায়ের সাথে মুম্বাই শহরে পাড়ি জমান গীতা
দত্ত। সেখানে একটি এপার্টমেন্টের ৩য় তলায় বসবাস শুরু করেন।
জমিদার বাবার আদরের মেয়ে গীতা
দত্তকে ১২ বছর বয়সেই জীবিকার তাগিদে করতে হয়েছিল টিউশনি। শিক্ষার্থী পড়ানোর জন্য মাইলের
পর মাইল হাঁটতে হতো তাকে। ফলে সেখানে আর গানের তালিমের ব্যবস্থা করতে পারেননি মা-বাবা।
তাতে কী? কিশোরী গীতা নিজের মতো করে চর্চা করে যেতেন। আর তাতেই একদিন হঠাৎ পণ্ডিত হনুমান
প্রসাদের নজরে পড়ে যান।
মুম্বাইয়ে তাঁদের বাড়ির নিচতলায়
বা আশেপাশের বাড়িতে ছিলো সঙ্গীত শিক্ষার স্কুল। সেখানে একদিন আসেন পণ্ডিত হনুমান প্রসাদ।
তাঁর কানে ভেসে আসে সুমধুর সুর। বাড়ির বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করেন গানের উৎস সম্পর্কে।
তারপর “ভক্ত প্রহ্লাদ” ছবিতে মাত্র দুই লাইন গান করার প্রস্তাব দেন হনুমান প্রসাদ ষোড়শী
গীতাকে। সালটা ছিলো ১৯৪৬। সেই থেকে শুরু। বাকিটা ইতিহাস...
গীতা দত্তের নামের আগে জুতসই
বিশেষণ পাওয়া মুশকিল। যেমন মুশকিলে পড়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। “হারানো সুর” সিনেমার
গান করছেন তিনি। সুচিত্রা মানেই তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। “তুমি যে আমার” গানটি
রেকর্ড হবে। সবাই সন্ধ্যাজীর কথাই বলছিলেন। কিন্তু সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপ্যাধায়
ভাবছিলেন অন্য কথা। তিনি স্থির করতে পারছিলেন না কার কন্ঠে এমন বিরহের ভালো মানাবে।
অতঃপর ভাবলেন, গীতা দত্তের কন্ঠেই এ গান ভালো মানাবে।
সিদ্ধান্ত হলো, গীতা দত্তই গাইবেন
এ গান। মুম্বাই গিয়ে গানের রেকর্ডিং করা হলো। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। আজও সুচিত্রা
সেনকে নিয়ে কোনো লেখা বা প্রতিবেদন তৈরি করতে গেলে এই গানের উল্লেখ স্বাভাবিকভাবেই
এসে পড়ে। যেনো অন্তরের গভীর থেকে সুচিত্রাই গাইছেন।
পদ্মা পাড়ের কন্যা থেকে মুম্বাই
চলচ্চিত্র জগতে- সেরা নেপথ্য গায়িকার তকমাটা গীতা দত্তের নামের আগে যোগ হয়েছিলো লতা
মুঙ্গেশকরেরও আগে। তাঁর স্বরযন্ত্রটা আসলে ঈশ্বরের নিজের তৈরি মোহনবাঁশি। তার সঙ্গে
ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তাই তাঁর সুরে রোম্যান্স, উৎসব, যন্ত্রণা, ছলনা - সবকিছু অমন তীব্র ভাবে বেজে
উঠতো। কিন্তু সেই সাধারণের চাইতে বেশি অনুভব করতে পারাটাই তাঁর কাল হলো। নায়ক-পরিচালক
গুরু দত্তের ঘরণী হলেন। কিন্তু সব পেয়েও কেনো জীবন যন্ত্রণাদায়ক মর্মান্তিক মৃত্যু
অপেক্ষা করেছিলো গীতা দত্তের জন্য? সে কথায় পরে আসছি…
“ভক্ত প্রহ্লাদ” ছবিতে তার গান
শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন বাংলা থেকে গিয়ে মুম্বাইয়ে থিতু হওয়া আরেক কিংবদন্তী সংগীত পরিচালক
শচীন দেব বর্মন। “দো ভাই” ছবির প্রধান গায়িকা করেন তিনি গীতাকে। শোনা যায়, অনেকে নিষেধ করেছিলেন
তাঁকে। কিন্তু শচীনকর্তা টের পেয়েছিলেন “মেরা সুন্দর সপনা বিত গ্যয়া”-র মতো বুকভাঙা
আর্তি স্রেফ ওই কিশোরীর হৃদয় থেকেই বেরোতে পারে। গান শুনে চমকে উঠেছিল মুম্বাই তথা
পুরো ভারত। কে এই গায়িকা?
১৯৫০ এর দশকে গীতা দত্ত ও লতা
মুঙ্গেশকর দুই প্রধান নেপথ্য গায়িকা ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে হিন্দি গান ছাড়াও গীতা দত্ত
গুজরাটি ভাষার বিখ্যাত সুরকার অবিনাশ ব্যাসের সুরে গান গেয়েছেন। ১৯৬০ এর দশকে বাংলা ছবি ও সংগীতের স্বর্ণযুগ
চলছিল। এসময় সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে বাংলা গানে কণ্ঠ দেন গীতা দত্ত।
বাংলা গানে মায়াবী কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হন বাংলা সিনেমার দর্শকরা। মুম্বাইয়েও সুরাইয়া,
নুরজাহান পরবর্তীতে সংগীত শিল্পীদের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করেন তিনি। নেপালী চলচ্চিত্র
“মৈতিঘর”-এও নেপথ্য শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন গীতা দত্ত।
গীতার বয়স যখন আঠারো তখনই তিনি
বিরাট স্টার। ১৮ বছর বয়সেই তিনি নানা ভাষায় প্রায় ৯ শতাধিক গান গেয়ে ফেলেছিলেন। সর্বশেষ
হিন্দিতে প্রায় ১২ শতাধিক গানে কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশি বাংলা, মারাঠি, গুজরাটি, মৈথিলি,
পাঞ্জাবী ভাষায় গান করেছেন- যার প্রায় সব গানই কালজয়ী। ভারতীয় উপমহাদেশের সনামধন্য
এই শিল্পীর আদিনিবাস ও জন্মস্থান বৃহত্তর ফরিদপুরের শরীয়তপুরে হলেও এখানকার তরুণ প্রজন্মের
অধিকাংশই চেনেন না তাকে। অথচ তার গান খুব জনপ্রিয়।
১৯৪৭ সালে মেট্রিক পাস করেন গীতা
দত্ত । ঐ বছরই নেপথ্য গায়িকা হিসেবে “দো ভাই” ছবির হিন্দি গানে গীতা রায়ের কণ্ঠে জাদু ফুটিয়ে তোলেন শচীনদেব
বর্মণ। ছবির জগতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে জায়গা
করে নেন গীতা। গীতা দত্তের বাঙালি লোক-টানকে শৈল্পীক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শচীনদেব
বর্মণ “দেবদাস”-(১৯৫৫) ও “পিয়াসা”-(১৯৫৭) ছবিতে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে জনপ্রিয়তার
শিখর ছুঁয়ে ফেলেন গীতা দত্ত। আর সেই গানের ছায়াপথ ধরেই জীবনে আসেন নায়ক, গুরু দত্ত।
মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগৎ অবশ্য এসব বাদ দিয়ে গীতা দত্তের অবিশ্বাস্য সঙ্গীত-প্রতিভারই
প্রাধান্য দিতো।
সদা লাস্যময়ী গীতার গায়ের রঙ
টুকটুকে লাল হওয়ায় ছোটো ভাইরা ‘রাঙাদি’ ডাকতো গীতাকে। সুন্দর ও মায়াবী চেহারার গীতা
রায় চৌধুরী চলচ্চিত্রে গান রেকর্ড করতে গিয়ে প্রেমের সম্পের্কে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন
নায়ক ও উঠতি পরিচালক গুরু দত্তের সাথে। ১৯৫৩ সালের ২৩ শে মে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ
হন। কিন্তু তাদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়নি। ১৯৫৭ সালে “গৌরী” ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে
‘ওয়াহিদা রেহমানের’ সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন গুরু দত্ত। এই সম্পর্ক মানতে
না পেরে ২৭ বছর বয়সী গীতা দত্ত ডুবে যান মদ্যপানে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ক্রমশ অসুস্থ
হয়ে পড়েন গীতা। জীবনে নেমে আসে আর্থিক সংকট। এভাবে পেরিয়ে যায় কয়েক বছর। ১৯৬৪ সালের
১০ অক্টোবর গুরু দত্ত আত্মহত্যা করেন। গীতা দত্তের আর্থিক সমস্যা আরও মারাত্মক আকার
ধারণ করে।
শচীন দেববর্মন একটি গান গীতা
দত্তকে দিয়ে গাওয়ার পরিকল্পনা করে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু
গীতা তখন গুরুতর অসুস্থ। সেই
গান আর গীতা দত্তকে দিয়ে গাওয়াতে পারলেন না তিনি। অবশেষে অনেকদিন পর নিজের কন্ঠেই রেকর্ড
করলেন এই ঐতিহাসিক গানটিঃ
"বাঁশি শুনে আর কাজ নাই…
সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি”
ততোদিনে বাঁশি ভেঙে গেছে গীতার।
লিভার সিরোসিসে আক্তান্ত হয়ে
১৯৭২ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৪১ বছর ৮ মাস বয়সে তিন সন্তান- তরুণ কুমার দত্ত, অরুণ কুমার
দত্ত, নীনা দত্ত ও অগনিত ভক্ত অনুরাগীকে কাঁদিয়ে মুম্বাইয়ের হরকিষণ দাস হাসপাতালে মৃত্যুবরণ
করেন গীতা দত্ত।
বিখ্যাত এই সংগীত শিল্পীর স্বীকৃতি
স্বরূপ ২০১৩ সালে ও ২০১৬ সালে তার নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে ভারত সরকার।
গীতা দত্তসহ সারাদেশের সাংস্কৃতিক
অঙ্গনের মানুষদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় আমরা আমাদের বিশ্বজয় করা কৃতী সন্তানদের
চিনি না। গীতা দত্তের মতো হাজারো গুণী মানুষকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কেউ না চেনায় আমরা
আমাদের শেকড়কে হারিয়ে ফেলতে বসেছি। কোনো জাতি তার শিকড়কে বাদ দিয়ে সম্মানিত হতে পারে
না। বাঙালির শেকড়কে নিজ দেশসহ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সরকারিভাবে উদ্যোগে নেয়া উচিৎ । তবেই
গীতা দত্তদের মতো গুনীদের কদর করতে জানবে জাতি।