নুরজাহান ও লতা মুঙ্গেশকরের মধ্যকার সম্পর্ক যেমন ছিলো

 
নুরজাহান ও লতা মুঙ্গেশকর


উপমহাদেশের সংগীতপ্রেমী সকলেই জানেন, ভারতীয় সংগীত জগতে লতা মুঙ্গেশকর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার সমতূল্য এখনো কেউ হয়ে ওঠেনি। কিন্ত অনেকেই হয়তো জানেন না, লতা ঙ্গেশকরের সংগীত জীবনের প্রথম দিকে তার একমাত্র রোল মডেল ছিলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি গায়িকা অন্যতম সেরা জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী কোকিককন্ঠী নুরজাহান। মেহেদী হাসানকেও তিনি অনেক পছন্দ ও সম্মান করতেন। তবে আজকের প্রসংগ নুরজাহান ও লতা মুঙ্গেশকরের মধ্যকার মধুর সম্পর্ক নিয়ে।

 

নুরজাহান ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সনামধন্য নায়িকা ও গায়িকা। কিন্তু দেশ ভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে পাকাপাকি ভাবে নিজের পরবর্তী কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। পাকিস্তানে গিয়েও একটি বা দুটি সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন নুরজাহান।

 

লতা মঙ্গেশকর নুরজাহানের চাইতে বছর তিনেকের ছোট ছিলেন। নুরজাহান জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর। লতা মুঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লতা মঙ্গেশকর নিজেই জানিয়েছিলেন; বলতে দ্বীধা নেই, প্রত্যেকের যেমন রোল মডেল থাকে, আমার আদর্শ ছিলেন নুরজাহান। ছোটবেলা থেকে ওর গান শুনে বড় হয়েছি। ওর গানের নোট মনে গেঁথে গিয়েছিলো।

 

লতা মঙ্গেশকর আরো জানিয়েছিলেন, ১৯৪৪ সালে যখন তার বয়স ১৪ কি ১৫ বছর সে সময় নুরজাহানের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সে সময় ‘প্রফুল পিকচারস’ নামে একটা প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে একটা হিন্দি ছবি তৈরি হচ্ছিলো,- ছবিটির নাম ছিলো ‘বড়ি মা’। ছবিটিতে অন্যতম প্রধান চরিত্রে ছিলেন নুরজাহান। পাশাপাশি একটি ছোট্ট রোলে অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর। ছবিতে তার দুটি গানও ছিলো। সেই ছবির সেটেই লতা মঙ্গেশকরের সাথে নুরজাহানের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

 

নুরজাহানের সাথে লতা মুঙ্গেশকরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ছবির প্রযোজক। তিনি নুরজাহানকে বলেছিলেন, ‘মেয়েটি আমাদের ছবিতে দুটি সুন্দর গান গেয়েছে’। সঙ্গে সঙ্গে নুরজাহান বললেন, একটু শোনাও বেটা। লতা মুঙ্গেশকর একটি হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল শুনিয়ে দিলেন- রাগ জয় জয়ন্তী। গান শেষ হবার পর নুরজাহান বললেন, এবার একটা হিন্দি ছবির গান শোনাও। সে সময় একটা বিখ্যাত হিন্দি ছবি ছিলো “অপাজ"(Wapas-1943)। লতা মঙ্গেশকর 'ইন্দ্রানী রায়ের' গাওয়া সেই সিনেমার একটি বিখ্যাত গান শুনিয়ে দিলেন। গানটি ছিলো “জীবন হ্যায় বেকার বিনা তুমহারে”। নুরজাহান মন্ত্রমুগ্ধ! ধীরে ধীরে তিনি বললেন, ‘ইউ সিং ভেরি ওয়েল মাই চাইল্ড। ট্রাই টু লার্ণ ক্লাসিক্যাল মিউজিক এন্ড প্র্যাকটিস। প্র্যাকটিস ইজ এসেনশিয়াল’।





এরপর থেকেই দুর্লভ এক বন্ধুত্ব এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে নুরজাহান ও লতা মঙ্গেশকরের মধ্যে। লতা মুঙ্গেশকর যখন পরিচালক মেহবুবের “আন্দাজ”(Andaz-1949) ছবিতে নায়িকা নার্গিসের লিপে “তোর দিয়া দিল মেরা” গানটি গাইলেন, তখন সমালোচকরা বললেন; ‘লতাজি গ্রেটলী ইনফ্লুয়েন্সড বাই নুরজাহান’। কারণ তিনি নুরজাহানের মতোই গানটি নিচু স্বরে গেয়েছিলেন।

 

পরবর্তীকালে লতা মুঙ্গেশকর অবশ্য তার নিজস্ব গায়কীতে, নিজস্ব স্টাইলে হিন্দি গানের জগৎ তথা বম্বে(হালের মুম্বাই) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি শাসন করেছেন। কিন্তু একথা ঠিক যে, প্রথম দিকে তিনি নুরজাহানের মতো শিল্পীর দ্বারাই ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার অন্যতম একটা কারণও ছিলো। আর তা হচ্ছে তাদের মধ্যকার সুমধুর বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বে বড় ছেদ পড়লো ১৯৪৭ সালে। দেশ স্বাধীন হলো, দেশ ভাগ হলো, নুরজাহান চলে গেলেন পাকিস্তানের করাচিতে। অচিরেই তিনি যেমন হয়ে উঠলেন ‘ভয়েজ অফ পাকিস্তান’। তেমনি লতা মঙ্গেশকরও ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন ‘ভয়েজ অব ইন্ডিয়া’। দুই বন্ধু দুই দেশের সেরা দুই গায়িকা।

 

সিনেমার গান ছাড়াও লতা মঙ্গেশকর গাইলেন অসাধারণ সব দেশপ্রেমের গান। ‘বন্দে মাতরম’ ‘এয়ঁ মেরে ওয়াতান কি লোগো’। তেমনি কাঁটাতারের ওপারে নুরজাহানও গাইলেন পাকিস্তানের হয়ে দেশপ্রেমের অসাধারণ গান। ভারত পাকিস্তানের গান, উভয় দেশের দেশপ্রেমের গান, দুজনেই নিজের নিজের দেশের জন্য গাইলেও তাদের মধ্যে কিন্তু বিন্দুমাত্র অনাস্থা ছিলো না। ছিলো না কোন দ্বন্দ্ব বা দূরত্ব।

 

এ প্রসংগে লতা মঙ্গেশকর পাকিস্তানের ‘দ্য ডন’ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে খুব সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি দেশ কে লিয়ে গানা হো তো মুঝে লাগতা হ্যায় কি, হর সিঙ্গার কা ফরজ বানতা হ্যেয়’। অর্থাৎ ‘আমার মনে হয় নিজের দেশের জন্য গান করা প্রত্যেক শিল্পীর একটি দায়িত্ব বা কর্তব্য’।

 

সম্ভবত সময়টা ছিল ১৯৫১ সাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পরে কাঁটাতারের ওপারে এমন একটা অন্যরকম ঘটনা ঘটলো, যা আমাদের সবাইকে বুঝিয়ে দিলো যে, লতা মঙ্গেশকর এবং নুরজাহানের মধ্যে কি অসাধারণ বন্ধুত্ব ছিলো। সেসময় অমৃতসরে লতা মুঙ্গেশকরের একটা হিন্দি ছবির কাজ চলছিলো। ছবির কাজ করতে করতেই লতা মুঙ্গেশকরের মনে হলো, অমৃতসর থেকে লাহোর তো বেশি দূরে নয়। এখানে অর্থাৎ লাহোর শহরেই থাকেন তার প্রিয় বন্ধু নুরজাহান। তিনি নুরজাহানকে ফোন করলেন। আর ফোনে কথা বলতে বলতেই নুরজাহানের সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য তার মন ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠলো। যেভাবেই হোক, শুধু একবার তিনি নুরজাহানের সাথে দেখা করতে চান।

 

কিন্তু দেখা করতে চাইলেই তো তা তখন অতো সহজ নয়। তার জন্য চাই পাসপোর্ট, চাই ভিসা, আরো কতো কি লিগাল ফর্মালিটিস। এসবের জন্য তো সময়ের দরকার। কিন্তু লতা মুঙ্গেশকরের ইচ্ছে, তিনি তখনই দেখা করবেন। একবার, শুধু একবার যেভাবেই হোক দেখা করবেন। এই ইমোশনাল সিচুয়েশনে এগিয়ে এলেন বন্ধু ও সিনেমারটির সংগীত পরিচালক সি রামচন্দ্র। নিজস্ব যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা অভুতপূর্ব বন্দোবস্ত করলেন তিনি। সদ্য ভাগ হওয়া ভারত পাকিস্তান, এই দুই দেশকে বিব্রত না করে তিনি কাঁটাতারের ওপারে নোম্যান্সল্যান্ডে এই দুই দেশের দুই কিংবদন্তি শিল্পীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন।

 

নোম্যান্সল্যান্ডে সেই সাক্ষাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে, সি রামচন্দ্র তার জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন; “লতাকে দেখে নুরজাহান ছুটে আসেন। জড়িয়ে ধরেন একে অপরকে। যেনো বহুদিন বিচ্ছিন্ন দুই বন্ধুর মেলবন্ধন। আবেগে অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে যান দু’জনেই”। রামচন্দ্র লিখেছেনঃ

“ওঁরা ছাড়াও অকুস্থলে উপস্থিত সকলেই ঐ দৃশ্য দেখে নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারেননি। এমনকি দু’দেশের সেনাদেরও চোখ ভিজে গিয়েছিলো আবেগে”।

 




সময় যেনো থমকে যায়। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হন দু’জন। ফের শুরু হয় গল্পগাঁথা। সি রামচন্দ্রের কথায়ঃ

“আমরা মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরাও লাহোর থেকে এনেছিলেন। নুরজাহানের স্বামীও ছিলেন সেখানে। সেই স্মৃতি ভুলবো না”।

 

আক্ষরিক অর্থেই যেন সেইদিন সীমান্তের কাঁটাতার চৌচির হয়ে গিয়েছিলো দুই নক্ষত্রের ছটায়। কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে ফের নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যান লতা মুঙ্গেশকর ও নুরজাহান।

 

‘কেনো জানিনা নোম্যান্সল্যান্ডে এই সাক্ষাৎকারের কথা শুনলেই মনে পড়ে যায় একটি বিখ্যাত গল্পের কথা। গল্পটির নাম “টোবাটেক সিং” যেখানে দেখা যায়, ভারত পাকিস্তানের কাঁটাতারের মাঝখানে ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ নামহীন জমির উপর মুখ থুবরে মৃত্যুবরণ করছে বিশান সিং - যিনি ঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন। নিজের গ্রাম ‘টোবাটেক সিং’-এ ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। দেশভাগের ঘটনা এবং রাষ্ট্রের মানবতাবিরোধী নীতিকে তীব্র ব্যঙ্গ করে শ্লেষাত্বক ও আক্রমণাত্মক ভাষায় এই গল্পটির লেখক ছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক সাদাত হাসান মানটু।

 

লতা মুঙ্গেশকর আর নুরজাহানের সাক্ষাৎকার দেশের সীমানা পেরিয়ে যে ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ হলো, দেশভাগের ফলে। কাঁটাতারের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু শেষ পর্যন্ত যে নো ম্যানস ল্যান্ডে মিলিত হলেন; সেই নোম্যান্সল্যান্ড কথাটি শুনলেই আমাদের মনে পড়ে যায় সাদাত হাসান মান্টুর “টোবাটেক সিং” গল্পটির কথা। আর মনে পড়ে যায়, কি দুঃসহ বেদনা নিয়ে নিজের ধরবাড়ি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হয়েছিলো সাধারণ মানুষকে- শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে।

 

সুর আর কন্ঠের অনবদ্য মিশেলে লতা মঙ্গেশকর যেমন হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ‘নাইটিঙ্গেল’। তেমনি নুরজাহানও হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানের “মালিকা-ই-তারান্নুম”- বা “সুরের রাণী”।  সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া তাদের সেই অপরূপ মাধুর্যপূর্ণ কন্ঠ শিল্পকে কখনোই ভাগ করতে পারেনি। বিদ্বেষ বিভাজনকে অতিক্রম করে, ভালোবাসা আর সৌজন্যতার বন্ধন কাঁটাতারের বেড়াকে সেদিন কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর আর নুরজাহান।

 

তার বহুদিন পরে ১৯৮২ সালে কনসার্ট উপলক্ষে মুম্বাই এসেছিলেন নুরজাহান। সেই অনুষ্ঠানে লতা মঙ্গেশকরও পারফর্ম করেছিলেন। আবার প্রমাণিত হয়েছিলো, শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতের মতো বৌদ্ধিক ক্ষেত্রগুলি কখনোই বিভাজিত হয় না। সেখানে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই।



 




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url