কোরআনই একমাত্র আল্লাহর বিধান
পবিত্র কোরআন শরীফের ছবি |
আমাদের ধর্মগ্রন্থের
নাম আল-কোরআন - যা আমরা মহান আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ বলে বিশ্বাস করি। আমাদের করণীয়-বর্জনীয়
যা কিছু- সব কোরআনেই আছে। এই নিবন্ধে কথা বলবো আল্লাহ ও তার রাসুল-এর নির্দেশ অনুসরণ নিয়ে।
রাসুল(সাঃ)-এর নির্দেশ অনুসরণ বলতে কি লোকমুখে শোনা হাদিস অনুসরণ বোঝায়? কোরআন-এর পাশাপাশি প্রচলিত হাদিসকে অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় বিধান হিসেবে বিবেচনার পক্ষে অন্যতম প্রধান যুক্তি- বিদায় হজ্জের ভাষণে নবীজি(সা:) কুরআন ও তার সুন্নাহ বা হাদিস আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। কিন্তু এমন বর্ণনা ছিয়াছিত্তা অর্থাৎ প্রসিদ্ধ ৬টি হাদিসগ্রন্থে নেই। মুসলিম ও আবু দাউদে বিদায় হজ্জের ভাষণের যে বর্ণনা আছে, তাতে নবীজী একটি জিনিস আঁকড়ে ধরতে বলেছেন- তা হচ্ছে ‘আল্লাহর কিতাব’। সুতরাং হাদিস মানলেও আমাদেরকে আল্লাহর কিতাবই অনুসরণ করতে হবে। বিদায় হজ্বের ভাষণ নিয়ে আগে একটি নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
ছোটোবেলা থেকে
শুনে আসছি, আমাদের বেশিরভাগ ইসলামী বক্তা “নবী যা দেয় তা গ্রহণ করো, আর যা নিতে বারণ করেন তা থেকে বিরত থাকো” - সুরা হাশরের
৭ নং আয়াতের অংশ বিশেষকে শরিয়তের বিধান এবং হাদিস পালনের ভিত্তি হিসাবে উপস্থাপন করেন। সুরা হাশরের ৬ এবং ৭ নং আয়াতের বঙ্গানুবাদ পড়লে স্কুলের বাচ্চারাও বুঝবে যে, এ আয়াতে মদীনার কোনো এক অমুসলিম গোত্র, যাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ করতে হয়নি, তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে বলা হয়েছে- যে, সে সম্পদ রাসুলের অর্থাৎ রাষ্ট্রের। তবে তা থেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নবীজী(সা: )
“যা দেন তা গ্রহণ করো, যা
নিতে বারণ করেন তা থেকে বিরত থাকো”। এতে প্রচলিত হাদিসের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই। এই আয়াতকে হাদিস পালনের যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা আর ‘অন্ধকে হাতী দেখানো বা ছেলে ভুলানো’ এক কথা।
কোনো পাল্টা যুক্তির দরকার নেই। আপনি আপনার হাতের কাছে থাকা কোরআন শরীফ খুলে দেখুন। পরিষ্কার বুঝবেন যে, এর সাথে কথিত হাদিসের কোনো সম্পর্কই নেই।
বিদায় হজ্জের ভাষণ সংক্রান্ত ছিয়াছিত্তার হাদিস গোপন করা এবং কুরআনের আয়াতের অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দিয়ে হাদিসকে শরিয়তের বিধান বানানো খুবই অন্যায় এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
তৃতীয় যে যুক্তি তা নিয়েই মূলত এই নিবন্ধে কথা বলবো। হাদিস পালনের আর একটি প্রধান যুক্তি- “আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা”। আল্লাহ কোরআনে বহুবার বহুভাবে ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্যের’ নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কুরআন আল্লাহর বাণী - সুতরাং কোরআন মানলে আল্লাহর অনুসরণ হয়। কিন্তু রাসুলের অনুসরণ করতে হলে তো রাসূলের হাদিস তথা রাসুলের কথা-কাজ অনুমোদনের বিবরণ সম্পর্কে জানতে হবে। খুবই যৌক্তিক।
সুরা আহযাবের ২১ নং আয়াতঃ
“লাকাদ কা-না
লাকুম ফী রাসুলিল্লা-হি উছওয়াতুন হাসানা”
(নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুল-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ”)।
এখন রাসূলুল্লাহর আদর্শ আমরা কিভাবে জানবো? বুখারী বা মুসলিম শরীফ থেকে?
সুরা মুমতাহানার
৪ নং আয়াতের শুরুতে আল্লাহ বলছেন:
কাদ কা-নাত
লাকুম উছওয়াতুন হাছানাতুন ফী ইব্রাহীমা ওয়াল্লাযীনা মা’আহু” – (ইব্রাহিম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ)”।
এবার ইব্রাহিম(আঃ) এবং তার অনুসারীদের আদর্শ আমরা কোন শরীফ থেকে জানবো?
ইব্রাহিম(আঃ)
আমাদের মুসলিম মিল্লাতের পিতা। এই মিল্লাত-এ-ইব্রাহিম এর মধ্যে ইহুদি খ্রিস্টানরাও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আহলে কিতাবদের মধ্যে বিভক্তি বিভাজনের কারণে ইব্রাহিম(আঃ)-এর নামে কথিত হাদিস।
আবু জেহেল, আবু লাহাব সহ আরবের বিখ্যাত কাফেররা
কিন্তু নাস্তিক ছিলোনা। বরং সে সময়ের প্রধান আলেম বা ধর্মগুরু ছিলো। সে সময় কাবায় হজ্জ্ব হতো। আবু জেহেল হজ্জ্বের খুৎবা দিতো,
ইমামতি করতো। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে:
এই আবু জেহেলরা ইব্রাহিম(আঃ)-এর
নামে বিভিন্ন হাদীসের কিতাব অনুসরণ করতো এবং সেসব হাদিসের ভিত্তিতে বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল, দিবস, রীতি-রেওয়াজ চালু করে এবং সেগুলোকে ধর্মের প্রধান অংশ বানায়। নবীজী(সাঃ) যখন বললেন,
‘ইবাদত বা আদেশ নিষেধ মানতে হবে একমাত্র আল্লাহর’। এইতো বাধলো ঝামেলা! শুধু আল্লাহর কিতাব মানলে তো আবু জাহেল আবু লাহাবদের মাযহাব টেকে না। তারা বললো, ‘কি! শুধু আল্লাহর কিতাব মানলে হবে নাকি! ইব্রাহিম নবী, ঈসা নবী, মূসা নবী - এঁদেরকেউ মানতে হবে’। অর্থাৎ এদের নামে বানানো হাদিস, মনগড়া কিচ্ছা-কাহিনী, আল্লাহর কিতাবের পছন্দসই তাফসির, ইজমা-কিয়াস এগুলোও মানতে হবে। নবী-রাসুলের কথিত সংগৃহীত সুন্নত মানতে হবে।
আবু জেহেলরাও কিন্তু লম্বা লম্বা দাড়ি রাখতো, জুব্বা পরতো, টুপি-পাগড়ি পরতো,
নামাজ পড়তো, রোজা রাখতো, হজ্জ্ব কোরবানী সবই করতো। সে সময়ের
সবচেয়ে বড় আলেম শাইখুল হাদীস ছিলো আবু জেহেল। তার মূল উপাধি ছিলো ‘আবুল হাকাম’ বা ‘জ্ঞানীদের পিতা’।
কথাগুলো আপনার কাছে নতুন মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো নতুন কথা না। এগুলো কোরআনোর কথা। কোরআনে
সুরা লুকমানের
২৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ
“তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা নিশ্চয়ই বলবে: আল্লাহ”। অর্থাৎ তারা আল্লাহকে মানতো, আল্লাহর কিতাবও মানতো। সাথে নিজেদের বানানো কিছু হাদিসও মানতো। সে সব হাদিস ভিত্তিক ফরয-ওয়াজিব, হালাল-হারাম বাদ দিলে তাদের ধর্মের দোকান চলেনা। সে ধর্মের দোকান চালু রাখতে তারা আল্লাহর কিতাবের পরিপন্থী
অবান্তর হাদিস সংগ্রহ করে। সূরা লুকমানের ৬ নং আয়াতে এ কথাই আল্লাহ বলেছেনঃ
“আর কিছু মানুষ
আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অবান্তর হাদিস(লাহুয়াল হাদিস) সংগ্রহ করে, যে সবের সত্যতা সম্পর্কে
তারা জানে না এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে; তাদেরই জন্য রয়েছে
অবমাননাকর শাস্তি”।
প্রচলিত হাদীসের সত্যতা আমরা জানি না। ‘হাদীস সংগ্রহ সংকলনের তুঘলকি
কাণ্ড কারখানা নিয়ে আরেকটি লেখায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছি। হাদিসের সব নির্দেশ নবীজির
নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাদিসের নামে আমরা মানছি লোকমুখে শোনা কিংবা হুজুরদের কথা।
পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু
বলতে গেলেও অনেকে বলে, ‘আপনি একজন মুহাদ্দিসের(হাদিস বিশারদ) কাছে যান। কিন্তু মুহাদ্দিসরা
তো হাদিস নিয়েই একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে। একজনের হাদিস আরেকজন মানে না। একজন আরেকজনকে
কাফের ঘোষণা দেয়। তবে আমরা জানি যে, নবীজীকে আল্লাহ যা জানিয়েছেন, এর বেশি তিনি জানতেন
না।
সুরা আহযাব, আয়াত-৬৬:
“লোকেরা তোমাকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করে; বলো এ বিষয়ের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকটই আছে”।
আল্লাহ নবীকে কেয়ামত সম্পর্কে কী
বলতে বলেছেন? এই বিষয়ের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকটই আছে। তবে আল্লাহর নবীকে বাইপাস করে
কিছু জ্ঞান আল্লাহ আমাদের ওয়ায়েজিনদের দিয়েছেন! নইলে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ফিল্মের
মতো কেয়ামতের কাহিনি কীভাবে বলেন!
একমাত্র আল্লাহর কিতাব ছাড়া নবী রাসুলদের
প্রকৃত সুন্নাহ জানা অসম্ভব। ইব্রাহিম(আঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের সিরাত সুন্নত আল্লাহ
কোরআনে বর্ণনা করেছেন। যতোটুকু আমাদের জানানো প্রয়োজন ততোটুকুই বর্ণনা করেছেন। সূরা
ইব্রাহীম নামে একটা সুরাই আছে। এছাড়া সুরা হাজ্জ্ব সহ অন্যান্য সুরায় ইব্রাহিম(আঃ)-এর
সিরাত-সুন্নতের আরও বিশদ আলোচনা আছে।
সূরা ইউসুফ, সূরা মারইয়াম, সূরা হুদ,
সূরা ইউনুস, সূরা নূহ, সূরা আম্বিয়া, সূরা আহযাব, সূরা মোহাম্মদ – এই সুরাসমূহে আল্লাহ
নবী-রাসুলদের সিরাত সুন্নত বলেছেন। এ ছাড়া কোরআনে আল্লাহ হযরত মূসা(আঃ), হারুন(আঃ),
আদম(আঃ), ইউসুফ(আঃ), জাকারিয়া(আঃ), শোয়েব(আঃ), লুত(আঃ), আইয়ুব(আঃ), দাউদ(আঃ) ও সোলাইমান(আঃ)-এর সিরাত-সুন্নতের বিশদ
বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর কিতাব নবী রাসুলদের হাদিস।
নবীরা আল্লাহর কাছে যে সব দোয়া করেছেন তা আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর কোরআনকে
হাদিসও বলেছেন, আর নিজেকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত রাবি বলেছেন। আল্লাহ প্রশ্ন করেছেনঃ
“ওয়া মান আসদাকু মিন আল্লাহ হি হাদীসা”
অর্থাৎ “হাদিস বর্ণনাকারী হিসাবে আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশি সত্যবাদী”?-(সুরা নিসা, আয়াত-৮৭)।
কিন্তু আল্লাহর বর্ণনা আবুজেহেলদের
পর্যাপ্ত মনে হয়নি। তারা যেসবকে ফরজ বা হারাম বলে জেনে আসছিল, ফজিলত ফাজায়েলের বিভিন্ন
দোয়া বানিয়েচজিলো, তার বর্ণনা আল্লাহর কিতাবে না থাকলেও তারা তা বাদ দিতে পারবে না।
কারণ এগুলো যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত। বড় বড় শাইখুল হাদিসরা বলেছে। তারা কি মুহাম্মদের
চেয়ে কম জানে?!
সূরা লোকমান, আয়াত-২১:
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়- আল্লাহ যা
নাযিল করেছেন তোমরা তার অনুসরণ করো; তখন তারা বলে বরং আমরা তাঁর অনুসরণ করবো যার উপর
আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি”।
মূর্তি পূজা, কবরে সিজদা - এসবকে আমরা
শিরক বুঝি। মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে এই মূর্তি বা কবরে সেজদায় কোনো জাগতিক উপকারিতা নাই।
পাথরের মূর্তি বা মৃতব্যক্তি কাউকে কিছু দিতে পারে না। কিন্তু পাথরের মূর্তি বা কবরে
শায়িত ব্যক্তি কারো কোনো ক্ষতিও তো করতে পারে না। একটা নিষ্প্রাণ মূর্তি বা কবরে শায়িত
পীর পয়গম্বর কেনো সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতিপক্ষ? তাঁর সামনে সিজদা কেন আল্লাহ সবচেয়ে
বড় অপরাধ৷ বলছেন?
আল্লাহকে সেজদা মানে আল্লাহর বিধান
বা নিয়ম মেনে চলা। “এই বিশ্বজগতের সবকিছু আল্লাহর সেজদা করে” - এর অর্থ এই জগতের সবকিছু
আল্লাহর বিধান মেনে চলে। কোনো মূর্তি পুজো মানে মূলতঃ সে দেবতার বিধি-বিধান বা নিয়ম
মেনে চলা। কোনো পীরকে সেজদা করা মানে পীরের দেয়া বিধান মান্য করা।
ক্কাবা’য় একসময় ৩৬০টি মূর্তি ছিলো।
এগুলো ছিল ইব্রাহিম নবী, ঈসা নবী, মূসা নবী সহ বিভিন্ন ওলি আঊলিয়াদের। খ্রিস্টানদের
একাংশ আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুসরণ করতে গিয়েই ইসা(আঃ)কে ঈশ্বর বানিয়েছেন। বেশিরভাগ
হিন্দু ভগবান ও তার অবতারের আনুগত্য করতে গিয়ে এক সময় বিভিন্ন অবতারকেই ভগবান বানিয়ে
পুজো করা শুরু করে।
আরবের লোকেরাও নবী-রাসুল, পীর-পয়গম্বরদের
ইবাদত করতো। মানে এঁদের নামে প্রচলিত বানোয়াট বিধিবিধান মানতো। কিন্তু নবী,
অবতা্ পীর, অলি- এঁরা একমাত্র আল্লাহর বিধান মানতেন এবং মানতে বলেছেন। কিন্তু আমরা
তাদের অনুসরণের নামে তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাচ্ছি।
আমি একজন কর্মচারী নিয়োগ করলাম। সে যদি আমাকে সিজদা দিয়ে পড়ে থাকে
তাতে আমার কী লাভ? বরং আমি তাকে যে কাজের জন্য নিয়োগ করেছি তা যদি সে কোনোরকম নজরদারি,
তদারকি ছাড়াই যথাযথভাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে করে তাতেই আমার লাভ। পৃথিবীর সব মালিক
এমন কর্মচারীই খোঁজে। সেভাবে- আল্লাহ আমাদের কি শুধু সেজদা করার জন্য সৃষ্টি করছেন?
না। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তার বিধি-বিধান মেনে চলার জন্য। এখন আপনি আপনার
পীরের বিধান মানবেন, আমি আমার শায়খের বিধান মানবো - এর নামই নৈরাজ্য।
একটা রাষ্ট্রে একটা কর্তৃপক্ষ থাকবে, একটা সংবিধান থাকবে। সরকারি দল-বিরোধীদল
সবাইকে সে সংবিধানের আইন মানতে হবে। পছন্দ না হলেও মানতে হবে। সব রাজনৈতিক দল যদি আলাদা
আলাদা সংবিধান বা আইন তৈরি করে, আলাদা বিচারালয়, আলাদা আইন প্রয়োগকারী বাহিনী বানায়,
তো সে দেশের নাগরিকদের হাল কী হবে? এই কারণে আইন বা বিধান একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহর
বিধানে কারো আপত্তি থাকবে না। কারণ আল্লাহর আইন সার্বজনীন। যে আইন সার্বজনীন নয় তা
আল্লাহর আইন নয়, আবু জেহেলের আইন!
ইউরোপ আমেরিকাতেই কোরআনের আইন বেশি মেনে চলা হয়। আল্লামা ইকবাল বলেছেনঃ
“আমি ইউরোপে মুসলমান দেখিনি, তবে ইসলাম দেখেছি। আর পাকিস্তানে মুসলমান
দেখেছি, কিন্তু ইসলাম দেখিনি”।
গ্লোবাল ইকোনমিক জার্নালে প্রকাশিত জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
হোসেন আসকারীর রিপোর্টের “ইসলাম সিটি ইন্ডেক্স” অনুযায়ী ইউরোপিয়ান দেশগুলি কুরআনের
নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। মুসলিম দেশগুলোতে আছে- দাড়ি, হিজাব, নেকাব আর কথিত হাদিস
ভিত্তিক ব্লাসফেমি আইন। যেখানে ফেসবুক স্ট্যাটাসের উপর ভিত্তি করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া
হয়(পাকিস্তানে দেয়া হয়েছে)। দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়া হয়।
কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকায় কতো পার্সেন্ট মুসলমান বাস করে?
আফগানিস্তান, ইরান, ইরাকের সাথে আমেরিকার যুদ্ধ চলতেই থাকে, অথচ আমেরিকায় বসবাসরত আফগান,
ইরাক, লিবিয়ার মুসলমানদের এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় না, তারা সেদেশে সংখ্যালঘু বা
শত্রুর দেশে বসবাস করছে। বরং সৌদি, ইরান, পাকিস্তানের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজ দেশেই
নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কাকে কখন মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে শিরচ্ছেদ করা হয়, কে জানে!
ওয়ায়েজিনরাও সুযোগ পেলে আমেরিকার গ্রীন কার্ডই বানায়। কোরআন-এর আইন
এমনই সার্বজনীন যেখানে রাষ্ট্রকে মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্যই অভয়ারণ্য হতে হবে। কিন্তু
ইরান, সৌদি আরবের কথিত ইসলামী হুকুমতে কুরআনের আইন চলে না। ইসলামি শাসনের নামে সেখানে
চলে আইয়্যামে জাহিলিয়াত!
হাদিস, তাফসির, ইতিহাস আমাদের কোরআন বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক। কিন্তু
‘শুধু কোরআন মানলে ইসলামের আর কিছুই থাকে না’- এ কথা কেউ বললে সে আবু জেহেলের মতোই
কাফের! আমাদের মানতে হবে একমাত্র কোরআন। কেউ যদি কোনোভাবে কোনো বিশেষ ‘শরীফ’কে কোরআনের
মতোই মানতে বাধ্য করে- তা কোরআন পরিপন্থী।
সুরা লুকমান, আয়াত-১৫: “আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে কোনো কিছুকে
অংশীদার করতে জোর চেষ্টা করে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে
না”।
আল্লাহর সাথে শরীক মানে আল্লাহর বিধানের সাথে এমন কোনো বিধান মানা-
যে সম্পর্কে আমরা জানি না। অর্থাৎ তা আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ কিনা তা আমাদের
জানা নেই। কিন্তু আল্লাহ কোরআনে যা জানিয়েছেন তার বাইরেও এমন অনেক বর্ণনা বা ধারণা
আছে যা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়। অথচ তার সত্যতা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। ইমাম
মাহাদি, দজ্জালের মতো অনেক কোরআন বহির্ভূত ধারণা, অনেক ফরজ-হারাম আমাদের বিশ্বাস করতে,
মানতে বাধ্য করা হয়- যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। বিভিন্ন দল মত এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি
হাদিস বানায়।
এ পর্যন্ত কয়েক হাজার কথিত ইমাম মাহাদি আর ইসা পৃথিবীতে এসেছেন, চলে
গেছেন। আরো কতো হাজার আসবেন কে জানে! অথচ কোনো নির্দিষ্ট ইমাম মাহদিকে মানলেও কাফের
আবার না মানলেও কাফের। কি বিপদ!
এমন অসংখ্য শাঁখের করাত আছে যে, ইসলামকে ‘গেলার অযোগ্য ঢেঁকি’ আর ভয়ানক
দৈত্য বানিয়েছে। ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ বা বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জনের তালিকা
খুঁজলে অবাক হবেন! উমাইয়া আমলে ১০ জনের তালিকাসহ যে হাদিস তৈরি করা হয় তাতে হযরত ফাতেমা,
হাসান, হোসেন(রাঃ)- এঁদের নামই নাই। আব্বাসীয় আমলে নতুন তালিকা তৈরি করা হয়। শিয়ারা
তাদের অনুমোদিত আহলে বায়েত থেকে ১০ জন নির্বাচন করে। এবার আপনি কোন ‘কোম্পানি’র হাদিস
নেবেন! কিন্তু এসব কথা কুরআনে পাবেন না। কোরআনে নেই, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে।
আরেকজনের গলায় পারা দিয়ে বিশ্বাস করাতে হবে- এ কেমন অবিচার! রাসুলের অনুসরণ অবশ্যই
করবো। কিন্তু রাসুলের আদেশ নিষেধের কোনো অনুমোদিত সূত্র বা উৎস থাকবে না? সে অনুমোদিত
সূত্র হচ্ছে কোরআন।
‘কোম্পানিগুলো তাদের ক্রেতাদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন
পদক্ষেপ নেয়; যে, ‘আমাদের আর কোথাও কোনো শাখা নেই’ বা পণ্যের গায়ে সিরিয়াল নাম্বার,
বারকোড, কিউআর কো্ আইএমইআই নম্বর থাকে যাতে গ্রাহক নিশ্চিত হতে পারে যে, এটা মূল কোম্পানির
উৎপাদিত পণ্য।‘
কোরআনের আয়াত বানানো যায় না। প্রতিটা আয়াতে পার্মানেন্ট সিরিয়াল নাম্বার
দেয়া আছে। এটাই কুরআনের মোজেজা। ‘কোরআন
যে আল্লাহর বাণী তা কীভাবে বুঝবো’- এই প্রশ্ন নবীজীকে প্রতিদিন করতো আরবের লোকেরা।
এই প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ কুরআনে অনেকবার দিয়েছেন। (সুরা বাকারা, আয়াত-২৩ – সুরা ইউনুস,
আয়াত-৩৮ দ্রষ্টব্য)।
উমাইয়া, আব্বাসীয়, উসমানীয় শাসনামলে
হাজার হাজার জাল হাদীস বানানো হয়। কিন্তু ১৫০০ বছরের বিশ্ব পরিক্রমায় বিভিন্ন পরাশক্তির
আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষরও কেউ বদলাতে পারেনি। হাদিস যদি
কোরআনের মতো ওহি হতো তাহলে হিটলার, মুসোলিনি, আকিহিতোর পক্ষেও একটি জাল হাদীস বানানো
সম্ভব হতো না। মনগড়া তাফসীর লেখার সাধ্য কারো হতো না।
পবিত্র কুরআনেরও অনেক মনগড়া দলীয়
তাফসির আছে। প্রতিদিন নতুন নতুন তাফসীর বাজারে
আসছে। কোরআন বোঝার জন্য ১০টা তাফসির, ২০টা অনুবাদ ক্রস চেক করতে পারি। কিন্তু কোনো
তাফসীরকে চূড়ান্ত বা নির্ভুল মনে করা যাবে না। কারণ এর তাফসীরকারকের মাযহাব সম্পর্কে
আমরা জানি না। হাদিস কুরআনের ব্যাখ্যা। হ্যাঁ, কোরআনে যা আছে, হাদিস, সীরাত ও ইসলামের
ইতিহাসে তার আরও বিস্তারিত বর্ণনা আছে। ঘটনাবহুল বিবরণ আছে। যে হাদীসগুলো কোরআনের ব্যাখ্যা
বা কোরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ- ঝগড়া কিন্তু সে হাদিসগুলো নিয়ে নয়। মূলত হাদীস নিয়ে
এতো এতো ঝগড়া বিবাদের কারণ এমন কিছু হাদিস, যে সব কথা কুরআনে নাই।
শিয়া-সুন্নি মিলিয়ে দুনিয়ার সব হাদীস
গ্রন্থে যা হাদিস আছে, তারমধ্যে ‘সিঙ্গেল ফ্যাক্ট এন্ড অ্যাক্ট’ অনুযায়ী সহিহ হাদিস
আছে প্রায় ৩৫০০। এরমধ্যে মওকুফ, মাকতু অর্থাৎ সাহাবী তাবেঈদের বাণী এবং কুরআনের হাদিসের
পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে সর্বোচ্চ দু-তিন’শ হাদিস পাওয়া যাবে যা কুরআনে নাই। এই দু-তিন’শ
হাদিসের জন্য ইসলাম ধর্ম অচল হয় না, কিন্তু আমাদের ধর্মের দোকানে তালা পড়ে।
আমাদের দেশের হাফিজি মাদ্রাসায় যারা
পড়েন তাদের আয়ের প্রধান উৎস তারাবি নামাজ। কোরআনে তো নাইই, নবীজির সময়ও এমন আয়োজন করে
খতম তারাবি পড়ার কোনো বর্ণনা হাদিসেও নাই। মাদ্রাসায় যারা পড়েন, তারা মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস
বা মুফতি হবেন, ওয়াজ করবেন। বড় ও ছোট মসজিদে ইমামতি ও আজান দিয়ে চলে বাকিদের। এমন পেশাদার
ইমাম মোয়াজ্জিনের ধারণাও নেই হাদিসে। এখনকার মতো মাদ্রাসা এবং ওয়াজের প্রচলনও নবীজির
সময় ছিলোনা। তাবলিগ জামাতের সাথে কুরআন তো বহুদূর, হাদিসেরও কোনো সম্পর্ক নাই। মিলাদ,
জানাজা, বিয়ে পড়ানো, কোরবানির গরু জবাই দেওয়া হুজুরদের সাইড ইনকাম। কিন্তু এই ধরনের
পেশাদার কার্যক্রমের কোনো বর্ণনা হাদিসেও পাবেন না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মসজিদ কমিটি ইমাম-মুয়াজ্জ্বিনদের
সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করে। ইমাম সাহেবদের সত্য বলার সাহস নেই। কারণ তিনি জানেন-
এই ক্রীতদাস হওয়ার জন্য আরেকজন শাইখুল হাদীস অপেক্ষমান আছেন। বেশিরভাগ মসজিদ কমিটি
হানাফি, সুন্নি, আহলে হাদীস, পাক পাঞ্জাতন ইত্যাদি দল বা তরিকাপন্থী। সেই তরিকার বাইরে
ফতোয়া দিলে হুজুরের চাকরি নাই। কোরআনের হাফেজ তথা রক্ষক হয়েও তারাবী, মিলাদ, ওয়াজের
হাদীয়া- এসব সংকীর্ণ আসক্তি থেকে বের হতে না পারলে তাদের দিয়ে কোরআন প্রতিষ্ঠা হবে
না।
নবীজি(সাঃ) ও প্রধান সাহাবীরা কোরআন
কায়েমের জন্য নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে হিজরত করেছেন। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই চরম আত্মত্যাগের
নামই আল্লাহর পথে জিহাদ। কিন্তু এখনকার স্কলাররা সত্য বলতে পারেন না আহলে ‘আবু জেহেলদের’
ভয়ে। কোরআনে নাই, কিন্তু আমরা ফরজ বা হারাম ফতোয়া দিয়ে বসে আছি। কারণ এই ফরজ-হারাম
সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এই ফরজ-হারামের বিরুদ্ধে কথা বললে হুজুরের চাকরি থাকবে না।
সুরা বনি ইসরাইল আয়াত-৩৬:
“আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার
অনুসরণ করো না”।
যা আল্লাহ আমাকে জানাননি তা সত্য হতে
পারে, কিন্তু আমার জানা নেই। কুরআনে আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু রাসূল(সাঃ) যে কোরআনের ভিত্তিতেই যাবতীয় বিধি-বিধান দিয়েছেন তাও পরিষ্কার জানিয়েছেন।
সূরা আহযাবের ২য় আয়াতে আল্লাহ নবীকে বলছেনঃ
“আর তোমার রবের কাছ থেকে তোমার প্রতি
যা ওহি করা হয় এর বাইরে তুমি আর কোনো কিছুর অনুসরণ করো না”।
কোরআনের বাইরেও হাদিসের ভিত্তিতে অনেক
হালাল-হারাম ও ফরয-ওয়াজিব প্রচলিত আছে। আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যের বরাত দিয়ে
এগুলো আমাদের মানতে বাধ্য করা হয়। সূরা তাহরিম এর ১ নং আয়াতে আল্লাহ নবীজিকে শোকজ
নোটিশ দিয়েছেনঃ-
“হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্য যা হালাল
করেছেন তুমি কেনো তা তোমার জন্য হারাম করছো”?
নবীজীর স্ত্রীরা যা পছন্দ করতো না
এমন খাবারকে নিজের জন্য হারাম বললে আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন।
সুতরাং কোরান যা হালাল বা হারাম বলেনি,
তাকে নবী হালাল বা হারাম বলেননি। কিছু ক্রিয়েটিভ লোক প্রশ্ন করেন যে, নবীজির কোন কোন
স্ত্রীকে খুশি করতে কী খাবার হারাম করেছেন তা হাদিস ছাড়া কীভাবে বুঝবো? কিন্তু এই
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কোন পরীক্ষায় আসবে? কবরে? না পুল-সেরাতে? নাকি বেহেস্তের দরজায়?
আবু জেহেলরা এমন প্রশ্নগুলোই নবীজীকে করতো যে, ‘হাদিস
ছাড়া দাড়ি রাখবে কেমনে? মৌছ কতটুকু রাখবে? কোন হাতে পানির গ্লাস ধরবে? আল্লাহর কিতাবে
তো সব কিছুর বিস্তারিত বিবরণ নেই। নবীজী এমন প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছেন? আল্লাহ নবীজিকে
যে উত্তর দিতে বলেছেন। সূরা হুজুরাত, আয়াত-১৬:
“বল, তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের দ্বীন
শিক্ষা দিচ্ছো? অথচ আল্লাহ জানেন, যাকিছু আছে আসমানসমূহে এবং যাকিছু আছে জমিনে”।
সুতরাং নবীজি(সাঃ) কোরআন অনুযায়ীই তার স্ত্রী, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের
নাগরিকদের বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন।
নবীজি(সাঃ) ব্যাক্তিজীবনে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রের
সেনাপ্রধান ছিলেন। সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধান বিচারপতি, সেনাপ্রধান হিসেবে
নবীজির সকল আদেশ-নিষেধ সংশ্লিষ্টদের জন্য অবশ্য পালনীয় ছিলো। সুরা আহযাব, আয়াত-৩৬:
“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর
জন্য নিজেদের ব্যাপারে অন্য কিছু করার অধিকার থাকে না। আর যে আল্লাহর রাসূলকে অমান্য
করলো সে সুষ্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে”।
সূরা আহযাবের নির্দেশগুলো নবীজির স্ত্রী, পরিবার, ঘনিষ্ঠ সাহাবী ও
সমসাময়িক লোকদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। আমাদের মধ্যেও কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ
অমান্য করলে সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। এখন আল্লাহর নির্দেশ কি? কোথায় লেখা আছে?- কোরআনে।
কোরআনের বাইরে আর কোনো কিছুকে আল্লাহর বাণী হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নাই। একইভাবে নবীজির সিরাত ও সুন্নতের নির্ভুল,
নির্ভেজাল বিবরণ কেবলমাত্র কোরানেই আছে।
আমরা হাদিস বা সুন্নাহ বলতে নবীজীর কথা, কাজ এবং অনুমোদনকেই বুঝি।
নবীজি কি বলেছেন, কি করেছেন, কি করতে নিষেধ করেছেন, বা কি অনুমোদন দিয়েছেন? আল্লাহ
নবীকে যা বলতে বলেছেন, যা করতে বলেছেন বা যা করতে নিষেধ করেছেন- তাই না? কোরআনে শহশ্রাধিক
আয়াত আছে যাতে আল্লাহ নবীজিকে বলেছেন,
‘হে নবী আপনি বলুন, আপনি জানিয়ে দিন, আপনি পড়ুন, আপনি করুন, আপনি করবেন না, আপনার
জন্য এটা করা উচিত হবে না, আপনার জন্য এটা করা পাপ হবে না, এ বিধান একমাত্র আপনার জন্য-
মুমিনদের অন্যান্যদের জন্য নয়। অর্থাৎ নবীজির অতি ব্যক্তিগত পারিবারিক বিষয় থেকে
শুরু করে সকল কথা-কাজ অনুমোদনের সুস্পষ্ট বিবরণ কুরআনেই আছে। তবে কোরআনের বাইরে কি
নবীজি আর কিছু বলেননি? অবশ্যই বলেছেন। কিন্তু সেসব আমরা কিভাবে জানবো? কেনো জানবো?
প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক নির্বাহী আদেশ অবশ্যই আইন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট
যতো কথা বলেন সব নির্বাহী আদেশ নয়। আল্লাহর নির্দেশে নবীজি যতো নির্বাহী আদেশ দিয়েছেন
তার খতিয়ান কোরআনেই আছে। এর বাইরে নবীজির বেডরুমে, বাথরুমে সিসি ক্যামেরা লাগানোর
অনুমতি কে দিয়েছে? বাথরুম সিস্টেম উদ্ভাবন করার জন্য আল্লাহ নবীজিকে পাঠাননি। জঙ্গলের
পশু-পাখিকেও এসব শেখাতে হয় না।
রাষ্ট্রদূতের কথা আক্ষরিক অর্থেই রাষ্ট্রপ্রধানের কথা। কিন্তু ‘নওরোজ
আনোয়ার’ নামের জনৈক ব্যক্তি ‘আমি রাষ্ট্রদূতকে বলতে শুনেছি’ বললে সেটা প্রেসিডেন্টের
কথা বা রাষ্ট্রদূতের কথা বলে বিবেচিত হবে? সে কথার উপর ভিত্তি করে বোমা মেরে দেয়া
যাবে? কোনো পত্রিকা সেই নওরোজ আনোয়ারের বরাত দিয়ে রিপোর্ট করলে আপনার প্রতিক্রিয়া
কী হবে? নওরোজ আনোয়ার আবার কে? রাষ্ট্রদূতের ছোটভাই। রাষ্ট্রদূত তার ছোট ভাইয়ের সাথে
কোনো কথা বললে সেটা কি অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট? আর নওরোজ আনোয়ার কি কোনো সরকারি সূত্র?
সূরা আহযাবে নবীজির স্ত্রী, পরিবারের সদস্য, বিশিষ্ট সাহাবী ও সমসাময়িক
কালের মানুষদের জন্য কিছু নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা সুরায় পরিষ্কার করে বলা আছে। এসব
একান্ত ঘরোয়া নির্দেশও কোরআনে বলা আছে। তবু আমরা বলছি কুরআনে সবকিছু বিস্তারিত বলা
নেই!
“হে মুমিনগণ, তোমরা খাবারের আমন্ত্রণ বা অনুমতি ব্যতীত নবীর ঘরে প্রবেশ
করো না। আর যখন তোমাদেরকে ডাকা হবে তখন তোমরা প্রবেশ করো আর খাবার শেষ হলে চলে যাও,
কথাবার্তায় লিপ্ত হইওনা”।
এ আয়াত থেকে কি বোঝা যায়? হে মুমিনগন বলতে আল্লাহ কাদেরকে বলেছেন?
যাদের নবীর ঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো তাদেরকে। আয়াতের শেষে বলেছেনঃ
“আর আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া ও তাঁর মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদের বিয়ে
করা কখনো তোমাদের জন্য সঙ্গত নয়। নিশ্চয় এটি আল্লাহর কাছে গুরুতর পাপ”।
নবীজির স্ত্রীদের বিবাহ নিষেধাজ্ঞা কি মুমিন নারীদের জন্য প্রযোজ্য?
বা এ বিধান কি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক?
“যে বিষয়ে তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না”।
নবীজী রাষ্ট্র, সরকার ও বিচারকাজ কোরআনের ভিত্তিতেই পরিচালনা করেছেন।
নবীজি(সাঃ)-এর কথা-কাজ, আদেশ-নিষেধ সবই আছে কোরআনে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নবীজি(সাঃ)-এর
গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো নির্ভুল তথ্য থাকলে তা অবশ্যই আমাদের জন্য আদর্শ। কিন্তু
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারে নবীজি(সাঃ)-এর নামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
হাদিস বানানোয়- সেসব নির্দেশের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।
আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অনুসরণের আয়াতগুলোর বেশিরভাগ স্পষ্টতঃ
নবীজির সমসাময়িককালের মানুষদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। এখনকার সময়ে আমার আপনার বা
আমাদের জন্য প্রযোজ্য বা প্রাসঙ্গিক নয়।
সূরা হুজুরাত আয়াত-৭:
“আর তোমরা জেনে রাখো যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছে। সে যদি
অধিকাংশ বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে নিতো তাহলে তোমরা অবশ্যই কষ্টে পতিত হতে”। তোমাদের
বলতে নবীজীর পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্য করা হয়েছে।
সূরা আহযাব, আয়াত-৩১:
“আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে এবং
নেক আমল করবে; আমি তাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেবো”। তোমাদের বলতে নবীজির স্ত্রীদের বলা
হয়েছে।
তবুও ‘কোরআনে তো সকল প্রশ্নের উত্তর নেই’। এই সকল প্রশ্নের সমাধান হাদিস বা ফিকাহ্র কিতাবেও
নাই। বিভিন্ন ওয়াজে, ইস্তেমায় যে বয়ান শোনেন এর বেশিরভাগ হাদীসের কিতাবেও নাই।
‘জিউস ট্রেডিশন’ বা ইহুদী লোকগাঁথায় বিভিন্ন নবীদের অনেক মুখরোচক গল্প
আছে। এছাড়া খৃষ্টান ধর্মপ্রচারকদের কিছু গল্প আমাদের শায়খরা ইসলামের ভার্সন বানিয়ে
কয়েক মিলিয়ন ভিউ করিয়ে নিচ্ছেন। যেমন; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ‘মুস্তাজা-বুদ-দাওয়া’
রুটিওয়ালা যুবকের কিচ্ছা হলিউডের নকল।
কোরআন হাদীস তো একই সময়ের। সমাজ সমস্যা সমাধান একই ছিলো। যে সমস্যার
সমাধান কোরআন দিতে পারেনা তা হাদিস কিভাবে দেবে? “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো”
এই আয়াতের মাধ্যমে হাদিসকে কোরআনের মতো শরীয়ার উৎস বানানো হয়েছে। কিন্তু ইমাম, পীর
মানতে হবে কেনো? সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ
“ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আ-মানু আতিউল্লাহা ওয়া আতিউর রাসুলা ওয়া উলিল
আমরি মিনকুম”- (হে মুমিনগণ তোমরা আল্লাহর ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের আমীর বা
নেতার আনুগত্য করো)”।
মাযহাবী আলেমদের মতে এ আয়াত অনুযায়ী তোমাদের আমির মানে ইমাম আবু
হানিফা, শাফেঈ, বুখারী, তিরমিজী যা বলেছেন তাও মানতে হবে। কিন্তু এখানে আমির মানে সমাজ
বা রাষ্ট্রের প্রধান। রাষ্ট্রের আইন আপনাকে মানতেই হবে। রাসুল(সাঃ) সুনির্দিষ্ট ও অনুমোদিত
ব্যক্তি ছিলেন। সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তাই নবীজি(সাঃ) তাঁর সমসাময়িক মানুষদের
মধ্যে কোনো দল বা ব্যাক্তিবিশেষকে সরাসরি কোনো নির্দেশ দিলে তা তাদের জন্য অবশ্য পালনীয়
ছিলো। যুদ্ধে কোনো সেনাদলকে বিশেষ কোনো দায়িত্ব দিলে তা তাদের জন্য অবশ্য পালনীয় ছিলো।
কিন্তু আমাদের জন্য কোরআন ছাড়া নবীজির আর কোন অনুমোদিত শাখা বা প্রতিনিধি নাই। হাদীস
বর্ণনা, সংগ্রহ, সংকলন, সংরক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট কাউকে অনুমোদন দেয়া হয়নি।
এছাড়া কোরআন যেহেতু ২৩ বছর সময় জুড়ে নাযিল হয়েছে, তাই নবীজির(সাঃ)
এবং সাহাবীরা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে এমন অনেক কাজ করেছেন যা কোরআনে তখনও নিষেধ করা হয়নি।
আবার এমন অনেক কিছু পালন করেননি, কারণ কোরআনে তখনও সেসব আদেশ দেয়া হয়নি। দিন-তারিখ
ছাড়া একটি হাদীসের ভিত্তিতে আমরা বলে দিলাম হাদিস সহি- সুতরাং এটা ফরজ বা হারাম! হাদিস
তো সহি, কিন্তু দুই বছর পর কোরআনের নতুন আয়াত নাযিল হওয়ার পর যখন আগের হালাল হারাম
হয়ে গেছে, আগের বিধান বদলে গেছে।
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম”-(৫:৩)।
এ কারণে সম্পূর্ণ কোরআন নাজিলের আগে বিভিন্ন সময়ে নবীজি যেসব সাময়িক
সমাধান দিয়েছেন তা লিখতে নবীজিই নিষেধ করেছেন। সেসব হাদিস নবীজি ও খোলাফায়ে রাশেদীনের
সময় বিশেষভাবে সংরক্ষন করা হয়নি। সম্পূর্ণ কোরআন নাজিলের পর বিদায় হজের খুতবায় নবীজি(সাঃ)
কেবলমাত্র কোরআনই অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের দেশে সাহাবী ও নবীদের নামে বিভিন্ন শিশুর নাম রাখা হয়। নওমুসলিমদের
ইসলামী নাম দেয়া হয়। কিন্তু আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, খাদিজা- এ নামগুলো ইসলাম গ্রহণের
আগের নাম। ইব্রাহিম শব্দটি আরবী নয় এবং তা হযরত ইব্রাহিম(আঃ)-এর মুশরিক পিতার দেয়া
নাম। মক্কায় অনেক কাফের, মুশরিকদের একই ধরনের নামই ছিলো। আরবে অনেক কাফের, মুশরিকদেরও
এ ধরনের নাম ছিলো। কিন্তু আমরা এগুলোকে ইসলামী নাম বলছি। এমনই ইসলামী পোশাক, ইসলামী
রীতি রেওয়াজ চালু আছে যে সম্পর্কে কুরআনে কোনো আলোচনাই নেই।
“কোরআন সম্পূর্ন, পরিপূর্ণ একমাত্র অনুমোদিত কিতাব”-(৬:৩৮ ও ৫৫)।
কোরআনে আল্লাহ সবকিছু বিশদ, বিস্তারিত বলেছেন।
“কোরআনের ভিত্তিতে যারা ফায়সালা করে না তারা কাফের, জালেম ও ফাসেক”-(৫:৪৪)।
“তোমরা কেবল কোরআন অনুসরণ করো। আল্লাহ যা নাজিল করেছেন এর বাইরে আর
কোনোকিছুর অনুসরণ করো না”-(৭:৩)।
“কোরআন উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ”-(৫৪:১৭)।
“আর তার চেয়ে বড় জালিম আর কে, যাকে তার রবের আয়াতসমূহের মাধ্যমে
উপদেশ দেয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়”-(৩২:২২)।
“আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি যেন তারা কুরআন বুঝতে না পারে”-(১৮:৫৭)।
কোরআন পড়লে এমন অনেক আয়াত পাবেন। নিজেই অবাক হবেন যে, হায়রে! এসব
আয়াত এতোদিন চোখে পড়েনি কেনো?
প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে যতো মানুষের সাথে আমাদের দেখা হয়, সবাইকে
আমরা চিনি না। কারণ আমাদের ব্রেইন সবাইকে মনে রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আপনার মধ্যে
যখন এই উপলব্ধি তৈরি হবে যে, সারা দুনিয়ায় কে কি বলেছে- তা নয়, কুরআন কি বলেছে আমি
তাই বোঝার চেষ্টা করবো। তখনই দেখবেন, আরে তাই তো! কোরআন বুঝা তো সহজ। কোরআনের উপদেশ
পরিস্কার, সংক্ষিপ্ত এবং পরিপূর্ণ। আমাদের
জন্য প্রযোজ্য নয় নবীজির এমন ধর্মীয়-সামাজিক নির্দেশও কোরআনে সংরক্ষিত।