আম্রপালি আমের নামকরণের ইতিহাস
একজন প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যশিল্পীর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছিলো "আম্রপালি" আমের
ছবিঃ সংগ্রীহিত |
দেশে পাওয়া জাতগুলির মধ্যে “আম্রপালি” আম বেশ জনপ্রিয় এবং ব্যতিক্রমী
স্বাদের কারণে এটি আমের রাণী হিসেবে পরিচিত। এই আম্রপালি জাতের আমের নামকরণের একটি
মজার ইতিহাস রয়েছে।
কৃষিবিদ এবং ঐতিহাসিকদের মতে, আম্রপালির নামকরণ করা হয়েছিলো একজন
প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যশিল্পীর নামে। তার সম্মানে এই নামটি বেছে নেওয়া হয়েছি্লো।
নৃত্যশিল্পী আম্রপালির জন্মবৃত্তান্ত, পিতামাতা এবং প্রাথমিক জীবনের
কোনো সঠিক রেকর্ড নেই। জানা যায়, প্রায় ২৫০০ বছর আগে প্রাচীন ভারতে বৈশালী নামে একটি
রাজ্য ছিলো। তাকে বৈশালীর রাজকীয় বাগানে একটি আম গাছের নীচে কুড়িয়ে পান মহানমন নামের
এক ব্যক্তি।
আম গাছের নিচে পাওয়ায় তার নাম দেয়া হয়েছিলো আম্রপালি। আম্বাপালি বা
অম্বিকা নামেও তাকে ডাকা হতো। প্রায় ১৫০০ বছর আগে তার “কিংবদন্তি জাতক কাহিনীতে” লেখা
হয়েছিলো, দুটি শিকড় থেকে নামটি এসেছে; "আম্র" (অর্থাৎ আম) এবং "পল্লব"
(অর্থাৎ ছোট অঙ্কুর বা পাতা)।
তিনি ছিলেন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিতেই
আম্রপালিকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। দেশ-বিদেশের রাজা- রাজপুত্র সহ সাধারণ মানুষ তাকে পেতে
‘পাগল’ প্রায়। এ নিয়ে আম্রপালির পালক বাবা–মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তখন বৈশালীর সকল
ক্ষমতাবান ও ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন যে, আম্রপালিকে
কেউ বিয়ে করতে পারবে না। সে হবে একজন “নগরবধু”! সোজা বাংলায় পতিতা।
ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে বলে
আর কোনো তথ্য জানা যায়নি।
প্রাচীন ভারতের ‘মগধ রাজ্যের’ রাজা ছিলেন “বিম্বিসার”। নর্তকীদের নাচের
অনুষ্ঠানে তিনি এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, ‘এ নর্তকী বিশ্বাসেরা। তখন তার একজন
সভাসদ বলেন, মহারাজ এ নর্তকী আম্রপালির নখের
যোগ্যও নয়। তিনি তার সেই সভাসদের থেকে আম্রপালি
সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাবার বাসনা করেন। কিন্তু তার সভাসদ বলেন, তাহলে
আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে।
রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন, ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালিকে দেখে
আসবেন। দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে ওঠেন, এতো কোনো মানবী নয়, যেন সাক্ষাৎ পরী। কিন্তু যেভাবেই হোক, প্রথম দেখাতেই আম্রপালি তাকে
মগধ রাজ্যের রাজা বলে চিনে ফেলেন। বিম্বিসার জানান, তিনি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন
বহু আগে থেকেই। কিন্তু আম্রপালি জানান, তার রাজ্যের মানুষ কখনোই এটা মেনে নেবে না।
আম্রপালি তার নিজের রাজ্যর কোনো ক্ষতি হোক তা চান না। তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে
ফিরে যেতে বলেন।
এদিকে বিম্বিসারের সন্তান ‘অজাতশত্রু’ও আম্রপালির প্রেমে মগ্ন ছিলেন।
তিনি আম্রপালিকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন, কিন্তু দখল করতে ব্যার্থ
হন এবং খুব বাজে ভাবে আহত হন।
কথিত আছে, এক সময় গৌতম বুদ্ধ তার কয়েকশ সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে আসেন।
একদিন বৈশালী রাজ্যের রাবান্দা থেকে এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসী “শ্রমণ”কে দেখে আম্রপালির
মনে ধরে যায়। তিনি সেই সন্ন্যাসীকে চার মাস তার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে অনুরোধ
করেন। সবাই ভেবেছিলেন গৌতম বুদ্ধ কখনোই এতে রাজি হবে্ন না। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ তাকে
রাখতে রাজি হলেন এবং এটাও বললেন, সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি
নিশ্চিত!
চার মাস শেষ হলে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আম্রপালির রূপের কাছে
শ্রমণ হেরে গেলেন কি না তা জানার জন্য? কিন্তু না, সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ
ফিরে আসেন। আম্রপালি তখন বুদ্ধকে বলেন, এই প্রথম কোনো পুরুষকে তিনি বশ করতে ব্যর্থ
হয়েছেন। এরপর সব কিছু দান করে বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত
সেই রমণী আম্রপালি।
১৯৭৮ সালে ভারতীয় আম গবেষকরা ‘দশোহরি’ ও ‘নীলুম’ এই দুই জাতের আমের
মধ্যে শংকরায়নের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন। সুডৌল আকৃতি, মসৃণ ত্বক এবং
দেখতে সুন্দর আমটিকে তারা নৃত্যশিল্পী আম্রপালির সম্মানে নামকরণ করেন “আম্রপালি”।