কাফের বানানোর এক্স-রে মেশিন এবং শিয়া সুন্নি বিভাজন প্রসংগ

 

কাফের ঘোষণা প্রসংগে

আমাদের দেশে এক ধরণের আজগুবি ‘এক্স-রে মেশিনের’ প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। যে কাউকে সেই মেশিনে ফেলে দিলেই কাফের হয়ে বেরিয়ে আসে! দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে এর ব্যাপ্তি বিদেশেও ছড়িয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এই এক্স-রে মেশিনে আজ পর্যন্ত যতোজন কাফের হয়ে বেরিয়েছে তারা একজনও ধর্মে অবিশ্বাসী না এবং সবাই একই ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আমাদের যদি হাশরের মাঠে আল্লাহ জিজ্ঞেস করেন যে, তুমি যে অমুক অমুককে কাফের ঘোষণা দিয়েছিলে, সেটা এখন প্রমাণ করো!

 

কথায় কথায় কাফের বা নাস্তিক বলা এখন অনেক প্রখ্যাত আলেম বা মুহাদ্দিস-মুফাসসিরদের মধ্যে সংক্রমিত! ওয়াজের মাঠের মূল আলোচ্য বিষয় থাকে কে সঠিক, কে বেঠিক! মিজানুর রহমান আজহারী, আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, হাফিজুর রহমান কুয়াকাটা, জাকির নায়েক- এমনকি শিয়া হওয়ার কারণে ইরানের অনেক ধর্মীয় নেতাকেও আমাদের অনেক আলেম কাফের বলেন। সর্বশেষ কিছুদিন আগে হেলিকপ্টার দূর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকেও কাফের ঘোষণা করেছেন আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত আলেম।

 

শিয়া-সুন্নি প্রসংগ 

শিয়া-সুন্নী মতাদর্শগত পার্থক্যের ঐতিহাসিক কারণ খুঁজতে প্রথমেই পরিষ্কার করতে চাই যে, এই নিবন্ধ ধর্ম বিশেষজ্ঞ বা বিশারদ হিসেবে লিখছি না। এই লেখা কোনো ধর্মীয় পরামর্শ, ফতোয়া বা সিদ্ধান্ত নয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মতামত সম্বলিত অনেক লেখা এবং অসংখ্য ভিডিও অনলাইন-ইউটিউবে পাবেন। আমরা এই আলোচনা করছি একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে।

 

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন- ‘ভাই আপনিতো আলেম বা মুহাদ্দদিস না। ধর্মের ব্যাপারে আপনি কি জানেন বা বোঝেন? আপনি কেনো ধর্ম নিয়ে কথা বলছেন’? তাদেরকে বলতে চাই- ‘আমাদের জন্য কি নামাজ রোজা মাফ? জাকির নায়েককে নিয়েও এমন প্রশ্ন তোলেন অনেক ওয়ায়েজিন যে, ‘তিনি ডাক্তার মানুষ, তিনি কেনো ধর্ম নিয়ে কথা বলেন’? ‘ডাক্তাররা কি বিনা হিসেবে বেহেশতে বা দোজখে যাবে? নাকি ধর্মের বিধিনিষেধ তাদেরও মানতে হবে’?

 

তো আমাদের মতো সাধারণ মুসলমানদেরও যেহেতু ধর্মের রীতি-রেওয়াজ মানতে হয়, সেহেতু আমাদেরও অবশ্যই কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে এবং আশাকরি এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে, সেসব প্রশ্নের উত্তর খোজার অধিকারও আমাদের আছে।

 

শিয়া-সুন্নি এবং প্রতিটি ধর্মমত বা বিশ্বাসের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি; কাউকে সঠিক বা ভ্রান্ত প্রমাণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদেশ্য সঠিকটা জানা। কারো কোনো মতামত বা পরামর্শ থাকলে দয়াকরে কমেন্টে জানাবেন।

 

আমরা যেমন শিয়াদের কাফের বলছি, শিয়ারাও অনেকে আবার সুন্নিদের কাফের বলে। আমরা নিজেরাই যেখানে একদল আরেকদলকে কাফের ঘোষণা দিচ্ছি, সেখানে শিয়াদের তো আমরা মুসলমানই মনে করি না!

 

শিয়া কেনো, কারো সম্পর্কেই এমন মন্তব্য করার অধিকার কারো নেই। আত্মস্বীকৃত নাস্তিক ছাড়া কাউকে নাস্তিক বা কাফের বলার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। এ ফয়সালা একমাত্র শেষ বিচার দিনে। এই ফয়সালা করার অধিকার একমাত্র আল্লার যিনি বিচার দিনের অধিপতি।

 

“নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদী হয়েছে, যারা সাবিয়ী, খৃষ্টান, অগ্নিপুজক এবং যারা মুশরিক – কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের উপর স্বাক্ষী”- (সুরা হাজ্বঃ আয়াত-১৭)।

 

সুতরাং আল্লাহ সকলের ভিতরের বাইরের খবর জানেন। তিনিই বিচার দিনে যার যার কর্মফল বন্টন করবেন। আমরা কেবল কে কি বুঝলাম সেকথা বলতে পারি। সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহর।

 

আমাদের অনেক বিজ্ঞ আলেমই শিয়াদেরকে কাফের মনে করেন, এমনকি তাদের সাথে ছেলেমেয়ের বিয়েকেও বৈধ মনে করেন না। আশা করি আলেমরা এমন সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। যদিও আল্লাহ পূর্ববর্তী কিতাবপ্রাপ্ত নারীদেরকেও বিয়ে করা হালাল করেছেন।

 

“আজ তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুগুলী হালাল করা হলো। আহলে কিতাবের যবাহকৃত জীবও তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের যবাহকৃত জীবও তাদের জন্য হালাল। আর সতী সাধ্বী মুসলিম নারীরাও এবং তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাবের মধ্যকার সতী-সাধ্বী নারীরাও”- (সুরা মায়িদাঃ আয়াত-৫)।

 

তবে শিয়াদের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আমাদের সুন্নিদের মধ্যে বহুল প্রচলিত কিছু ধারনা আছে। যেমন; শিয়ারা হযরত আলী(রাঃ)কে প্রকৃত নবী মনে করে। জিব্রাইল(আঃ) ভুলবশতঃ নবীজির কাছে ওহী নিয়ে গিয়েছিলেন! তাছাড়া তারা আমাদের কোরআনকে বিকৃত মনে করে। হযরত আবু বক্কর(রাঃ), ওমর(রাঃ), ওসমান(রাঃ) সহ বেশিরভাগ সাহাবীকে গালাগালি দেয় ইত্যাদি।

 

শিয়াদের মধ্যে একদল এমন আছে, তবে এরা একান্তই অশিক্ষিত মূর্খ শ্রেণীর। কোনো স্বীকৃত গবেষণা বা প্রকাশনা থেকে এধরণের বিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায় না। মূলধারার শিয়ারা কলেমার সাথে ‘আলী অলিউল্লা’ পড়ে এবং আযান ইকামতে ‘আসহাদুয়ান্না আলী অলিউল্লাহ’ বলে। তাদের কোরআন ৯০ পারা বলে যে ধারণা আমাদের মধ্যে প্রচলিত তা হচ্ছে, মূল কুরআনের সাথে ‘পাদটীকা’ হিসাবে জুড়ে দেয়া কুরআনের তাফসির যা হযরত আলী(রাঃ) বা আহলে বাইতের কাছে সংরক্ষিত ছিল বলে তারা বিশ্বাস করে।

 

শিয়া মানে দল বা পার্টি। অর্থাৎ শিয়ারা হচ্ছে আলীর দল। শিয়ারা হযরত আলী(রাঃ)কে অনুসরণ করায় সুন্নি বা কোনো মুসলমানের আপত্তি থাকার কথা না। কারণ, হযরত আলী(রাঃ) সকল মুসলিমের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং অনুকরণীয় আদর্শ। কিন্তু বিভাজন হচ্ছে রীতি-নীতি নিয়ে। শিয়ারা আলী(রাঃ), ইমাম হাসান(রাঃ), ইমাম হোসাইন(রাঃ) সহ ১২ জন ইমামে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, কিয়ামত পর্যন্ত এই ১২ জন আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমামত নিয়ে আসবেন- যার শেষ ইমাম হবেন হযরত ইমাম মাহদী(আঃ)। এবং এই ১২ জন ইমাম যুগে যুগে মুসলিম জাহানকে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব দেবেন। আমরা সুন্নিরা এই তত্বে বিশ্বাস করিনা। কেনো করি না সে প্রসংগে আসছিঃ

 

হযরত আলী(রাঃ) সুন্নিদের নিকটও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তি। কিন্তু আমরা হযরত আলী(রাঃ)’র আলাদা রীতি-নীতিতে বিশ্বাস করি না। মাওলা তত্ত্ব বা ঈমাম তত্ত্বের কোনো ধারণা কোরআনে পাওয়া যায় না। কোরআনে সুরা তাহরীমের আয়াত নং ৪-এ মওলা শব্দটি দ্বারা সহায় বা সহায়ক বোঝানো হয়েছে।

 

শিয়াদের এই তত্ত্বের ভিত্তি গাদিরেখুমের ভাষণ। এই গাদিরেখুম শিয়াদের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ যে, এই দিবসকে তারা ‘ঈদুল গাদির’ নামে উদযাপন করে।

 

শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী নবীজি ‘বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে গাদিরেখুম নামক স্থানে যাত্রা বিরতিকালে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন- যেখানে তিনি হযরত আলী(রাঃ)কে তাঁর পরবর্তী ওলী বা মুসলিম জাহানের অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা দেন এবং হযরত আবু বকর(রাঃ), ওমর(রাঃ), ওসমান(রাঃ) সহ সব সাহাবী হজরত আলী(রাঃ)’র হাতে বায়াত গ্রহণ করেন’! শিয়ারা ছাড়াও অলি-আউলিয়া, সুফী তরিকতে বিশ্বাসী ‘আহলে সুন্নাহ ওআল জামাতের’ অনুসারীরাও গাদিরেখুমের হাদীসগুলোকে মাসুরুর মুতাওয়াতির হাদীস বলে গণ্য করে। মাশরুর মুতাওয়াতির হাদিস মানে যা ৩০ জনের বেশি সাহাবী বর্ণনা করেছেন।

 

গাদিরেখুমের একটি হাদিস হলোঃ

“আমি আল্লাহর নিকট হতে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে তোমাদের নিকট কিছু বলবো। আমি অচিরেই আল্লাহর নিকট চলে যাবো। তবে তোমরা যাতে পথভ্রষ্ট না হও সেজন্য তোমাদেরকে কিছু ওছিয়ত করছিঃ আমি তোমাদের নিকট দুটি মূল্যবান সম্পদ রেখে যাচ্ছি- যার ওজন কোনোটি কোনোটির চেয়ে কম নয় এবং এ দুটি সম্পদ থেকে তোমরা কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না। যদি এই দুটি সম্পদ তোমরা আঁকড়ে ধরো তাহলে তোময়া কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; তার প্রথমটি হলো কোরআন, দ্বিতীয়টি হলো আহলে বাইত। আমি দেখতে চাই তোমরা আমার আহলে বাইতের সাথে কি ধরনের আচরণ করো”।

 

আহলে বাইতের একনিষ্ঠ অনুসরণের ক্ষেত্রে শিয়াদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তি হলো সূরা আহযাব এর ৩৩-৩৪ নং আয়াতঃ

 

“…হে নবী পরিবার! আল্লাহ শুধু চান তোমাদের হতে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রাখবে; আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে অবহিত”-(৩৩:৩৩-৩৪)।

 

সুতরাং নবী পরিবার বা আহলে বাইত সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র এবং কোরআনের স্মরণ বা সংরক্ষণকারী। কিন্তু আহলে বাইত বলতে সূরা আহযাবে প্রধানতঃ নবী পত্নীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। এই সুরার ৩২ নং আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে, “হে নবীর পত্নীরা! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও…”। কিন্তু শিয়াদের নির্দেশিকায় নবীজির স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা(রাঃ) এবং হাফসা(রাঃ)কে আহলে বাইত হিসেবে গণ্য করা হয়নি এবং তাদের বর্ণিত কোনো হাদিস তারা গ্রহণ করে না। সুন্নিদের প্রতি আবার শিয়াদের অভিযোগ হলো, সুন্নিদের হাদিস গ্রন্থে হযরত আয়েশা(রাঃ) বা হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ)’র প্রাধান্য। কিন্তু আলী(রাঃ) ফাতেমা(রাঃ)’র থেকে বর্ণিত হাদিস খুবই কম।

 

হযরত আলী(রাঃ) যেমন নবীজির জামাতা, হযরত ওসমান(রাঃ)ও নবীজির দুই মেয়েকে বিয়ে করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এ জন্য তাকে ‘জুন-নুরাইন’ বা দুই নূরের অধিকারী বলা হয়। হযরত আবু বক্কর(রাঃ) এবং হযরত ওমর(রাঃ) ছিলেন নবীজির শ্বশুর। এছাড়া ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় এই তিনজনের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এই তিনজনকে শিয়ারা আহলে বাইত হিসেবে গণ্য করে না বরং অশিক্ষিত শিয়ারা এই তিনজন প্রধান সাহাবী ও খোলাফায়ে রাশেদিনের খলিফা সম্পর্কে অবমাননাকর কথাবার্তাও বলে।

 

শিয়ারা হযরত আলী(রাঃ)কে নবীজির উত্তরাধিকারী বা প্রথম খলিফা হওয়াটাকে প্রাধাণ্য দেয়। কিন্তু গাদিরেখুমের ভাষণকে বিবেচনায় না নিলে নবীজি তার উত্তরাধিকারী বা পরবর্তী খলিফা সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে যাননি। নবীজির ইন্তেকালের পর মুহাজির, আনসারদের মধ্যে নেতৃত্বের দাবিদাওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতায় বয়স ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় হযরত আবু বকর(রাঃ)কে খলিফা নির্বাচিত করা হয়।

 

নবীজির ইন্তেকালের পর ধর্মত্যাগীদের সাথে গৃহযুদ্ধের ভিতর দিয়ে আবু বক্কর(রাঃ)’র দুই বছরের শাসনকাল শেষে তিনি হযরত ওমর(রাঃ)কে তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে প্রস্তাব করেন। হযরত ওমর(রাঃ) প্রায় ১০ বছর মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব দেন। এ সময় মুসলিম জাহানের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। হযরত ওমর(রাঃ) তার অন্তিম সময়ে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি হযরত ওসমান(রাঃ)কে তৃতীয় খলিফা নির্বাচন করে। হিজরী ৩৫ অর্থাৎ ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওসমানের হত্যাকাণ্ডের পর হযরত আলী(রাঃ) চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন।

 

হযরত মুয়াবিয়া হযরত ওমর(রাঃ)’র সময় থেকে সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন।  তিনি দামেস্ক কেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী সামরিক এবং প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তোলেন। হযরত মুয়াবিয়া(রাঃ) উমাইয়া বংশীয় এবং হযরত ওসমান(রাঃ)র আত্মীয়। হযরত ওসমান(রাঃ) হত্যাকাণ্ডের বিচারের কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি হযরত আলী(রাঃ)কে দায়ী করেন এবং খলিফা হিসাবে হযরত আলী(রাঃ)র আনুগত্য মেনে নিতে আপত্তি জানান।

 

হযরত আলী(রাঃ) বিস্তৃত মুসলিম জাহানের প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার সুবিধার্থে রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করেন এবং হযরত মুয়াবিয়াকে তার আনুগত্য মেনে নিতে অনুরোধ করেন। এদিকে হযরত আয়েশা(রাঃ) হযরত ওসমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য হযরত আলীর উপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে একদল সাহাবী সহ কুফা অভিমুখে রওনা দেন। বসরার উপকণ্ঠে হযরত আয়েশা(রাঃ) এবং হযরত আলী(রাঃ)র বাহিনী মুখোমুখি হয়। কথিত আছে যে, হযরত আলী(রাঃ) ও হযরত আয়েশা(রাঃ)’র মধ্যকার শান্তিপূর্ণ আলোচনা চলাকালিন উদ্দেশ্যবাদীরা আক্রমণ করে বসে- যা এক অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধে রূপ নেয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘জঙ্গে জামাল’ বা ‘উষ্ঠীর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

 

হযরত আয়েশা(রাঃ) মদিনায় ফিরে যান। এর পরের বছর অর্থাৎ ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত আলী(রাঃ) এবং হযরত মুয়াবিয়ার বাহিনী সিফফিনে মুখোমুখি হয়। প্রায় তিন মাস শান্তিপূর্ণ আলোচনার পর অতি উৎসাহী একদল আক্রমণ করে বসে এবং আরেকটি রক্তক্ষয়ী ভাতৃ-ঘাতী যুদ্ধের সাক্ষী হলো মুসলিম বিশ্ব! এভাবে মুসলিম বিশ্বে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ, খেলাফত নিয়ে আলোচনা সালিশি নানা প্রচেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত হযরত আলী(রাঃ)’র হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হয়।

 

হযরত আলী(রাঃ)র পর তার পুত্র হযরত ইমাম হাসান(রাঃ)কে কুফাবাসী খলিফা নির্বাচিত করেন। কিন্তু আবারো মুয়াবিয়ার আপত্তি। অবশেষে হযরত হাসান(রাঃ) একটি সমঝোতার ভিত্তিতে মুয়াবিয়ার আনুগত্য মেনে নেন। সমঝোতা ছিলো এই মর্মে যে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর মুসলিম বিশ্ব যাকে নির্বাচিত করবে তিনিই হবেন খলিফা। পরে অবশ্য হযরত হাসান(রাঃ)কে  ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।

 

হযরত মুয়াবিয়া প্রায় দুই দশক মুসলিম বিশ্ব শাসন করেন। তার সময়ে মুসলিম জাহান ঈর্ষণীয় বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। তার সময়ে বাইজেন্টাইন এবং অন্যান্য সেকুলার সাম্রাজ্যের আদলে মুসলিম বিশ্বের আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলেন। তবে তিনি ইসলামের মূলধারা থেকে সরে গিয়েছিলেন।

 

মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর কুফাবাসী হযরত আলী(রাঃ)র অপর পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন(রাঃ)কে খলিফা হিসাবে সমর্থন দেয়। কিন্তু মুয়াবিয়ার অনুসারী সিরিয়ানরা মুয়াবিয়া পুত্র এজিদকে সমর্থন দেয়। হযরত হোসাইন(রাঃ) তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কুফা’র উদ্দেশ্যে রওনা করেন। কিন্তু ইয়াজিদ প্রেরিত সৈন্যরা কারবালার প্রান্তরে তাদের গতিবোধ করে এবং হযরত হোসাইন(রাঃ)কে স্বপরিবারে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে।

 

এই কারবালা ট্রাজেডিই শিয়া সাংস্কৃতিতে তাদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুন্নিদের কাছেও কারবালা ট্র্যাজেডি ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। কিন্তু শিয়ারা বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে শোক পালনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে। কারবালাকে কেন্দ্র করে শিয়াদের মধ্যে কিছু গল্প গাথা প্রচলিত আছে যা সুন্নিরা বিশ্বাস করে না। এমনকি ইসলামের ঐতিহাসিক ধারা বিবরণী বা হাদিসের বর্ণনা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিয়া ও সুন্নিদের নির্বাচন আলাদা।

 

যতো উচ্চতর গবেষণায় নামবেন জটিলতা শুধু বাড়বে! তেহরান ইউনিভার্সিটি, মদিনা ইউনিভার্সিটি এবং আল আজহার ইউনিভার্সিটি- মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস, হাদিস এমনকি কোরআনের বিশ্লেষণ বা তাফসীরের ক্ষেত্রে এর শিক্ষক বা গবেষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য আছে। তেহরান ইউনিভার্সিটি শিয়া মতবাদ, মদিনা ইউনিভার্সিটি ওহাবী বা সালাফি মতবাদ এবং আল আজহার ইউনিভার্সিটি কিছুটা পশ্চিমা বা সেকুলার ধারণা পোষণ করে। কারণ গত কয়েক শতাব্দি মিশর পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপনিবেশ।

 

শিয়া মুসলিমরা তাদের তালিকাভুক্ত আহলে বাইতের হাদিসগুলোকেই মানে। সুন্নিরা সেসব হাদিস জানেও না। শিয়ারা যেমন হযরত আবু বকর(রাঃ), ওমর(রাঃ) ওসমান(রাঃ)কে মেনে নেয় না, তেমনি সুন্নিদের একাংশ- বিশেষ করে ওহাবীরা আহলে বাইতের হাদিসগুলোকে হাদিস বলে গণ্য করে না। শিয়ারা বিশ্বাস করে নবীজি বিদায় হজ্ব ও গাদিরেখুমে কোরআন ও আহলে বাইতের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুন্নিরা বিশ্বাস করে নবীজি বিদায় হজ্বের ভাষণে কোরআন ও তার সুন্নাহ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আর গাদিরেখু্মের ভাষণ বলে কিছু নেই, এটা মিডিয়ার সৃষ্টি!

 

মুসলিমদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত জীবন বিধান হচ্ছে কোরআন। যে কোরআনের শুরুতেই আল্লাহ বলেছেন, “ইহা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোনো সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নাই; ধর্মভীরুদের জন্য এ গ্রন্থ পথনির্দেশ”-(সুরা বাকারাঃ আয়াত-২)। আর সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসাবে অনুমোদন দিলাম”-(সুরা মায়িদাহঃ আয়াত-৩)।

 

সুতরাং কুরআনই মুসলমানদের জন্য সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ ও‌ অনুমোদিত বিধান বা নির্দেশক। কুরআনে শিয়া-সুন্নি, হানাফী, ওয়াহাবি-সালাফী, সৌদি-ইরান-মিশর বা ওয়েস্টার্ন কোনো মতবাদ নাই। কোরআনের বাইরে তাফসীর হাদিস ফিকাহ বা ঐতিহাসিক ধারাভাষ্য সত্য-মিথ্যা, জাল-জয়ীফ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত- যে কোনোকিছুই হতে পারে।

 

বিতর্কিত পীর কথিত সুফি সম্রাট দেওয়ানবাগীও কোরআনের তাফসীর লিখেছেন। ইসলামের ইতিহাসের প্রধান ধারাভাষ্য বা ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বা ফিলিপ কে হিট্টি ছিলেন লেবাননী আমেরিকান এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে খ্রিস্টান। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, বৈরুতে লেখাপড়া করেন। এরপর কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএসডি করেন। তারপর প্রিস্টন হার্ভার্ড এবং জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন।

 

হিট্টি ছাড়াও ইসলামের ইতিহাসবিদদের তালিকায় অমুসলিম বা সেকুলারদেরই প্রাধান্য। সেসব ইতিহাস বা অসমর্থিত ইতিহাস আমরা ধ্রুব সত্য মনে করি। এতোটাই ধ্রুব সত্য মনে করি যে, এর মাধ্যমে আমরা কুরআনের সত্যকেও অগ্রাহ্য করি। এই নিবন্ধকের যতোজন মাদ্রাসা থেকে উচ্চ ডিগ্রীপ্রাপ্ত মৌলানার সাথে কথা হয়েছে, তাদেরকে কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা “হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত- তিনি নবীজিকে বলতে শুনেছেন……”- টাইপের কথা দিয়ে মনের অজান্তেই কোরআনের আয়াতকে ঢাকতে শুরু করেন!

 

কোরআনের সরল পথ ভুলে মুসলমানরা আজ দলে দলে বিভক্ত! অথচ এই কোরআন আরবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রগুলোকে একত্র করে সারা পৃথিবীতে এক অজেয় শক্তিতে পরিণত করেছিলো। তাই সবার উচিৎ হাদিসের আলোকে ঝগড়া-জটিলতায় অবতীর্ণ না হয়ে কোরআনের আলোকে ফয়সালা করা- যাতে কোনো মুসলিমেরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। আল্লাহ বলেছেনঃ

“আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না তারাই তো কাফির”-(সুরা মায়িদাহঃ আয়াত-৪৪)

 






Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url