কোরআন পড়ু্ন, বুঝে পড়ুন - কোরআনের বিধান অনুযায়ী ধর্ম পালন করুন

 

·       “আমি অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কোরআন যাতে তোমরা বুঝতে পারো – সুরা ইউসুফঃ আয়াত-২)”।

·       বল… “আর এই কুরআন আমার নিকট অহীর মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে, যেন আমি তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এটি পৌঁছবে তাদের সকলকে এর দ্বারা সতর্ক করি – (সুরা আনামঃ আয়াত-১৯)”।


কোরআন শরীফের ছবি


ধর্মীয় বিষয়ের আরেকটি নিবন্ধে সকলকে স্বাগতম। আমি আমাদের প্রাত্যহিক ধর্ম চর্চায় আমার কাছে বোধগম্য  নানান অসংগতি নিয়ে কথা বলি। ধর্ম, অ-ধর্ম, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য সামনে আনার চেষ্টা করি এবং পবিত্র কুরআনের আলোকে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। আমার আলোচনা সবার কাছে গ্রহনযোগ্য নাও হতে পারে, আমার আলোচনায় ভুলও থাকতে পারে, আবার আপনিও ভুল বুঝতে পারেন। তাই কারো কাছে ভুল মনে হলে তার সঠিক ব্যাখ্যা মন্তব্য কলামে তুলে ধরলে আমরা আমাদের নিজেদেরকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারবো।

 

এই লেখায় ধর্মের শাখা প্রশাখা, ধর্মের ভুল অনুসরণ ও ধর্মান্ধতা নিয়ে আলোচনা করবোঃ

আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত সবাই ধর্মের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তাদের অনেকেই মূল উৎস থেকে ধর্ম না জানার কারণে বা সত্যের স্বরূপ যাচাই করতে না পারার কারণে বা এর উদ্দেশ্য বুঝতে না পারার কারণে বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী কর্তৃক অনুসৃত যুগযুগ ধরে চলে আসা প্রথায় ধর্মের অন্ধ অনুসরণ করে। ধর্মের নামে তারা যা বোঝায় কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই তা অনুসরণ করে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। যার প্রতিক্রিয়ায় ধর্মের প্রতি অনেকের বিরুপ ধারণাও তৈরি হয়।

 

আমার যেসব অমুসলিম বন্ধুদের সাথে কথা হয়, ইসলাম সম্পর্কে তাদের যতো অভিযোগ তার বেশিরভাগই ধর্মের সাথে সম্পর্কিতই না। কিন্তু অনেক ধর্ম প্রচারক বা ওয়ায়েজিনরা এমনকি মসজিদের ঈমামরাও এর সপক্ষে হাস্যকর যুক্তি উপস্থাপন করে।

 

প্রতিটা ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলো পাঠ করলে এবং এর মূল নীতিগুলো পর্যালোচনা করলে দেখবেন মুক্ত চিন্তা, প্রগতিশীলতা, পরমতসহিষ্ণতা, মানবিক মূল্যবোধের কথা ধর্মগ্রন্থেই সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। কিন্তু যারা ধর্মের দোকান খুলে বসে আছে তারা আপনাকে প্রকৃত সত্য জানতে দেবে না, চিন্তা গবেষণা করতে দেবে না। অথচ স্বয়ং আল্লাহ বলছেনঃ

·       “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম বিচরণশীল প্রাণী হচ্ছে বধির, বোবা, যারা নিজেদের বুদ্ধি বিবেক ব্যবহার করে না-(সুরা আনফালঃ আয়াত-২২)”।

আল্লাহ মানুষকে চিন্তা বা গবেষণার শক্তিসম্পন্ন একটি মস্তিষ্ক দিয়েছেন। যারা এর ব্যবহার করেনা তারা আল্লাহর চোখে শুধু মানুষের মধ্যে নয়, সমগ্র প্রাণীকুলের মধ্যে নিকৃষ্টতম জীব।

 

ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা মানুষকে আত্মঘাতী বোমারু বানাতে পারে। তার মাথায় এমন ভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, ধর্ম নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করা যাবে না। আলেমরা যা বুঝিয়ে দেয় তাই অনুসরণ করতে হবে।

 

আমি হাদিস, ফিকাহ, ইসলামের ইতিহাস, ফাযায়েলে আমল- কোনোকিছুই পড়তে কাউকে নিরুৎসাহিত করি না। দাড়ি-টুপি, হিজাব-নিকাব বা প্রচলিত ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ পালনেও নিরুৎসাহিত করছি না। আমি শুধু তুলনামূলক উদাহরণ দিয়ে আনুপাতিক অগ্রগণ্যতা বোঝানোর চেষ্টা করছি। যেমনঃ

·       তরকারিতে লবণ দিতে হবে এ কথা কে না জানে। কিন্তু এক কেজি মাংস রাঁধতে ৩ কেজি লবণ দিলে সেটা কি মাংস রান্না হবে না লবণ রান্না হবে?

·       স্কুলের বার্ষিক দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন, কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষাতেই অনুপস্থিত। কারণ আপনি সারা বছর দৌড়ের উপরেই ছিলেন। কি লাভ হবে?

অর্থাৎ কোনটা জরুরী, কোনটা অগ্রগণ্য সেটা বুঝতে হবে।

 

আমি কোরআন থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি যাতে নবীজির কথা, কাজ, সিরাত সুন্নতের বিশদ বর্ণনা আছে। এর বাইরে নবীজির নামে কথিত হাদীসকে কোরআন কোন আয়াতের মাধ্যমে অনুমোদন দিয়েছে? কোরআনের সাথে অসংগতিপূর্ণ, অতিরঞ্জিত, সাহাবায়ে আজমাইনদের ইজমা, আলেমদের ফতোয়ার ভিত্তি কি? কুরআনের সাথে সঙ্গতিহীন চিরন্তন শরিয়া আবার কি?

 

কোরআনের বাইরে অতিরিক্ত কোনো নির্দেশনা নবীজির জন্যও যে নাযিল হয়নি তা কোরআন থেকেই স্পষ্ট। সূরা আহযাবের ৫০ নম্বর আয়াতে নবীজির জন্য বিয়ের বিশেষ বিধান দিয়ে বলা হয়েছেঃ

·       “এ বিধান শুধু তোমারই জন্য, অন্য মুমিনদের জন্য নয়-(৩৩:৫০)”। যে বিধান আমাদের জন্য প্রযোজ্যই নয় সেই বিধান সম্পর্কে আমাদের করণীয় কিছু নাই।

 

নবীজির স্ত্রীদের অন্য কেউ বিবাহ না করা বা সাহাবীদের বিনা অনুমতিতে নবীজির গৃহে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা - এসব বিধান ১৪০০ বছর পরে তো প্রাসঙ্গিকই না। কোরআনের বাইরেও যদি ওহী থাকতো তাহলে এ বিষয়গুলো আল্লাহ কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে না দিয়ে শুধু নবীজিকেই তো জানিয়ে দিতে পারতেন।

 

কোরআন নিয়ে যারা গবেষণা করে, কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে যারা কথা বলে তাদেরকে অনেকেই আহলে কোরআন বলে তাচ্ছিল্য করে। আহলে কোরআন আবার কি? কোরআন মানা কি অপরাধ? কেউ যদি কোরআনের অপব্যাখ্যা করে তার কথা আলাদা। আবার বলে ‘আপনি কি হাদিস মানেন না’? হাদিস মানি না কে বলেছে? কোরআন কি হাদিস নয়? পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ

      “আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী(হাদিস) সম্বলিত কিতাব যা সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়-(সুরা যুমারঃ আয়াত-২৩)”।

·       “হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশি সত্যপরায়ন?”-(সূরা নিসাঃ আয়াত ৮৭)”।

 

ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেব “হাদীসের নামে জালিয়াতি” নামে বই লিখে দেখিয়েছেন হাদিস কত প্রকার ও কি কি! হাদিস সহি বা গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রধান শর্ত কি কি?:

(১)   তা কুরআনের বক্তব্যের বিরোধী, ভিন্ন বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারবেনা।

(২)   তা প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণার পরিপন্থী হতে পারবেনা।

এখানে বৈজ্ঞানিক ধারণা বা বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান, প্রমাণিত জ্ঞান।

 

সক্রেটিস, এরিস্টোটল, রবীন্দ্রনাথের দর্শন যদি আমাদের সময়ে অপ্রয়োজনীয় হতো তাহলে আমরা তাদের নামই জানতে পারতাম না। তাদের চিন্তা, দর্শন কালের সীমা ছেড়েছে- কারণ তা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারছি।

 

মার্কেটিং এর জনক ফিলিপ কটলার বলেছেন, মার্কেটিং এর জনক নাকি তিনি নন। মার্কেটিং এর জনক নাকি এরিস্টটল। তার মতে তিনি এরিস্টটলের ধারণাকে যুগ উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন মাত্র।

 

সর্বযুগের জন্য অবতীর্ণ কোরআন কালোতীর্ণ হবে সেদিনই যেদিন কোরআনকে আমরা আমাদের যুগের জ্ঞান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে পারবো। এই ব্যাখ্যা করতে হলে কি করতে হবে? অবশ্যই নিজ ভাষায় কোরআন বুঝতে হবে। লেখার শুরুতে উল্লেখিত পবিত্র কোরআনের আয়াত দুটিতে একথাই প্রমানিত। পবিত্র কোরআন যখন অবতীর্ণ হয় এবং যাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয় অর্থাৎ আমাদের নবীজি(সাঃ) এবং তদ্বঞ্চলীয় লোকজন ছিলেন আরবী ভাষাভাষী। কোরআন যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে, আমরা তো আর আরবী ভাষাভাষী নয়। অতএব, আমাদেরকে কোরআন বুঝতে হবে অবশ্যই আমাদের ভাষায়।

 

অনেকে বলে থাকেন আল্লাহর ভাষা আরবী! কি আশ্চর্যজনক! এরা কি কোরআন পড়ে না? পৃথিবীর সব ভাষা আল্লাহর। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ

·       “এবং তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে-(সুরা রুমঃ আয়াত-২২)”।

অর্থাৎ যারা বলেন আল্লাহর ভাষা আরবী তারা আলেম(জ্ঞানী) নয়, জালেম! অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ

·       “আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য – (সুরা ইব্রাহীমঃ আয়াত-৪)”।

 

আমাদের ভাষায় তো কোনো রাসুল আসেন নাই, কোনো রাসুল আসবেনও না। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি মোহাম্মদ(সাঃ) শেষ নবী। কিন্তু যেহেতু আমরা শেষ নবীর অনুসারী এবং তার মাধ্যমে অবতীর্ণ কোরআনকে আল্লাহর বাণী বলে বিশ্বাস করি; তাহলে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হলে অবশ্যই তার বাণী অনুসরণ করতে হবে। তো সে বাণী বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের বোধগম্য ভাষা অর্থাৎ আমাদের মাতৃভাষায় বুঝতে হবে।

 

অনেকে দাবি করেন, ‘আরবি ভাষা ব্যাকরণ না বুঝলে, আরবি ভাষায় গভীর জ্ঞান না থাকলে কোরআন বোঝা সম্ভব না’। ভালো কথা। তো সেই আরবি ভাষা ব্যাকরণ জানা ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাসসিরে কোরআন(!)’ তো আরবি সুর করে তেলাওয়াত করে তারপর বাংলা তরজমা করেই বোঝাবেন। এবং আম-জনতা শেষ পর্যন্ত ওই বাংলাটুকুই বুঝবেন।

 

কোরআনের প্রসিদ্ধ অনুবাদগুলো তো আরবি জানা আলেমরাই করেছেন। সৌদি আরবের “কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স ফর দ্য প্রিন্টিং অফ দা হোলি কোরআন” এবং বাংলাদেশের “ইসলামিক ফাউন্ডেশন” বিশেষজ্ঞ আলেম ভাষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত সম্পাদনা পরিষদের মাধ্যমে কুরআনের যথাসাধ্য নির্ভুল অনুবাদ প্রকাশ করে থাকে। সুতরাং শুধু শুধু মানুষকে হাইকোর্ট দেখিয়ে কুরআনের সত্য থেকে দূরে রাখার অর্থ ব্যবসায় ভাটা পড়ার আশংকা বৈ কিছু না।

 

কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রী দাওরায়ে হাদিস। দাওড়ায়ে কোরআন কিন্তু নাই। বেশিরভাগ বড় বড় আলেম প্রায় সবাই শাইখুল হাদিস কিংবা মুফতি। সাইখুল কোরআন কিন্তু নাই। সরকারি মাদ্রাসা থেকে যারা কামেল পাশ করে তাদের ৯৫ ভাগই হয় মুহাদ্দিস নয়তো মুফতি। তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ মাদ্রাসায় তাফসীর বিভাগই নাই।

 

অনেক হাফেজী মাদ্রাসা আছে, যেখানে ‘কোরআনের পাখিরা’ কোরআন মুখস্ত করে কোরআনের হাফেজ হয়। আমরা সবাই জানি কুরআনে হাফেজ মানে কোরআন মুখস্থ করা। কিন্তু হেফজ মানে মুখস্ত করা নয়, সংরক্ষণ করা। যেমন আল্লাহ হাফেজ অর্থ আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করুক, অবশ্যই নয় যে ‘আল্লাহ আপনাকে মুখস্ত করুক’!

 

একটা সময় ছিলো যখন কাগজ, ছাপাখানা ছিলো না তখন মুখস্থ করা ছাড়া কুরআন সংরক্ষণ প্রায় অসম্ভব ছিলো। তখন হাফেজরা জীবন্ত কোরআন হিসেবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো কোরআন প্রতিষ্ঠিত করতে। তারা কোরআনের ভাষা বুঝতো। এখন কোরআন মুখস্থ করা কি কোরআন সংরক্ষণের জন্য জরুরী নাকি তার চেয়ে বেশি জরুরী কোরআন বুঝে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা? কারণ, দেখা যায় যে, হাফেজদেরও চর্চা না থাকলে ভুলে যায়। তাদের আবার ছাপা কোরআন থেকেই শুধরে নিতে হয়। অন্যদিকে খতম তারাবির জন্য দুইজন হাফেজ নিয়োগ করা হয়, যাতে একজন ভুল বললে আরেকজন শুধরে দিতে পারে। কিন্তু দুইজনই যদি ভুল করে আল্লাহ ছাড়া শুধরাবার কেউ নাই!

 

হেফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা হয়। আমাদের দেশের হাফেজরা চ্যাম্পিয়ন হয়। খুব ভালো কথা। কিন্তু বেশিরভাগ হাফেজই কুরআনের অর্থ জানে না। কারণ তারা জানে অর্থ না বুঝলেও কোরআন তেলাওয়াত করলেই ‘প্রতি হরফে দশ নেকি’। এই ডাহা মিথ্যা কথা যে কোরআনে নাই এটা কোরআনের অর্থ বুঝে পড়লেই বুঝতে পারবেন। তেলাওয়াত শব্দের অর্থ পাঠ করা বা পড়া। কিন্তু অর্থ না বুঝে পাঠ করলে কি তাকে পড়া বলে? চাইনিজ ভাষায় মেডিকেল সায়েন্সের সব বই মুখস্ত করে মেডিকেল ডিগ্রি নিয়ে এলেন, কিন্তু অর্থ জানেন না। অর্থ না জানলে রোগীকে চিকিৎসা করবেন কিভাবে?

 

কিছু অযৌক্তিক হাদিস

·       “কালোজিরায় মৃত্যু ছাড়া সর্বরোগ নিরাময় হয়” এটা শুধু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ধারণার পরিপন্থীই নয়, ১৪০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতিরও পরিপন্থী। এমন অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক কথা নবীজি বলতে পারেন না। সুতরাং এটা হাদিস হিসাবে অকার্যকর।

·       “আজওয়া খেজুর খেয়ে বিষ পান করলে বিষ কাজ করবে না” এটা আপনার খেজুরের বিক্রি বাড়াতে সহায়তা করলেও এর ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সুতরাং এটা নবীজির নামে স্পষ্ট মিথ্যাচার।

 

খ্রিস্টানদের সাথে লন্ডনে একটি বিতর্কে একজন ইসলামী স্কলার নাকি আজওয়া খেজুর খেয়ে প্রকাশ্যে বিষপান করেছিলেন। চিনি নাকি বিষ পান করেন আজওয়া খেজুর সম্পর্কিত হাদিসের সত্যতা প্রমাণের জন্য। যারা এই সমস্ত পোস্ট শেয়ার করেছিলেন তারা এই ঘটনার সত্যতা যাচাই তো করেনই নি, ন্যূনতম বিবেকও কাজে লাগাননি যে বৃটেনের মতো দেশে প্রকাশ্যে বিষ পান আদৌ সম্ভব কিনা।




কোরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ সকল মানদন্ডে উত্তীর্ণ কুরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে বিবেচিত প্রকৃত হাদিসের সংখ্যা কতো? প্রায় ৩ হাজার- যা প্রিন্ট আকারে প্রকৃত সাইজ হবে কুরআনের অর্ধেক। এর আগের কয়েকটি লেখায় তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। এই হাদিসগুলো আলোচনা করলে দেখবেন কোরআন বিরোধী কোনো কথাই নেই তাতে। কিন্তু বাজারে হাদিস প্রচলিত আছে প্রায় ৩৫ লক্ষ। এ শুধু সুন্নীদের হাদিস। শিয়াদের হাদিস আবার ভিন্ন। এরকম প্রতিটা মাযহাব, উপ মাযহাব, তরিকা, ফেরকা – সবারই মনোনীত আলাদা আলাদা হাদিস আছে। হাদিসের সুবিধা হচ্ছে, আপনি আপনার স্বার্থ অনুযায়ী সহি বা জাল বলে দিতে পারবেন - যেটা কুরআনের বেলায় সম্ভব না। এতো হাদিস কারা তৈরি করলো? ধর্মের দোকানদাররা!

 

দুনিয়ার বড় বড় সব মুহাদ্দিসরা একমত যে, জাল হাদিসের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। কিন্তু কোন হাদীসগুলো জাল সে বিষয়ে অবশ্য সর্বকালের সেরা মুহাদ্দিসরাও একমত হতে পারেননি। হাদিসের যেহেতু সত্যতা নিরূপণে জটিল ব্যাপার থাকে তাই কোয়ালিফাইড মুহাদ্দিস ব্যতীত যে কেউ যত্রতত্র হাদিস বর্ণনা করতে পারবেনা। এটা হাদিস বর্ণনার একটি শর্ত- ঠিক যেমন কোয়ালিফাইড ডাক্তার ছাড়া যে কেউ চিকিৎসা করতে পারবেনা। কিন্তু ফেসবুকে এখন সবাই কমবেশি মুহাদ্দিস। আবার কোন দোয়া পড়লে স্বামী/স্ত্রী বশ থাকবে তারও শর্ট ভিডিও বানিয়ে রীল, টিকটকে ছেড়ে দিচ্ছে যা কোরআন অনুযায়ী গোনাহর কাজ।

 

আমি যে এলাকায় থাকি সে এলাকায় কাউকে কাউকে দেখি, করে ঘুষের চাকরি অথচ আরেকজনকে মসজিদে যাওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে। কিন্তু যেসব কাজ করলে নামাজ কবুলই হবে না, তা মানার ধারেকাছেও নাই। আমি সারাদিন অসৎপথে চললাম, মানুষকে বিপদে ফেলে টাকা আদায় করলাম, নামাজে দাঁড়িয়ে গোনাহ মাফের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করলাম; কোনো লাভ নাই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এ ঘোষণা দেন নাই। অথচ আমরা নামাজকেই ধর্মের একমাত্র পালনীয় মনে করি, আবার নামাজ পড়ার পদ্ধতি নিয়ে ঝগড়াও করি।

 

আমি নামাজে কাউকে নিরুৎসাহিত করছি না। কারণ, নামাজ আমাদের প্রতিদিনের ধর্মচর্চার একটি প্রধান বিষয়। নামাজের মাধ্যমেই সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভের আবেদন করতে হয়। আবার প্রচলিত পদ্ধতির নামাজকে ভুলও বলছি না। আমি শুধু কুরআনে নামাজের ব্যাপারে কি বলা হয়েছে তা বোঝার বা বোঝানোর চেষ্টা করছি, যাতে আপনি আপনার নিজস্ব চিন্তা গবেষণা প্রয়োগ করে নামাজের মূল উদ্দেশ্য কি তা বুঝতে পারেন।

 

নামাজ ফার্সি শব্দ যার আরবী প্রতিশব্দ সালাত। কোরআনে যতো জায়গায় সালাতের কথা বলা হয়েছে তা শুধু ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া নয়। সালাত আদায় করার অর্থ ব্যাপক। কোরআনে ৮২ বার সালাত শব্দের উল্লেখ আছে। কোরআনের অর্থ বুঝে পড়লে যতো জায়গায় সালাতের কথা বলা হয়েছে তা সহজেই বুঝতে পারবেন, সালাত আদায় অর্থে আল্লাহ কি বুঝিয়েছেন।

 

নামাজ পড়ার পদ্ধতি নিয়ে ঝগড়া

আল্লাহ যেহেতু নামাজ পড়ার কোনো বিশেষ পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেননি, তাই যে যেভাবে নামাজ আদায় করছেন কারোটাই ভুল বলার এখতিয়ার নেই। অনেকে বলে থাকেন, প্রচলিত নামাজের বিবরণ হাদীসে আছে। কিন্তু প্রচলিত হাদিসগ্রন্থ খুজে দেখুন, নামাজের বিস্তারিত বর্ণনা বা পড়ার পদ্ধতি হাদিসেও নেই। আমরা নামাজ পড়ি সাহাবায়ে আজমাইনদের ইজমা, আয়েম্মায়ে মুস্তাহিদিনদের ফিকাহ, আলেমদের ফতোয়া এবং কথিত চিরন্তন শরিয়ার ভিত্তিতে।

 

সাহাবায়ে আজমাইনদের ইজমা মানে সকল সাহাবীদের ঐক্যমত। তবে কবে কোথায় কোন বিষয়ে নবীজির সাহাবীরা একমত হয়েছিলেন তা যাচাই করার কোনো সুযোগ নাই। সুতরাং ‘সাহাবায়ে আজমাইনদের ইজমা’ একটি বোম্বাস্টিং আরবি বলে দিলাম- ব্যাস, পাবলিক চুপ। আপনি যদি কোনোভাবে প্রধান সাহাবীদের সম্মিলিত রায়ের নথি উদঘাটন করতে পারেন- দেখবেন নামাজের বিবরণ সেখানেও নেই।

 

মুস্তাহিদীনদের ফিকা- এই আরবি শব্দটির অর্থ হচ্ছে ইমামগণ যারা গবেষণা করে আমাদেরকে ধর্মের একটি রেডিমেড ফর্মুলা দিয়ে গেছেন, যেমন; আমরা হানাফীরা ইমাম আবু হানিফার বই অনুযায়ী নামাজ পড়ি। কিছুদিন পর ইমাম শাফেঈ এসে বললেন, ‘তোমাদের নামাজ রোজা কিছুই হয় না’। নামাজ কিভাবে পড়তে হবে এই মর্মে তিনি আরেকটি বই লিখলেন। নাসির উদ্দিন আলবানী এসে বললেন, তোমাদের কারোরই নামাজ শুদ্ধ হয় না। নামাজ পড়তে হবে নবীজি যেভাবে পড়েছেন সেভাবে। তো নবীজি কিভাবে নামাজ পড়েছেন এ মর্মে তিনি একটি বই লিখলেন। অর্থাৎ তিনিও ইমাম আবু হানিফা, ঈমাম শাফেঈর কাজটিই করলেন। আহলে হাদিসের লোকেরা নাসিরুদ্দিন আলবানীর বই অনুযায়ী নামাজ পড়ে- যা কার্যত আলবানী মাযহাব। হাদিস অনুযায়ী নামাজ পড়লে হাদিসই তো আছে, আলবানীর বই লাগবে কেনো?

 

এখানেই শেষ নয়। আহলে হাদিসের সবচেয়ে বড় তিনজন পন্ডিত নাসির উদ্দিন আলবানী, ইবনে উসাইমিন, ইবনে বাজ- এদের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে চার’শ বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। এমনটি হানাফী, হাম্বলী মাযহাবের পন্ডিতদের মধ্যেও আছে। এরপর এই রোগ যাতে আর না ছড়ায়, শেষ পর্যন্ত তার জন্য আসে তাকলীদের ধারণা। অর্থাৎ যে যে মাযহাবে আছে সেখান থেকে আর নড়াচড়া করা যাবে না। সেই মাযহাবের নিয়ম-কানুন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এর বাইরে নিজস্ব গবেষণা করলেই সে গায়েরে মুকাল্লিদ বা তাকলীদ অস্বীকারকারী। এভাবেই উদ্দেশ্যবাদীরা চাল-ডাল মিশিয়ে আমাদেরকে বসিয়ে দিয়েছে যে, তোমরা বসে বসে এগুলো আলাদা করো, আমরা একটু দুনিয়াটা চালাই।

 

বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের পছন্দের আলেমরা যা বলছে তাই অন্ধের মত অনুসরণ করছে। কোরআন কি বলছে তা জানার প্রয়োজনও মনে করে না। কোরআন তেলাওয়াত শোনাও সওয়াব! কিন্তু অর্থ না বুঝলে সেটা কি শোনা হলো? সূরা আরাফ আয়াত ২০৪:

·       “সুতরাং, যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা শোনো এবং নীরব থকো, যাতে তোমরা রহমত পেতে পারো”।

কিন্তু শুধু শুনলেই কি রহমত পাওয়া যাবে? শুনে, বুঝে তদানুযায়ী আমল করলে তবেই আল্লাহর রহমত বা কৃপা অর্জন করা সম্ভব হতে পারে।

 

সুতরাং আমাদেরকে কোনো ধর্মগুরুর গুটি হয়ে বসে থাকলে হবে না। আমাদেরকে কোরআন বুঝতে হবে। নিজেদের সুবিধা, পছন্দ অনুযায়ী বুঝলে হবে না। অর্থ না বুঝে কোরআন পড়া বা শোনা হচ্ছে “বধির ও বোবা” আর না বুঝে তর্ক করার নাম হচ্ছে আক্কেল বা বিবেক ব্যবহার না করা।

 

এখন বাংলা অনুবাদ করা কোরআন সবার হাতে হাতে। কেউ কোনো ফতোয়া দিলে আগে দেখবেন কথাটা কি কোরআনে আছে কিনা। আপনি সেই বিষয়ক আয়াতগুলো পড়ে দেখুন। কনফিউশন হলে কয়েকটি অনুবাদ চেক করুন। কাউকে অন্ধের মতো অনুসরণ করবেন কেনো?

 

যে কথা কোরআনে নাই তা কোনো হাদিসে থাকলেও সে হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সাহাবীরাও একমত, ইমামরাও একমত। ইমাম আবু হানিফা সহ সকল ইমাম তাদের গ্রন্থের ভূমিকায় বলে গেছেন; তাদের কোনো বক্তব্য যদি কোরআন এবং সুন্নাহর পরিপন্থী হয় সেক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম বুখারী সহ সকল হাদিস সংকলক বলে গেছেন; তাদের সংগৃহীত কোনো হাদিস যদি কুরআনের সাথে অসংগতিপূর্ণ প্রমাণিত হয় সে হাদিস অকার্যকর। অর্থাৎ সে হাদিস শরীয়তের বিধান হিসেবে প্রযোজ্য হবে না।

 

দুনিয়ার কোনো আলেম কি বলেছে বা বলতে পারবে যে তার বক্তব্য কুরআনের পরিপন্থী হলেও সেই বক্তব্য আমলযোগ্য? সুতরাং আপনি সারা পৃথিবী চষে যতো সোনা-দানাই সংগ্রহ করেন, পরিশেষে কষ্টিপাথর হচ্ছে কোরআন। কোরআন বলবে সে সোনা আসল না নকল।

 

হাদিস, ফিকাহ, ফাজায়েলে আমল সবই পড়ুন, তাতে জ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু হাদিস মানবেন হাদিস হিসেবে। কোরআন মানবেন কোরআন হিসেবে। কিচ্ছা কাহিনী মানবেন কিচ্ছা কাহিনী হিসেবে। কোরআন হচ্ছে নবীজির হাদিস- যেটা তিনি বর্ণনা করেছেন আল্লাহর বাণী হিসাবে। এটা প্রতিটা মুসলমানের বিশ্বাস করা ও এর আদেশ-নিষেধ মান্য করা বাধ্যতামূলক। এই কোরআনের একটা শব্দ নিয়েও সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। মুসলিম হিসাবে আমরা বিশ্বাস করি, কুরআন আল্লাহর বাণী। মুসলিম হিসেবে আমরা বাইবেল তাওরাত সহ অন্যান্য আসমানি কিতাসমূহও নিঃশর্ত বিশ্বাস করি।

 

আমাদের মুসলিম সমাজে একটি কথা প্রতিষ্ঠিত যে, খ্রিস্টানরা তো বাইবেল পরিবর্তণ করেছে, তাই বাইবেল বাতিল। ইহুদিরা তো তাওরাতকে পরিবর্তন করেছে, তাই তাওরাত বাতিল। কিন্তু এ কথাটা কোরআনের কোথাও নেই। বরং কোরআন বলছেঃ

·       “এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা চলবে না (সুরা বাকারাঃ আয়াত-২৮৫)”।

 

ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে বুখারী, মুসলিমসহ অন্যান্য সংগৃহীত হাদিস বিশ্বাস করবেন এভাবে যে, এটা সত্য-মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে কোনোকিছু হতে পারে। হাদিস সত্য-মিথ্যা, সহীহ বা জাল হতে পারে। এ কথা কি দুনিয়ার কোনো মুহাদ্দিস অস্বীকার করতে পারবেন?

 

তাফসীর বিশ্বাস করবেন তাফসীরকারকের নিজস্ব ভাবনা বা বিশ্লেষণ হিসাবে। তাফসির লেখার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে কাউকে লাইসেন্স দেয়া হয়নি। আপনি আমি যে কেউ তাফসীর লিখতে পারি। তাফসির দেওয়ানবাগীও লিখেছে, আরামবাগীও লিখেছে- এখনো অনেকে লিখছে।

 

মাদ্রাসায় তাফসীরে জালালাইন পড়ানো হয়। এছাড়া তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে মা আরিফুল কোরআন, তাফহীমুল কুরআন ইত্যাদি আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত। তাফসীর বিশ্বাস করতে হবে তাফসীর হিসাবে। কোরআনের বক্তব্যের এক ইঞ্চি বাইরে গেলেও অফসাইড!

 

ইতিহাসকে বিশ্বাস করবেন ইতিহাস হিসেবে। ইতিহাস লেখে সরকারি দল। যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তারা আপনাকে যা বিশ্বাস করাতে চায় তাই ইতিহাস। ইসলামের ইতিহাসের প্রধান ঐতিহাসিক হচ্ছেন আমেরিকার প্রিস্টন ইউনিভার্সিটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক প্রয়াত ফিলিপ কে হিট্টি। লেবাননে জন্মগ্রহনকারী এই ঐতিহাসিক ছিলেন একজন খৃষ্টান। সুতরাং ইতিহাস হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য। এটা হুবহু গ্রহণ করা যাবে না।

 

সাহাবিয়ে আজমাইনদের ইজমা, আয়েম্মায়ে মুজতাহিদিনদের ফিকাহ, আলেমদের ফতোয়া, চিরন্তন শরীয়তকে বিশ্বাস করবেন ইজমা, ফিফাহ, ফতোয়া বা কথিত চূড়ান্ত শরিয়া হিসাবে।

 

বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে যেসব ‘আজব দুনিয়া গজব কাহিনী’ শোনেন, সেগুলো বিশ্বাস করবেন কল্পকাহিনী হিসাবে। আমরা সিনেমা দেখি, উপন্যাস পড়ি, কিন্তু সেটা কল্পকাহিনী হিসেবেই ধরি, কেউ তা সিরিয়াস ভাবে নেয় না। তাতে যদি কোনো ভালো উপদেশ থাকে তাহলে ভালো কাজ হিসেবে করবেন, ফরজ ওয়াজিব হিসেবে নয়।

 

দাড়ি-টুপি, হিজাব সবই ঠিক আছে যতক্ষণ আপনি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করবেন। দাড়ি পুরুষের সৌন্দর্য। সিনেমার অনেক সুপারস্টারও আজকাল দাড়ি রাখেন। হিজাব হাল আমলের একটি ভালো ফ্যাশন। হিজাব অনেকের কাছে ফ্যাশন হিসেবে প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু এ নিয়ে বিশেষ ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা কোরআনে আরোপ করা হয়নি। হিজাব-নিকাব নিয়ে আরেকটি লেখায় বিস্তারিত লিখেছি।

 

কোরআন বহির্ভুত কোনোকিছুকে ফ্যাশন হিসেবে, ব্যক্তিগত পছন্দ হিসেবে ব্যবহার করেন- কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু ধর্মীয় বিধি-বিধান হিসেবে করলে উল্টা গুনাহ হবে। রসনা বিলাস এবং আল্লাহর আদেশ অমান্যের উদ্দেশ্যে না হলে, বিপদে পড়লে কিংবা ভুলক্রমে বা না জেনে শুকরের মাংস খে‍য়ে ফেললেও পাপ হবে না।

 

আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের বাইরে কোনোকিছুকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ হিসেবে পালন করাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ

·       “এবং যারা আল্লাহর সীমা অতিক্রম করে তারাই জালিম-(২:২২৯)”।

অর্থাৎ আল্লাহ যা ফরজ বলেননি বা যা হারাম বলেননি তা ফরজ বা হারাম মনে করে করা যাবে না। আপনি কি করলেন সেটার পাশাপাশি কি উদ্দেশ্যে করলেন সেটাও জরুরী। যেমন; আপনার হাতে পাথরের আংটি যদি ফ্যাশন বা শখ হিসেবে পরেন কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু পাথরকে ভাগ্য নির্ধারক হিসেবে বিশ্বাস করলে তা ধর্মীয় দৃষ্টিতে শিরক, সাধারণ দৃষ্টিতেও বোকামি।

 

পীরকে শিক্ষক বা উপদেষ্টা হিসেবে কিংবা সৎসঙ্গ হিসেবে মানলে কোনো অসুবিধা নাই। কিন্তু যদি বিশ্বাস করেন পীর আপনাকে পুলসিরাত পার করে দেবে এবং পীর সাহেব যদি এমন বিশ্বাসকে অনুমোদন দেন তাহলে পীর মুরিদ দুই জনই মুশরিক। অলি আওলিয়াদের কবর জিয়ারত এবং তাঁদের জন্য দোয়া করা দোষের কিছু নাই বরং এই সম্মান এবং দোয়া তাঁদের প্রাপ্য। কিন্তু বেশির ভাগ মাজারে যা হচ্ছে তা পরিষ্কার শিরক। স্বয়ং আল্লাহ নবীজীকে বলতে বলেছেনঃ

·       “আমি জানিনা আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কি করা হবে; আমি আমার প্রতি যা অহী করা হয় শুধু তারই অনুসরণ করি। আমি এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র – (সুরা আহকাফঃ আয়াত-৯)”।

 

“আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো”- এর অর্থ যদি রাসুলকে আল্লাহর সমকক্ষ বোঝেন তাহলে উপরোক্ত আয়াত অনুযায়ী শুধু গুনাহ না, একেবারে আবু জাহেলের মতোই মুশরেক;- যেমনটা অনেকে যীশুকে ঈশ্বর মনে করেন।

 

আবু জাহেল, আবু লাহাব নাস্তিক ছিলো না, বরং মস্তবড় ধার্মিক ছিলো। কিন্তু রেফারি অফ সাইডের বাঁশি বাজানোর পরও গোল দিয়েছে; তাই গোল তো হয়ই নাই, উল্টা লাল কার্ড খেয়েছে।

 

কোরআন পড়েন, কোরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করেন দেখবেন সব কিছুই পরিষ্কার। কিন্তু যারা কোরআন উলটিয়েও দেখে না, নিজেদের পছন্দের হুজুরদের অন্ধ অনুসরণ করে এবং হুজুরদের কথার সাথে না মিললে কুরআনের উদ্ধৃতি দিলেও গোমরাহী বলে দেয়, তারা “বোবা ও বধিরের সমতূল্য”। সুরা মুলক-এর ১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ

·       “আর তারা বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বুঝতাম, তাহলে আমরা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসীদের মধ্যে থাকতাম না”।

‘বুঝতাম’ অর্থাৎ নিজের চিন্তা গবেষণা দিয়ে আল্লাহর নির্দেশাবলী যদি বুঝতাম এবং সেই মোতাবেক চলতাম। সুতরাং আপনার গবেষণা, আপনার বিবেক বিবেচনা আপনাকেই করতে হবে। আপনার পড়াশোনা, গবেষণা করার দায় আপনার। কারো রেডিমেড ফর্মুলা নেয়া যাবে না। আল্লাহ কোরআনে কোনোকিছু বাদ রাখেননি। আল্লাহ বলেছেনঃ

·       “আমি এই কিতাবে কোনোকিছুই লিপিবদ্ধ করতে বাদ রাখিনি – (সুরা আনামঃ আয়াত-৩৮)”।

 

আজকাল বিভিন্ন স্কলার কোরআন নিয়ে গবেষণা করছেন। ইউটিউবে এ বিষয়ক বিস্তর ভিডিও পাওয়া যায়। নিজেও কোরআনের বাংলা অনুবাদ পড়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলো জেনে বুঝে ধর্ম পালন করা উত্তম।

অতএব, কোরআন পড়ু্‌ন, বুঝে পড়ুন। কোরআনে প্রদত্ত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলুন। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন।

 





Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url